মতামত

শরীফ উদ্দিনরা কেন চাকরি হারান

মো. শরীফ উদ্দিন
ছবি: সংগৃহীত

‘ফেয়ার ইজ ফাউল অ্যান্ড ফাউল ইজ ফেয়ার’—শোয়া চার শ বছর আগে ম্যাকবেথ নাটকে তিন ডাইনিকে দিয়ে অশুভ জগতের এই মন্ত্র শুনিয়েছিলেন উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ার। সেই ডাকিনীদের কাছে ‘সুন্দরই কুৎসিত, কুৎসিতই সুন্দর’। এর পর সোয়া চার শ বছর কেটেছে। তারপরও আমাদের অনেক তন্ত্রের মতো আমলাতন্ত্রের গ্রন্থিতেও সেই শেক্সপীয়রিয়ান ডাকিনী মন্ত্র ঠিকই মিশে আছে। সেখানে এখনও ‘সুন্দরই কুৎসিত, কুৎসিতই সুন্দর’।

আন্দাজ করি, সেখানে যখনই কোনো সৎ-সাহসী কর্মকর্তা কোনো ‘ফাউলের’ বিরুদ্ধে ‘ফেয়ার’ ব্যবস্থা নিতে যান, তখনই বড় বড় চেয়ারে বসা ময়মুরুব্বীরা রাগ হন। তাঁদের পক্ষ থেকে ওই কর্মকর্তাকে সেই ডাকিনী মন্ত্র শোনানো হয়। তিনি সেই মন্ত্রের মর্মার্থ ধরতে পারেন তো ভালো; না পারলে সোজা ওএসডি নয়তো বরখাস্ত। এটি এখানকার মেলাদিনের রেওয়াজ।

পত্রপত্রিকায় বের হওয়া খবর পড়ে মনে হচ্ছে, সেই রেওয়াজের খপ্পরে পড়েই চাকরি খুইয়েছেন মো. শরীফ উদ্দিন। দুদিন আগেও এই ভদ্রলোক দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপসহকারী পরিচালক ছিলেন। গত বুধবার দুদক তাঁকে চাকরিচ্যুত করেছে। তিনি কী অপরাধ করেছেন, ঠিক কী কারণে তাঁর চাকরি গেল, দুদক তা তাঁকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি। তবে দুদক কারণটা না বললেও ইতিমধ্যেই সবাই মোটামুটি তা জেনে গেছে।

আমাদের মাথায় রাখা দরকার, শরীফ উদ্দিনদের সংখ্যা অতি নগণ্য। অসৎ ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সংখ্যা বেশি হলেও তাঁরা নৈতিকভাবে দুর্বল। শরীফ উদ্দিনদের সততাকে তাঁরা ভয় পান। সেই ভয় থেকেই শরীফ উদ্দিনদের সরিয়ে দেওয়া হয়।

শরীফ উদ্দিন এক সময় চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন। ওই সময় তিনি কক্সবাজারে ৭২টি প্রকল্পে সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি, রোহিঙ্গা নাগরিকদের ২০টি এনআইডি ও পাসপোর্ট জালিয়াতি, কর্ণফুলী গ্যাসে অনিয়মসহ বেশ কিছু দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। বহু লোকের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। এতে তিনি অনেকের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন। সেই ‘অনেকের’ ইশারায় গত বছরের জুনে তাঁকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়েছিল।

তিনি পটুয়াখালীতে বদলি হলেও তাঁর পরিবার চট্টগ্রামের খুলশী এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। তিনি ছুটিতে পটুয়াখালী থেকে চট্টগ্রামে যেতেন। গত ৩০ জানুয়ারি রাতে তিনি খুলশীর বাসায় ছিলেন। ওই সময় দুজন লোক তাঁর বাসায় এসে তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেন। তিনি কীভাবে দুদকে চাকরি করেন তাও তাঁরা দেখে নেবেন বলে জানিয়ে গিয়েছিলেন। সেই দুজন যে ফাঁকা বুলি ছুড়ে যাননি তা ১৬ দিনের মাথায় বোঝা গেল। শরীফ উদ্দিন বরখাস্ত হলেন। হুমকি দাতা দুজনের হুমকির একটি অংশ সত্য হয়েছে। শরীফ উদ্দিনের চাকরি গেছে। এখন বাকিটা সত্য হবে কি না তা নিশ্চয়ই তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।

চাকরি যাওয়ার পর শরীফ উদ্দিন বলেছেন, ‘আমার কিছুই বলার নেই। শুধু এটুকু বলব, আমি মজলুম।’

শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুতির প্রতিবাদে গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছেন তাঁর সহকর্মীরা। তাঁরা বলছেন, শরীফ উদ্দিন সৎ ও সাহসী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। সৎ সাহসের জন্যই আজ তাঁকে চাকরি খোয়াতে হলো।

তাঁর সহকর্মীরা বলেছেন, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এলাকায় বড় প্রকল্প ও সরকারি অফিসে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শরীফ উদ্দিনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সাহসী। তিনি কারও সঙ্গে আপস করেননি। কোনো ধরনের হুমকিতেও নিজের দায়িত্ব থেকে চুল পরিমাণ সরে দাঁড়াননি। তাঁর এই অপসারণ অন্যদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
আমাদের মাথায় রাখা দরকার, শরীফ উদ্দিনদের সংখ্যা অতি নগণ্য। অসৎ ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সংখ্যা বেশি হলেও তাঁরা নৈতিকভাবে দুর্বল। শরীফ উদ্দিনদের সততাকে তাঁরা ভয় পান। সেই ভয় থেকেই শরীফ উদ্দিনদের সরিয়ে দেওয়া হয়।

এর আগে রেলের দুর্নীতিতে হাত দিয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলনকে আমরা ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হতে দেখেছি। জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া ট্রেনের টিকিট কেনা যাবে না—এমন একটি নিয়মের প্রবর্তন করতে যাচ্ছিলেন মাহবুব কবির মিলন। বিশেষ করে রেলের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত সফল হলেও হঠাৎ করে রেল কর্মচারীদের পাস বাতিল করে তা অনলাইন টিকিট সিস্টেমের ঘোষণায় ফুঁসে উঠেছিল রেল কর্মচারীরা। এরপরই তিনি ওএসডি হয়েছিলেন।

রেলে যোগ দেওয়ার আগে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদে থেকে মো. মাহবুব কবির মিলন হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে সর্বত্র ভেজাল খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন বন্ধে জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন। এরপর সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। পরে ওএসডি অবস্থায় অবসরে যান মাহবুব কবির মিলন। অবসরের দিন ফেসবুকে স্ট্যাটাসে দিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘সবাইকে কেনা যায় না, মাথা নত করানো যায় না।’

একইভাবে মনে পড়ছে, ২৭ তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের ২৪০ জনকে (ইকোনমিক ক্যাডার বিলুপ্ত হওয়ায় প্রশাসন ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হওয়া কর্মকর্তাসহ) পদোন্নতি দেওয়া হলেও তিন শতাধিক সফল অভিযান চালানো ও সৎ ও সাহসী কর্মকর্তা হিসেবে দেশবাসীর প্রশংসায় ভাসা র‍্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারোয়ার আলমকে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল।

এসব ঘটনা এমনি এমনি ঘটে না। এর পেছনে সেই ‘অনেকের’ হাত থাকে। এই হাতগুলোই দেশকে এগোতে দেয় না। ক্ষমতার দম্ভে নাগরিকের প্রতি সরকারি কর্মীর দুর্ব্যবহার এবং উদাসীনতার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত আছে। কিন্তু সেই ভূরি ভূরি দৃষ্টান্তের মধ্যে শরীফ উদ্দিনদের মতো কিছু মহৎ মানুষ কিছু বিরল দৃষ্টান্ত রেখে যেতে চান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরা দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। আফসোস!

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
sarfuddin2003@gmail.com