শাবিপ্রবির অচলাবস্থা হাসিমুখে কাটেনি, কান্নার মধ্যে দিয়ে কেটেছে। আন্দোলনের ১৩ দিন পরও উপাচার্য অপসারণ কিংবা অনশন প্রত্যাহার না হওয়া তো অচলাবস্থাই। তা কাটাতে সরকারেরই উদ্যোগী হওয়ার কথা ছিল। সেটা হতে পারতেন আচার্য হিসেবে মাননীয় রাষ্ট্রপতি, নিদেনপক্ষে শিক্ষামন্ত্রী, ন্যূনতম হলেও শিক্ষাসচিব। তাঁরা শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিতে পারতেন। রাষ্ট্রীয় পদাধিকারী যে কারও ঘোষণা কেবল মুখের কথা থাকে না, তা বাস্তবায়নের জরুরত থাকে।
কিন্তু সরকারের তরফে কেউ দায় নিলেন না। সরকারের উচ্চ মহলের অনুরোধে সেই দায় নিলেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি মধ্যরাতে সিলেটে ছুটে গেলেন। দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে মরণাপন্ন শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙালেন। শান্তি না এলেও স্বস্তি এল। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিশ্বাসের কাছে বিবেকবন্দী হয়ে পড়লেন শাবিপ্রবির এই সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ। দাবিগুলো আদায় করে নেওয়ার জামিনদার হিসেবে তাঁর কাছে সবারই প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গেল। এই দেশে যখন কেউ কথা রাখে না, আশা করি জাফর ইকবাল হিম্মতের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি আদায়ে ভূমিকা রাখবেন। কীভাবে তিনি তা করবেন, সেটা তাঁর আর তাঁর ‘উচ্চ মহলের’ ব্যাপার।
এরপর আন্দোলনে যদি ব্যর্থতাও আসে, তার দায় আর শিক্ষার্থীদের রইল না। বরং সাহস ও সততার পরীক্ষায় তাঁরা শতভাগ বিজয়ী হয়েছেন। এই বিজয় বাস্তবিক না হলেও নৈতিক। আমরণ অনশন ভাঙার সময়ে শিক্ষার্থীদের বুকভাঙা কান্নার কাছে আমাদের অনেক ঋণ থেকে গেল। তাঁদের মুখে হাসি ফেরানোর দায় এখন সরকারের উচ্চ মহল এবং তাদের প্রতিনিধিদের ওপর। আমাদের সাংস্কৃতিক জগতের বড় সংগঠনগুলো অতীতে ক্যাম্পাসের দুঃসময়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াত। কিন্তু এখন তাঁরা প্রশান্ত হয়ে আছেন। কেবল বিএনপি সরকারে থাকলেই তাঁরা অন্যায় দেখবেন, অন্যসময় দেখবেন না, এটা পক্ষপাত। পক্ষপাত সমাজকে আরও বিভক্ত করে ফেলে।
গোড়ার কথায় ফেরা দরকার। সাত দিনের আমরণ অনশন কেন করতে হলো? কেন আন্দোলনে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কারণে শাবিপ্রবির পাঁচ সাবেক ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হলো? এগুলো কি দাবি মেনে নেওয়ার লক্ষণ? কেন শিক্ষার্থীদের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হলো? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পাসে পুলিশ আসা তো দূরের কথা, শিক্ষার্থীদের নামে মামলাও দেওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, শিক্ষামন্ত্রী নিজে না গিয়ে কেন প্রতিনিধি পাঠালেন? দাবি যদি মেনেই নেবেন, তাহলে এত কষ্ট দেওয়ার কী দরকার ছিল? মানতে রাজি হলে দাপ্তরিক ঘোষণা দিলেন না কেন? ছাত্রছাত্রীদের দাবি মানা কি কখনো নতিস্বীকার হয়? বাংলাদেশ তো ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদেরই সৃষ্টি।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন যে ক্ষমতার খুঁটিমাত্র, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এই আন্দোলন। ক্যাম্পাসগুলোর অমানবিক ও দমবন্ধ বাস্তবতার দিকেও মানুষের নজর ফেরানো গেছে। অনশন-তপস্যার আঘাতে অনেকেরই মুখোশ খুলে গেছে। আলোচিত ৩৪ জন উপাচার্য মানুষের চোখে ফরিদ উদ্দিনের সমগোত্রের বলে বিবেচিত হচ্ছেন। শিক্ষক সমাজের বড় অংশটাও শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন।
অধ্যাপক জাফর ইকবাল যা করলেন, তা করার কোনো লোকই কি সরকারি মহলে ছিলেন না? নাকি তাঁরা নিজেদের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে সন্দিহান। দাপ্তরিক ঘোষণা না আসা এবং প্রতিনিধি দিয়ে কার্যোদ্ধার করা কৌশল হয়ে থাকলে কারওরই হয়তো কিছু করার থাকবে না। তবে জাতির কাছে বিশ্বাসভঙ্গের খেতাব তাঁরা পাবেনই পাবেন।
এটা ঠিক যে আন্দোলনের কোনো লক্ষ্যই পূরণ হয়নি। উপাচার্য এখনো বহালই আছেন। কিন্তু ১৩ দিন আগে যে ক্ষমতা ও মর্যাদা তিনি উপভোগ করতেন, এখন তার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। পদত্যাগ ছাড়া দেশবাসীর ধিক্কারের নিশানা থেকে সরার উপায় নেই তাঁর। সরে যাওয়া মানে যেন আবার রাষ্ট্রদূত করে বিদেশে পাঠানো না হয়, বা শিক্ষা উপদেষ্টা না করা হয়। অতীতে ছাত্র আন্দোলনে বিদায় হওয়া উপাচার্যদের এ রকম করে পুনর্বাসন করতে দেখা গেছে। এগুলো খারাপ দৃষ্টান্ত। আমাদের দরকার ভালো দৃষ্টান্ত যে, অন্যায় করে পার পাওয়া যায় না।
আন্দোলনের মুখে উপাচার্য কেন কোনো পদাধিকারীকে অপসারণ না করার নীতি হয়তো রয়েছে সরকারের। বিজয়ের স্বাদ আন্দোলনকে দিলে আরও আরও আন্দোলন উৎসাহিত হবে, অন্য ক্যাম্পাসগুলির রাজনৈতিক খুঁটিধারী উপাচার্যরা বিচলিত হবেন, তা চাইবে না সরকার। কিন্তু বারবার শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমন কিংবা কৌশলে প্রশমিত করতে থাকলে, অশান্তিপূর্ণ পথে হাঁটার ঝোঁক বাড়বে। সরকার কি সেটাকে ভালো মনে করে?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন যে ক্ষমতার খুঁটিমাত্র, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এই আন্দোলন। ক্যাম্পাসগুলোর অমানবিক ও দমবন্ধ বাস্তবতার দিকেও মানুষের নজর ফেরানো গেছে। অনশন-তপস্যার আঘাতে অনেকেরই মুখোশ খুলে গেছে। আলোচিত ৩৪ জন উপাচার্য মানুষের চোখে ফরিদ উদ্দিনের সমগোত্রের বলে বিবেচিত হচ্ছেন। শিক্ষক সমাজের বড় অংশটাও শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। শাবিপ্রবিতে ১২০০ কোটি টাকার চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে উপাচার্য পদ আঁকড়ে থাকা এবং শিক্ষক রাজনীতির সম্পর্ক নিয়েও কথাবার্তা উঠেছে। একটি ঘটনায় এতগুলি গোমর ফাঁস হওয়াও বা কম কী।
তাই শেষের আগেই শেষ ভাবার কিছু নেই। মরার আগে মরে কাজও নেই। ক্যাম্পাসগুলোতে মানবিক পরিবেশ এবং উচ্চশিক্ষার অধঃপতন ঠেকানোর জন্য ছাত্রছাত্রীরা যা করার করেছেন। শিক্ষার্থীদের শক্তিটা ছিল সারল্যের, আবেদনটা ছিল ন্যায়বিচারের, ভাষাটা ছিল অরাজনৈতিক এবং চেষ্টাটা ছিল মরিয়া। নিন্দা-প্রতিবাদ আর আশার জাগরণও দেখা গেছে। বিপরীতে দেখা গেছে সরকারি নির্দয়তা ও কূটকৌশল। স্বাধীনতা ও মানবতার জন্য জানবাজি করা ছাত্রসমাজকে মারের ওপর রাখার ঔপনিবেশিক নীতি আর কতকাল চলবে?
এখন দেশের অগ্রসর নাগরিক সমাজ এবং শিক্ষাবিদদের দরকার। উপাচার্যদের ক্ষমতার অপব্যবহার কমানো, শিক্ষাবিদদের উপাচার্য বানানো এবং দখলদারি ও বখরাগিরি বন্ধ এবং যোগ্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য কাজ শুরু করার এখনই সময়। শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা আশাবাদের মরা গাঙে জোয়ার এনেছেন, এখন বিদ্বৎসমাজের উচিত শিক্ষার অচলায়তন ভাঙার মশালটা তাঁদের হাত থেকে নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া। তারই প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে শাবিপ্রবির সব দাবি দ্রুত মেনে নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া। অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালও নিশ্চয়ই রণেভঙ্গ দেবেন না।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক
faruk.wasif@prothomalo.com