চট্টগ্রাম

শহরটিকে তো বাঁচাতে হবে!

শহরের বর্তমান অবস্থা এমনই ভয়াবহ যে, মাত্র ২৫ কিলোমিটার (শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত) যাওয়া-আসার জন্য সবাইকে দিনের প্রায় চার-পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় গর্তযুক্ত ধুলোবালিতে পরিপূর্ণ এবড়োখেবড়ো রাস্তায় ব্যয় করতে হয়। এমনকি শহরের আগ্রাবাদ থেকে জিইসি দুই নম্বর গেট পর্যন্ত আসতেও প্রায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লেগে যায় বেশির ভাগ সময়। আর পুরো রাস্তাতেই লেগে আছে চলমান উড়ালসড়কের লাগাতার কাজ। বছরের পর বছর ধরে এই কাজ চলছে এবং হরহামেশাই নির্মাণসামগ্রী অসাবধানতাবশত নিচে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটছে।

রাস্তার পাশে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে এমন কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান, যেগুলো ধোঁয়া কিংবা কার্বন উৎপন্ন করছে। ডিজাইনিং ঢাকা গ্রন্থের স্থপতি ও গবেষক কাজী খালেদ আশরাফ লিখেছেন, ‘একটি শহরের উন্নতি হয় যখন এর সম্পদের মূল্যায়ন করা হয়।’ সেদিক থেকে বিবেচনা করলে চট্টগ্রামের অপার সম্পদের কথা বোধ হয় সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে সরকার পর্যন্ত আমরা কেউই সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারিনি অথবা চাইনি, আর হয়তো–বা সে কারণেই দিনের পর দিন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি এই সবুজ শহরকে। আর এমনটি ঘটছে অর্থনৈতিক চাপ, গৎবাঁধা সেকেলে নির্মাণ রীতিনীতি, রাজনৈতিক প্রভাব, অব্যবস্থাপনা, সংকীর্ণ মনমানসিকতা এবং তদুপরি ইচ্ছার অভাবে।

সবুজের সমারোহ, পাহাড় ঢাকা আর কর্ণফুলীর চট্টগ্রাম শহরের বায়ুদূষণের মাত্রা দিন দিন অত্যধিক পরিমাণে বেড়েই চ​েলছে এবং আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এই দূষণের মাত্রা স্বাভাবিক দূষণের মাত্রা থেকে প্রায় তিন গুণ বেশি। ফিটনেসবিহীন ও ২৫ বছরের পুরোনো অসংখ্য যানবাহন, যত্রতত্র রাস্তার পাশে গড়ে ওঠা অপরিকল্পিত কলকারখানা থেকে নির্গত হওয়া কালো ধোঁয়া, অতি দ্রুত বাড়তে থাকা আবাসন ও নির্মাণশিল্পের আগ্রাসন, বিভিন্ন উন্নয়নকাজের জন্য যেখানে-সেখানে রাস্তায় গর্ত আর খননকাজ (যা কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার জন্য বছরের পর বছর চলতে থাকে)—এগুলোই হয়ে উঠেছে শহরের পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রধান কারণ।

এই দূষণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একসঙ্গে বেড়ে চলছে পানি ও শব্দদূষণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, এই দূষণের মাত্রা যথেষ্ট উচ্চ পর্যায়ে ও শহরের নাগরিকদের জন্য অতি বিপজ্জনক। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো অতিরিক্ত ধুলোবালির কারণে বিবর্ণ হয়ে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা খুব সকালেও নাকে-মুখে রুমাল চেপে পথ চলছে, রাস্তাঘাটে সুস্থভাবে একটুকু নিশ্বাস নেওয়ার তিল পরিমাণ ফাঁকা জায়গার অস্তিত্ব দিন দিন কমে যাচ্ছে এই শহরটিতে, কি শীত কি গ্রীষ্মে!

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় ১৫ হাজার বাংলাদেশি মৃত্যুবরণ করে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে শুধু বায়ুদূষণের কারণে। সরেজমিনে এমনও দেখা গেছে, শহরের আবাসনগুলোতে আমরা স্থপতিরা যতই প্রাকৃতিক আলো-বাতাস প্রবেশ ও চলাচলের কথা বলি না কেন, অতিরিক্ত ধুলোবালি ও শব্দের কারণে সুবিধা থাকা সত্ত্বেও ৭০-৭৮ শতাংশ শহুরে নাগরিক, বিশেষ করে রাস্তার ধারের বাসিন্দারা তাদের ঘরের দরজা-জানালা দিনের প্রায় সব সময় বন্ধ রাখে, যেন ধুলোবালি ভেতরে ঢুকতে না পারে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অতিরিক্ত ধুলোবালির কারণে পরিচ্ছন্নতার জন্য মাসিক ব্যয় বেড়ে যায় প্রায় এক-চতুর্থাংশ, অনেক সময় যা তাদের সামর্থ্যের বাইরে চলে যায়।

অন্যদিকে ১৯৯৫ সালে প্রণীত চট্টগ্রামের মাস্টারপ্ল্যানের মেয়াদ ২০১৫ সালেই শেষ হয়ে গেছে। আর সেই উন্নয়নের প্ল্যান চাপা পড়ে গেছে চকচকে পৃষ্ঠার মধ্যেই। আলোর মুখ আর দেখা হয়নি, যার সুফল নাগরিকদের অদেখাই থেকে গেল। যেখানে শহরকে টেকসইভাবে গড়ে তোলার ব্যাপারে বেশ কিছু দিকনির্দেশনা ছিল।

শহরের দূষণ নিয়ে কথা হয় স্থাপত্যের গবেষক এবং উদ্ভাবক অধ্যাপক ডা. ফ্রান্সেসকো ফিয়োরিতোর সঙ্গে। তাঁর মতে, আমরা এসব দূষিত শহরের স্থাপনার জন্য বিশেষ কিছু পরিবেশ সহনশীল বাইরের পর্দা (আচ্ছাদন) ব্যবহার করতে পারি, যা বাইরের ধুলোবালিকে পরিশোধন করে ভেতরে প্রবেশ করাবে, অর্থাৎ পর্দাটি একটি ছাঁকনির মতো কাজ করবে, যদিও এমন চিন্তায় পৌঁছাতে আমাদের এখনো বেশ কিছু সময় এবং গবেষণার প্রয়োজন।

এই মুহূর্তে শহরকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ‘আরবান টাইমস’ ছয়টি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছে, যেগুলো বাস্তবায়ন করা আমাদের পক্ষেও সম্ভব। যেগুলোর মধ্যে শহরকেন্দ্রিক হাঁটাচলা এবং সাইকেল রাস্তা, শহরকে বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করে যানবাহন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ ও হাঁটাকে উৎসাহ প্রদান, শহরকেন্দ্রিক চাষাবাদ, নির্মাণ কার্যক্রমের আধুনিকায়ন, পাবলিক পার্ক নির্মাণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ঢাকায় সবুজ পার্ক রক্ষার্থে যেভাবে ‘জল সবুজের ঢাকা’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, চট্টগ্রামেও সেটির কার্যক্রম সময় থাকতেই শুরু করতে হবে। সেই সঙ্গে জনগণকে যেকোনো প্রকারে উদ্বুদ্ধ ও নিয়োজিত করতে হবে নিজের শহরকে বিশুদ্ধ রাখার জন্য। কারণ, ঢাকাকে আমরা প্রায় জীবন-মৃত্যুর শেষ প্রান্তে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি, হাতে গোনা যা কিছু গর্বের আছে আমাদের, চট্টগ্রাম তার অন্যতম, একেও কি আমরা এভাবে শেষ হতে দিতে পারি?

সজল চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম