এই পবিত্র রমজানে আমরা যখন সবাই সাহ্রি আর ইফতারে কী খাব তা নিয়ে ব্যস্ত, নতুন কোন পদ রান্না করা যায়, সেটি নিয়ে আলাপ করছি পরিচিতজনদের সঙ্গে, তখন ছোট্ট শিশু আরিয়ান দেখছে তার অসুস্থ মা দিনের পর দিন ইফতার করছেন শুধু পানি দিয়ে। মা-ছেলের সংসারের সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে ভালো খাবারটিই এখন পানি। কিন্তু কেবল পানি দিয়ে তো আর দিন চলে না। পাঁচ বছরের ছোট্ট আরিয়ান তাই নিজেই বেরিয়ে গেছে শাক কুড়িয়ে বিক্রি করে মায়ের জন্য চাল কিনে আনবে বলে।
কুড়ানো শাক বিক্রি করে ৮০ টাকা পেয়েছিল আরিয়ান। পাশে মেলা চলতে দেখে শাক বিক্রি করে পাওয়া ৮০ টাকা সে খরচ করে ফেলেছে মায়ের জন্য চামচ আর একটা প্লাস্টিকের কৌটা কিনে। তার কাছে তখন আছে কেবল দুই আঁটি শাক। চামচ আর প্লাস্টিকের কৌটা কিনলে আর চাল কেনার টাকা থাকবে না, এই হিসাব আরিয়ানের ছোট্ট মাথায় না ধরলেও এটুকু সে বুঝেছে যে ওই টাকা খরচ করতে হবে মায়ের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য। দাঁড়িয়ে শিশুদের নাগরদোলায় চক্কর খাওয়া দেখেছে আরিয়ান, কিন্তু কিছু টাকা খরচ করে নিজে সেটায় চড়েনি কিংবা নিজের জন্য কিনে ফেলেনি সস্তা কোনো খেলনা। দারিদ্র্য কী নির্মমভাবে শৈশব হরণ করে অবিশ্বাস্য রকম পরিণত করে দিয়েছে পাঁচ বছরের শিশুটিকে!
ছোট্ট আরিয়ানকে নিয়ে বুক ভেঙে যাওয়ার অনুভূতিটা কেটে গেছে দ্রুতই। হ্যাঁ, প্রায় সবার মতোই আরিয়ানকে নিয়ে প্রথম আলোর লিখিত ও ভিডিও প্রতিবেদন দেখে কষ্টে, ক্ষোভে, ক্রোধে বুক ভেঙে যাওয়ার অনুভূতি হয়েছিল আমারও। সেই অনুভূতির মধ্যেই মনে হলো প্রথম আলোর প্রতিবেদন হয়তো আরিয়ানকে বাঁচিয়ে দেবে। কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হলাম। কিন্তু একজন আরিয়ান নাহয় বেঁচে গেল প্রথম আলোর কল্যাণে ভাইরাল হয়ে, কিন্তু কী আছে এমন আরও লাখ লাখ আরিয়ানের ভাগ্যে?
প্রথম আলোর ফেসবুক পাতায় আরিয়ানের যে ভিডিও শেয়ার করা হয়েছিল, এ কলাম লেখার সময় দেখলাম, সেই পোস্টে এক লাখের বেশি প্রতিক্রিয়া আছে। মন্তব্য আছে প্রায় পাঁচ হাজার। অনেক মন্তব্য পড়ে দেখলাম, তীব্র বেদনাহত মানুষ আরিয়ানের পাশে আর্থিকভাবে দাঁড়াতে চেয়েছেন। সরকারি লোকজনকেও পাঠানো হয়েছে আরিয়ানের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে। অসংখ্য মন্তব্যের মধ্যে আছে সরকারের প্রতি, সরকারের দাবিকৃত তথাকথিত উন্নয়নের প্রতি তীব্র ক্ষোভ–ঘৃণাও।
মিডিয়ায় এসব খবরের পাশাপাশি দেখেছি এসব শিরোনামের খবরও, ‘গরু মোটা চাল খায়, কুঁড়েঘর কবিতায়’, ‘দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ সরু চাল খায়’, ‘মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তিন গুণ বেড়েছে’, ‘রাত পোহালেই আয় বাড়ছে, আমরা অজান্তেই বড়লোক হয়ে যাচ্ছি’, ‘চালের সংকট কমাতে মানুষ যেন ভাত খাওয়া কমিয়ে অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার বেশি করে খায়’, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি সিঙ্গাপুরের চেয়ে শক্তিশালী’, ‘হাতিরঝিলে গেলে মনে হয়, প্যারিস শহরের কোনো অংশে এসেছি’, ‘আকাশ থেকে ঢাকা শহরকে লস অ্যাঞ্জেলেস মনে হয়’, ‘বিশ্ব এখন বাংলাদেশের উন্নয়নের রহস্য জানতে চায়’ ইত্যাদি।
আরিয়ান মনে করিয়ে দিল তারই সমবয়সী প্রথম শ্রেণির ছাত্রীর কথা, যাকে নাদিয়া জান্নাত ছদ্মনামে আমাদের সামনে প্রথম আলোই এনেছিল মাস খানেক আগে। সেই প্রতিবেদনে যুক্ত করা ছবিতে দেখা যায়, টিসিবির ট্রাকের পেছনে দাঁড়ানো ছোট্ট কন্যাশিশুটির হাত পৌঁছাচ্ছে না ট্রাকের পণ্য পর্যন্ত। পরে অন্যদের সাহায্যে সেটা নিতে পারে মেয়েটি। কেন সে এসেছে, সে প্রশ্নের জবাবে বলে, ‘কী করব, আম্মু অসুস্থ। বাজার করার এত টাকা আমার আব্বুর তো নাই।’ টিসিবির ট্রাকের পেছনের লাইন নিয়ে প্রথম আলোর ধারাবাহিক প্রতিবেদনে জানা যায় আরও অনেক গল্প।
শ্রবণ ও বাক্প্রতিবন্ধী মো. শফিকের বয়স আশির ওপরে। বয়স আর তীব্র অপুষ্টি তাঁর শারীরিক অবস্থাকে এতই ভঙ্গুর করে তুলেছে যে তাঁর হাতের লাঠিটি আর সোজা হয়ে দাঁড়ানো আর হাঁটার কাজে লাগে না, কাজে লাগে কোনো রকমে কুঁজো হয়ে ভারসাম্য রক্ষার কাজে। হাঁটতে সাহায্য লাগে আরেকজনের। মো. শফিকের মেয়ে নিজ সন্তান নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তাঁর বাবাকে এক প্রতিবেশীর সহায়তায় পাঠিয়েছেন টিসিবির পণ্য আনতে।
মো. শফিকের চেয়ে বয়স কিছুটা কম অলিউল্লাহর। ৬৫ বছর। নদীভাঙনে ভিটেমাটিসহ সর্বস্ব হারিয়ে ঢাকায় এসে রিকশা চালিয়ে পরিবারের অন্ন সংস্থান করা মানুষটি এখন লাঠি ছাড়া দাঁড়াতেও পারেন না। তিনি ক্যানসারের রোগী। এই মানুষও এসেছিলেন টিসিবির ট্রাকের পেছনে লাইন দিয়ে পণ্য নিতে। না দাঁড়িয়ে উপায় কী তাঁর? সংসার কীভাবে চলে, প্রশ্নের জবাবে তাঁর উত্তর, ‘সংসার চলে না, কোনোমতে বাইচ্চা আছি।’
টিসিবির লাইনে আছেন এমন আরও অনেকে। ৫ বছরের ছেলেকে হাতে আর কোলে ২ মাস ২০ দিন বয়সী মেয়েকে নিয়ে আছেন রীনা বেগম। পকেটে ৩০০ টাকা নিয়ে ঘণ্টাখানেক লাইনে দাঁড়ানোর পর প্যাকেজ কিনতে ৭৯০ টাকা লাগবে জানতে পেরে হতাশ হওয়া মোস্তফা কামালও আছেন লাইনে। আছেন যমুনা রানী, যিনি শাক কুড়িয়ে বিক্রি করে দিনে ১০০ টাকা উপার্জন করে টিসিবি ট্রাকের লাইনের আশপাশে ঘোরাঘুরিই করেছেন, লাইনে দাঁড়ানোর চিন্তাও করতে পারেননি।
একজন শাক-কুড়ানি যমুনা রানীরই কি শুধু এই অবস্থা? ১০ হাজার টাকা বেতনে রাজধানীর ইন্দিরা রোড এলাকার একটি আবাসিক ভবনে দারোয়ানের চাকরি করা আবুল হাসিমের হাতে মাস শেষে ছিল ৪৫০ টাকা। বেতন পেয়ে শোধ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতেও পরিচিতজনদের কাছে কিছু টাকা ধার পাননি। শেষে অনেক নাটকীয়তার পর টাকা পেয়ে কিনতে পেরেছিলেন রোজার আগে ছোলা আর খেজুর যুক্ত করা ৯৭০ টাকার টিসিবির প্যাকেজ। বনানী কবরস্থানে মালির কাজ করা আবদুর রহমান নিজের পকেটে থাকা ২১০ টাকার সঙ্গে পরিচিত মানুষের কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার করে লাইনে দাঁড়িয়ে দেখেন প্যাকেজটি পেতে তাঁর আরও প্রয়োজন ২৬০ টাকা। অনেক কষ্টে সেটা জোগাড় করে আবার লাইনে দাঁড়ান তিনি।
অনেক চেষ্টা করে এই দুজন মানুষ তবু প্রয়োজনীয় টাকাটা জোগাড় করতে পেরেছিলেন। এটুকু টাকা জোগাড় করতে পারেননি এবং পারার সম্ভাবনার আশপাশেও নেই—সেই যমুনা রানীর মতো মানুষ আছেন অসংখ্য। টিসিবির লাইনে শেষ পর্যন্ত দাঁড়াতে পেরেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির কথায়ই ‘ভালো জামা কাপড় পরা’ মানুষ। চরম প্রয়োজন মধ্যবিত্তকেও তাঁর অহমের মাথা খেয়ে টিসিবির লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য করেছে।
একেকবার টিসিবির পণ্য কিনতে পারলে একজন মানুষ ২৫০ টাকার মতো বাঁচাতে পারে। বর্তমান বাংলাদেশে লাখ লাখ পরিবারের কাছে এই ২৫০ টাকাই এত অমূল্য হয়ে উঠেছে যে সেটা বাঁচানোর জন্য তাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে টিসিবির পণ্যের ট্রাকের পেছনে লাইন দেন। এমনকি বৃষ্টিও পারে না সেই লাইনকে ছত্রভঙ্গ করতে, লাইনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকেন মানুষ।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনেই জানা যায় ঢাকার জিগাতলায় বৃষ্টি আর ঝোড়ো বাতাসের কবলে পড়া এক টিসিবি ট্রাকের গল্প। প্রবল বৃষ্টির সঙ্গে বাতাসের তোপে ট্রাকে টাঙানো ত্রিপলটাও উড়ে যায় একবার। এমন ঝড়বৃষ্টিতেও দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন লাইন ছেড়ে যাননি। বৃষ্টিতে ভিজেই ট্রাকের পেছনে লাইনে যে যাঁর অবস্থানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে বৃষ্টির মধ্যেই পণ্য বিক্রি করেন পরিবেশকের বিক্রয় প্রতিনিধিরা। টিসিবির লাইনের একটি অবস্থানকে এভাবেই যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতে চেয়েছেন মানুষ।
শুধু সেটাই নয়, পরবর্তী সময়ে যখন এই পণ্য পাওয়ার জন্য কার্ড দেওয়া শুরু হলো, তখন ১০০ টাকা ঘুষ দিয়ে সেই কার্ড নিয়েছেন তাঁরা। কার্ড পাওয়ার জন্য এতই মরিয়া হয়েছেন মানুষ যে কার্ড না পেয়ে অবস্থান ধর্মঘট পর্যন্ত করেছেন তাঁরা।
আছে সবচেয়ে জরুরি পণ্য চাল না পাওয়ার কষ্ট। খুলনার আজিমুন্নেসা ট্রাক আসার স্থানে দাঁড়িয়েছিলেন সকাল ৯টায়। পণ্য দেওয়া শুরু হয়েছে দুপুর ১২টায়। এর ঘণ্টা দেড়েক পর হাতে পেয়েছেন কাঙ্ক্ষিত পণ্য। দীর্ঘ সাড়ে ৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করে পণ্য পেয়েও খুশি হতে পারেননি তিনি, ‘এত কষ্ট করে যেসব মাল পালাম, তাতে ভালো হুয়েছে; তবে সঙ্গে কডা চাল দিলি খাইয়ে বাঁচতাম।’ একই লাইনে দাঁড়ানো মণিকা রানী, সপু মাতব্বর ও সোহরাব হোসেনও বলেন, এসব পণ্য কিনতে গিয়ে বাজার থেকে চাল কেনার টাকায় টান পড়ছে তাঁদের। বাজার থেকে, কারণ ওএমএসের লাইনে দাঁড়ালে সব সময় চাল পাওয়া যায় না, আবার পেলেও দীর্ঘ অপেক্ষায় দিনটাই মাটি হয় তাদের। দুটো লাইনে দুটো দিন দাঁড়ানো অসম্ভব তাঁদের জন্য। একই স্থান থেকে চালও দেওয়া হলে তাঁদের সুবিধা হতো, বাঁচত সময়, নষ্ট হতো না এক দিনের রোজগার।
আবুল হাসিম কিংবা আবদুর রহমান টিসিবির যে প্যাকেজ কিনতে গিয়েছিলেন, তাতে তেল, পেঁয়াজ, চিনি আর মসুর ডালের সঙ্গে ছিল চার কেজি ছোলা আর দুই কেজি খেজুর। টিসিবির সাশ্রয়ী দামের রমজানের আগে দেওয়া অত্যাবশ্যক পণ্যগুলো কিনতে পারলে ২৫০ টাকা বাঁচানো যাবে—এটা জেনে যাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রাকের পেছনে লাইন দিয়েছেন, সেসব মানুষই নাকি ইফতারের ছোলা-খেজুর খাবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য জোগাড় করাটাই যাঁদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ, তাঁদের প্যাকেজের নামে ছোলা-খেজুর কিনতে বাধ্য করা অত্যাচারের শামিল।
মিডিয়ায় এসব খবরের পাশাপাশি দেখেছি এসব শিরোনামের খবরও, ‘গরু মোটা চাল খায়, কুঁড়েঘর কবিতায়’, ‘দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ সরু চাল খায়’, ‘মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তিন গুণ বেড়েছে’, ‘রাত পোহালেই আয় বাড়ছে, আমরা অজান্তেই বড়লোক হয়ে যাচ্ছি’, ‘চালের সংকট কমাতে মানুষ যেন ভাত খাওয়া কমিয়ে অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার বেশি করে খায়’, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি সিঙ্গাপুরের চেয়ে শক্তিশালী’, ‘হাতিরঝিলে গেলে মনে হয়, প্যারিস শহরের কোনো অংশে এসেছি’, ‘আকাশ থেকে ঢাকা শহরকে লস অ্যাঞ্জেলেস মনে হয়’, ‘বিশ্ব এখন বাংলাদেশের উন্নয়নের রহস্য জানতে চায়’ ইত্যাদি।
চারপাশের পরস্পরবিরোধী এসব সংবাদের মধ্যে মাথায় ঘোরে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব (র.)-এর একটা উক্তি, ‘ইউফ্রেটিসের তীরে একটি কুকুরও যদি ক্ষুধার্ত অবস্থায় মারা যায়, তাহলে আমি উমর আমার ওপর অর্পিত দায়িত্বের ব্যর্থতার জন্য দায়ী হব।’
• রুমিন ফারহানা বিএনপিদলীয় সাংসদ ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী