আজ ২৭ নভেম্বর, শামসুল আলম খান মিলনের ২৭তম শাহাদত দিবস। ২০১৭। ১৯৯০ সালের এই দিন বেলা আনুমানিক ১০টা ৩০ মিনিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে গণগ্রন্থাগারের কোনায় মিলন গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়। মিলনের শহীদ হওয়ার সংবাদে তৎকালীন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আন্দোলনরত সব পেশাজীবী সংগঠন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে ওঠে। জেনারেল এরশাদের দীর্ঘ ৯ বছরের দুর্নীতি আর দুঃশাসনের কারণে সাধারণ মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ সেদিন রাজপথে ফেটে পড়ে। গণরোষ গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ফলে এরশাদ সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। গণমানুষের বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গণতন্ত্রের শুভ সূচনা হয়।
প্রতিবছর এই দিনে মিলন সম্বন্ধে স্মৃতিচারণামূলক কিছু না কিছু লিখতে হয় আমাকে। মিলনের বিষয়ে লিখতে হলে প্রাসঙ্গিকভাবেই মিলনের রাজনৈতিক চেতনা ও জীবনাদর্শ প্রসঙ্গ চলে আসে। কিশোর বয়স থেকেই মিলন ছিল সমাজসচেতন, স্বাধীন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন দৃঢ় চরিত্রের একজন মানুষ। ১৯৬৯ আর ১৯৭১-এর আন্দোলনমুখর আগুন ঝরানো দিনগুলোর ছোঁয়া মিলনকে স্বদেশের প্রতি বিশ্বস্ত একজন বিপ্লবী দেশপ্রেমী করে তুলেছিল। কৈশোর থেকে ক্রমেই নিজেকে উন্নীত করেছিল দেশের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একজন সংগ্রামী যুবকরূপে। এরপর ওর রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটতে দেখি।
১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর যতগুলো রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছিল, তার প্রতিটিতেই মিলনের অংশগ্রহণ ছিল অবধারিত। ১৯৮২ সালে মজিদ খান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন, ১৯৮৪ সালে সামরিক শাসনের অবসান ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে গণ-আন্দোলন, ১৯৮৬ ও ৮৭-র আন্দোলন নিয়ে মিলন ডায়েরিতে লিখেছিল ‘মুক্তিপাগল মানুষের স্রোত নেমেছে রাজপথে। সেই স্রোত ব্যর্থ হয় ষড়যন্ত্রের নীলনকশায়। ১৯৮৭-তেও ব্যর্থ হয় লাগাতার হরতাল। নূর হোসেনের আত্মদান ব্যর্থ হয়ে যায়। ওই মিছিলে দেখেছি রাজনীতির মুখোশ পরা কিছু মানুষ।’ মনে পড়ে সেই মিছিল থেকে মিলন বাসায় ফিরেছিল পিঠে পুলিশের লাঠিপেটার চিহ্ন নিয়ে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে লালন করে মিলন জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিল। স্বপ্ন দেখেছে, বাংলাদেশ হবে সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বিশ্বাসী একটি রাষ্ট্র, যেখানে শ্রেণিবৈষম্য থাকবে না, বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটবে। তাই জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি চিকিৎসকদের পেশাগত আন্দোলনও সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। তাই তো এরশাদ সরকার প্রণীত গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধাচরণ করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এ সময় ডায়েরিতে লিখেছিল ‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মতো একটি মৌলিক ইস্যুকে কিছুতেই গণবিরোধী সরকারের খেয়াল-খুশির ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না।’ দুঃখজনক হলেও সত্য, দীর্ঘ ২৬ বছর নির্বাচিত সরকারের অধীনে দেশ পরিচালিত হলেও আজও জনগণের কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বারবার গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়েছে সেনাশাসকদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কারণে। সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো ভূলুণ্ঠিত হয়েছে পদে পদে। বারবার আমাদের টগবগে তরুণ সন্তানেরা জীবন বাজি রেখে স্বৈরশাসকের পতন ঘটিয়েছে গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য, মৌলিক অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। আমাদের সন্তানদের রক্তস্রোতে অর্জিত জাতীয় অর্জনগুলো আজও ভূলুণ্ঠিত। বারবার আশাহত সাধারণ মানুষ আজ রাজনীতির প্রতি, রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। তরুণেরা আজ অসুস্থ ও সুবিধাবাদী রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
বর্তমানে দেশ বহুমুখী সমস্যায় নিমজ্জিত। অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে হঠাৎ করেই নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত—এই দুই শ্রেণির মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কিছু অসৎ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করায় সাধারণ মানুষের জীবনে আজ দুর্ভোগ নেমে এসেছে। দেশবাসী যেন ব্যবসায়ীদের হাতে একপ্রকার জিম্মি। প্রশাসনিক কোনো আইন বা নিয়ম এদের বিচলিত করে না। দেশে একটা শ্রেণির কাছে ক্ষমতার লোভ, অর্থের লোভ মানুষের জীবনের চেয়েও বড় বলে মনে হয়। সুবচন আজ নির্বাসিত। দেশে চলছে বিচারহীনতা, দলবাজি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি আর দখলবাজির সংস্কৃতি। শ্রদ্ধেয় প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তাঁর মৃত্যুর আগে এক নিবন্ধে তাই লিখেছিলেন, ‘দেশ আজ বাজিকরের দেশে পরিণত হয়েছে।’ গুম, খুন, নারী ধর্ষণ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞজনদের মতে, প্রশাসনিক দুর্বলতা আর বিচারহীনতার কারণে এই ঘটনাগুলো ঘটা সম্ভব হচ্ছে। সাম্প্রতিক কালের রোহিঙ্গা ইস্যু ‘গোদের ওপর বিষফোড়ার’ মতো জাতির ওপর চেপে বসেছে।
এত সমস্যার পরও বাংলাদেশ আজ বিভিন্ন সূচকে অগ্রগতির কারণে বিশ্বদরবারে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। কিন্তু গণতন্ত্রহীনতার কারণে দেশের এই সম্মান ততটা উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেনি। আমরা জানি গণতন্ত্র মানে কেবল নির্বাচনের অধিকার নয়, গণতন্ত্রের অর্থ অনেক ব্যাপক, যা সমাজকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অনেক ঋদ্ধ করে, আজ দেশে যা অনুপস্থিত। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবে গেছে দেশ।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রস্তুতির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের মনেও উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ আর ঔৎসুক্যের শেষ নেই। আগামী নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হবে, এটাই জনগণের প্রত্যাশা। সমাজের সৎ, বিবেকবান, নৈতিকতাবোধসম্পন্ন মানুষ আগামী নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় হিংসা-বিদ্বেষহীন, সন্ত্রাস, দুর্নীতিবিহীন একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করবে, এটাই জাতির স্বপ্ন। জনজীবনে সার্বিক নিরাপত্তা ফিরে আসুক, এটাই দেশবাসীর কাম্য।
শহীদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই মাতৃভূমি সম্ভাবনার এক অপার দুয়ার খুলে দিয়েছে আমাদের সম্মুখে। অনেকের মতে, আজকের যুবসমাজের মধ্যে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। যুবসমাজ আজ লক্ষ্যভ্রষ্ট, দিগ্ভ্রান্ত। অথচ ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন—সব কটি জাতীয় আন্দোলনের পুরোধায় ছিল ছাত্রসমাজ, যুবসমাজ। আমাদের রাষ্ট্রীয় যা কিছু অর্জন, তা এই তরুণদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে, এ কথা আমরা ভুলে যেতে পারি না।
প্রিয় মাতৃভূমি আজ বিপর্যস্ত। এই মাতৃভূমিকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করে যেতে হবে আমাদের। নবীন-প্রবীণ সব সচেতন বিবেকবান মানুষের মিলিত স্রোতোধারায় এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এ দেশ। তরুণদের উদ্দেশে বলব, ‘এ দেশ তোমার-আমার সবার। ক্ষোভে, অভিমানে মুখ ফিরিয়ে থেকে কালক্ষেপণের সময় নেই আর।’ এখন ‘যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার সময় তার’। মনে রাখতে হবে, শহীদদের স্বপ্ন সার্থক করার দায় আমাদের সবার।
সেলিনা আখতার: শহীদ ডা. মিলনের মা।