একজন নাগরিকের কাছে ‘শরণার্থী’ পরিচয়টি লজ্জার হলেও জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া একজন মানুষের কাছে শরণার্থী না হতে পারাটাই আফসোসের
একজন নাগরিকের কাছে ‘শরণার্থী’ পরিচয়টি লজ্জার হলেও জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া একজন মানুষের কাছে শরণার্থী না হতে পারাটাই আফসোসের

‘শরণার্থী’ হওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার বটে

সিরিয়ার যুদ্ধ-সংঘাত থেকে পালিয়ে লেবাননে চলে এলেও হানান ও আলী তাঁদের মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে পারেননি। পারেনি সিরিয়ায় বোমার আঘাতে এক পা হারানো আলীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসাটুকু নিতে। চার বছর আগে সুইডেনে পুনর্বাসিত হওয়ার পর জীবনের মৌলিক প্রয়োজনগুলো পূরণের সুযোগ পেয়েছে পরিবারটি। তাঁদের তিন মেয়ে এখন স্কুলে যায়, আলীর কর্মসংস্থান হয়েছে এবং বায়োমেডিকসে অধ্যয়নের পাশাপাশি হানান সহকারী নার্স হিসেবে কাজ করছেন।

জাতিসংঘের শরণার্থী কর্মসূচির ওয়েবসাইটে পরিবারটির হাসিমুখের একটি ছবি দিয়ে এভাবেই তাঁদের জীবনের কথা তুলে ধরা হয়েছে। পৃথিবীর যে শরণার্থীরা পুনর্বাসনের সুযোগ পায়নি এবং আশ্রয়দানকারী দেশে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অপেক্ষায় আছে, তারা এ পরিবারকে বলবে ‘সৌভাগ্যবান’। কিন্তু যারা আশ্রয়দানকারী দেশে শরণার্থী পরিচয়টুকুও পায়নি, তাদের কাছে এ পরিবারের কাহিনি হয়তো কেবল স্বপ্নের মতো। কারণ, পুনর্বাসনের অন্যতম শর্ত ‘শরণার্থী’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া, সেটিই তাদের ভাগ্যে জোটেনি।

একজন নাগরিকের কাছে ‘শরণার্থী’ পরিচয়টি লজ্জার হলেও জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া একজন মানুষের কাছে শরণার্থী না হতে পারাটাই আফসোসের। কারণ, তার অস্তিত্ব বাস্তবে দৃশ্যমান থাকলেও রাষ্ট্রপ্রণীত বিধি-আইন-শুমারি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ দলিলের কোথাও তার অস্তিত্ব নেই। এ কারণে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থান-নিরাপত্তা, এগুলো তার জন্য নয়। ভোটারের তালিকায় নয়, তার নাম থাকে ইয়াবা পাচারকারীর তালিকায় বা পাসপোর্ট জালিয়াতির দায়ে অভিযুক্তের সংবাদে। নিজ রাষ্ট্রে গণহত্যার শিকার হওয়া সত্ত্বেও গণহত্যার যেমন কোনো বিচার হয় না, তেমনি আশ্রয়দাতা রাষ্ট্রে কেন সে শরণার্থী হওয়ার জন্য অযোগ্য, তারও কোনো বিহিত হয় না। কিন্তু রাষ্ট্রকুলের এ–জাতীয় সিদ্ধান্তগুলোর দায় বহন করতে হয় গণহত্যার শিকার হওয়া এই অযোগ্য মানুষগুলোকেই। পৃথিবীতে এমন জনগোষ্ঠী সম্ভবত একটাই—রোহিঙ্গা।

তাদের শরণার্থী বলা যাবে না। তারা এফডিএমএন। জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার মতে, পৃথিবীতে ২০১৭ সালে প্রতি দুই সেকেন্ডে একজন বাস্তুচ্যুত হয়েছে (২০২২ সালে এ সংখ্যা বাড়বে বৈ কমবে না)। বাস্তুচ্যুত এই বিরাটসংখ্যক মানুষ আশ্রয়দাতা দেশে গেলে তাদের পরিচয় হয়েছে শরণার্থী; জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত সিরিয়ার নাগরিক বা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত আফগান নাগরিক কিংবা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ইউক্রেনের নাগরিক নয়। কিন্তু বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এফডিএমএন হয়ে আছে। কোনো সরকারি ডকুমেন্টে তাদের শরণার্থী বলা হয় না। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, দেশে কিংবা দেশের বাইরে বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক শরণার্থী হিসেবে তাদের অভিহিত করায় বাংলাদেশের কোনো আপত্তি নেই। উপরন্তু, রোহিঙ্গাদের দেখভাল করার দায়িত্বে নিয়োজিত যে সরকারি সংস্থা কক্সবাজারে কাজ করে, সেটির নামেও রয়েছে ‘শরণার্থী’ শব্দটি। তবু রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে শরণার্থী নয়।

রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক কারণে সীমান্ত খুলে দেওয়ার দৃষ্টান্তে বাংলাদেশ অনন্য অবস্থানে আছে। কিন্তু তাদের অপরিকল্পিতভাবে আশ্রয় দিয়ে তাদের ও নিজের জন্য সমস্যাকে প্রকটতর করেছে বাংলাদেশ। এ দেশে আশ্রয় নেওয়া প্রতিটি রোহিঙ্গাকে হানান ও আলীর মতো প্রত্যক্ষভাবে প্রকৃত মানবিক সুবিধা দিতে না পারলেও শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এবং পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়ে পরোক্ষভাবে রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিকতার দৃষ্টান্তে বাংলাদেশ আরও একবার অনন্য হতে পারত।

শরণার্থী হওয়াটা জরুরি কেন? শরণার্থী না হওয়াটা যে রোহিঙ্গাদের জন্য শুধু নয়, বাংলাদেশের জন্যও সমস্যা, সেটি এফডিএমএন শব্দটির জনকবৃন্দ এ শব্দ আরোপকালে বুঝতে পারেননি বলেই এহেন উদ্ভট শব্দ প্রয়োগ করেছেন। প্রথমত, ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষর না করলেও বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে প্রতিপালন করে আসছে। উল্লেখ্য, ইউরোপীয় বাস্তবতার আলোকে রচিত ৭২ বছরের পুরোনো কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী না হয়েও কোনো দেশ যে শরণার্থী সামলাতে পারে, তার উদাহরণ বাংলাদেশ। কিন্তু শিক্ষা-স্বাস্থ্য ইত্যাদি মৌলিক অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত রাখা সম্ভব হয়েছে এ কনভেনশনে স্বাক্ষর না করার ফলে। তার চেয়েও বড় যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, তা হলো শরণার্থী না হওয়ায় রোহিঙ্গাদের তৃতীয় কোনো দেশে পুনর্বাসন করার পথ বন্ধ হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া মানে রোহিঙ্গাদের একটা পরিচয় দেওয়া। ইউএনএইচসিআরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বাসরত রোহিঙ্গাদের মোট জনসংখ্যার ৫২ শতাংশ শিশু। আন্তর্জাতিক সংস্থা পরিচালিত কিছু লার্নিং সেন্টার ক্যাম্পের ভেতর যে নামমাত্র শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে, তাতে শিক্ষার উদ্দেশ্যসাধন দূরে থাক, এই শিক্ষা গ্রহণ করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কোনো পথ এই বিপুলসংখ্যক শিশুর জন্য নেই এবং সেটি নিয়ে কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার মাথাব্যথাও নেই। রোহিঙ্গা শিশুদের যেহেতু কোনো পরিচয় নেই, তারা বাংলাদেশের স্কুলে ভর্তির কোনো যোগ্যতা রাখে না। ফলে লার্নিং সেন্টারের যৎসামান্য বর্ণমালা শিক্ষাই তার সম্বল, যা কিছুদিন পর চর্চার অভাবে সে ভুলেও যায়। লেখাপড়া না শিখেই অর্থহীনভাবে অবহেলায় শৈশব-কৈশোর অতিবাহিত করে তারা পৌঁছে যাচ্ছে তারুণ্যে। একসময় ঝুঁকে পড়ে মাদক, সন্ত্রাস এবং বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর কাজে।

তৃতীয়ত, সরকারিভাবে যেহেতু তারা শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নয়, তাই প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর কর্মসূচিও নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। প্রত্যাবাসন যেমন পরিণত হয়েছে অলীক স্বপ্নে, তেমনি কক্সবাজারের স্থানীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে রোহিঙ্গাদের প্রবেশ ঠেকানো হয়েছে অসম্ভব। শরণার্থী হিসেবে তাদের স্বীকার না করায় বাংলাদেশে শরণার্থীবিষয়ক কোনো জাতীয় নীতিও প্রণীত হয়নি। অথচ ‘মিয়ানমারের নাগরিক’ আখ্যা দিলেও ভাসানচরে তাদের স্থানান্তর করা হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে।

পরিহাসের বিষয়, পুনর্বাসন বলতে এখন তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের বদলে ভাসানচরে স্থানান্তরকেই বুঝতে শুরু করেছে মানুষ। শরণার্থী না হওয়া রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের প্রতিবন্ধকতা হলেও ইউএনএইচসিআরের উদ্যোগে ক্ষুদ্র পরিসরে (এবং প্রচারহীনভাবে) পুনর্বাসনের ঘটনার কথা জানা যায় নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে। আর প্রয়াত মুহিবুল্লাহর পরিবারকে (যারা এফডিএমএন ছিল) পুনর্বাসনের কথা তো সবার জানা। কানাডা, জার্মানি, ইউকে, তুরস্ক, লেবানন ইত্যাদি দেশে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শরণার্থী গ্রহণের উদাহরণ টেনে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের বাধা হিসেবে যে ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হয়, তা হলো রোহিঙ্গারা অশিক্ষিত, মুসলিম। তাদের কেউ নেবে না। অথচ রোহিঙ্গাদের এসব দেশে পুনর্বাসনের জন্য যে কূটনৈতিক আলোচনা করা প্রয়োজন ছিল, তা আদৌ করা হয়েছে কি?

২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৩৫৯ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে নিয়েছিল কানাডা। কিন্তু ২০১০ সালের নভেম্বরে আচমকা এ উদ্যোগ বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ। কারণ হিসেবে বলা হয়, পুনর্বাসন চলতে থাকলে আরও রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসতে উৎসাহী হবে। পুনর্বাসন বন্ধ করে দিয়ে ২০১৬-১৭ সালে লাখ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আসা কিন্তু বন্ধ করা যায়নি। ঠিক একইভাবে শরণার্থী পরিচয়ের বদলে এফডিএমএন হিসেবে পরিচয় করিয়ে রোহিঙ্গা সংকটের নিরসন কিন্তু করা যায়নি। শিক্ষার সুযোগ না দিয়ে ঠেকানো যায়নি তাদের নকল জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি করিয়ে বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রক্রিয়া।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের ভূমিকা, অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের রিপোর্ট, গণহত্যার বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের প্রতি গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল দাওদা জালোর জোরালো আহ্বান ইত্যাদিতে বেশ খুশি হয়েছিলেন অনেকে। লক্ষণীয়, এসব উদ্যোগ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সহিংসতাকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে স্বীকৃতি দিলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বা পুনর্বাসনের বিষয়ে কোনো সাড়াশব্দ করেনি। ভূরাজনৈতিক জটিলতা, আঞ্চলিক জোটগুলোর নীরবতা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা ইত্যাদিকে বারবার সামনে টেনে আড়াল করা হচ্ছে বাংলাদেশের কূটনৈতিক দুর্বলতাকে।

রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক কারণে সীমান্ত খুলে দেওয়ার দৃষ্টান্তে বাংলাদেশ অনন্য অবস্থানে আছে। কিন্তু তাদের অপরিকল্পিতভাবে আশ্রয় দিয়ে তাদের ও নিজের জন্য সমস্যাকে প্রকটতর করেছে বাংলাদেশ। এ দেশে আশ্রয় নেওয়া প্রতিটি রোহিঙ্গাকে হানান ও আলীর মতো প্রত্যক্ষভাবে প্রকৃত মানবিক সুবিধা দিতে না পারলেও শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এবং পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়ে পরোক্ষভাবে রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিকতার দৃষ্টান্তে বাংলাদেশ আরও একবার অনন্য হতে পারত। শরণার্থীদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় শরণার্থীনীতি প্রণয়ন করে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের কী কী সুযোগ এখনো গ্রহণ করা যায়, সেদিকে মনোযোগ দিলে বোধ করি বাংলাদেশের (এবং রোহিঙ্গাদেরও) লাভই হবে।

ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা, সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সদস্য, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।