সিরিয়ার মতোই তথাকথিত আরব বসন্তের চোরাবালিতে আটকে যাওয়ার দেশ লিবিয়া। প্রায় এক দশকের গৃহযুদ্ধে গাদ্দাফি-পরবর্তী প্রজন্ম বেড়ে উঠছে সন্ত্রাস আর অনিশ্চয়তার মধ্যে। তাই বেকারত্ব কাটাতে হয় মিলিশিয়া গোষ্ঠীতে, না হয় ইউরোপে নতুন জীবন গড়ার স্বপ্ন নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবে মরছে লিবিয়ার নতুন প্রজন্ম। কিন্তু সব দুর্দশাই পশ্চিমাদের তথাকথিত আরব বসন্তের ছায়ায় ধামাচাপা পড়ছে। সম্প্রতি আঙ্কারা অনেকটা ঘোষণা দিয়েই এই যুদ্ধে শামিল হয়েছে। আল-জাজিরার খবরে প্রকাশ, ত্রিপোলিতে মোতায়েন হয়েছে তুর্কি সৈন্য। নির্দ্বিধায় ত্রিপোলির রাস্তায় তুর্কি সৈন্যের উপস্থিতি ইরানের কাশেম সোলাইমানির হত্যায় সৌদি বলয়ের আনন্দতে বিঘ্ন ঘটাবে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেকের জন্য উদ্বিগ্নের বিষয় ত্রিপোলিতে তুর্কি সৈন্যের উপস্থিতি। উত্তপ্ত উত্তর আফ্রিকার যুদ্ধাবস্থাকে যুদ্ধে রূপান্তরিত করতে পারে যদি এখন খলিফা হাফতার ত্রিপোলি দখলে অগ্রসর হন।
ন্যাটোর অস্ত্রে সজ্জিত বিদ্রোহীদের দ্বারা গাদ্দাফি হত্যা ৪২ বছরের স্বৈরশাসনের ইতি টানলেও রক্তারক্তির ইতি টানতে পারেনি; বরং তা এখন অসুরের রূপ ধারণ করেছে। ইরাকিদের মতোই লিবিয়ার সমাজের একটি অংশ, যারা পশ্চিমা মদদে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিলেন, তারাই আবার গাদ্দাফির জমানায় ফিরে যেতে চায়। ফিরে পেতে চায় রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা ও স্বাভাবিক জীবনযাপন। পশ্চিমারা এভাবেই গণতন্ত্র বিক্রি করে। পুঁজিবাদের মিথ্যা সমতার গল্প আর রঙিন দুনিয়ার লোভ দিয়ে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদী আবেগকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে ওই দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ দখল করে। আশির দশকে চিলি, কলম্বিয়ায় যা হয়েছে, তা এখন হচ্ছে সিরিয়া, লিবিয়া ও ইরাকে। পশ্চিমাদের শত্রুর তালিকায় পরিবর্তন এসেছে। সমাজবাদের পরিবর্তে এসেছে ইসলামি মৌলবাদ।
আক্ষরিক অর্থে লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধের বড় দুই শক্তি খলিফা হাফতার আর জাতিসংঘ-স্বীকৃত জাতীয় ঐকমত্যের সরকার। এই দুইয়ের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই মূলত পশ্চিমা মদদে পরিচালিত মধ্যপ্রাচ্যে প্রধান দুই বলয়ের লড়াইয়ের প্রতিফলন, অনেকটা সিরিয়ার যুদ্ধের মতো। পশ্চিমারা নিজেদের স্বার্থ নিরাপদ রাখতে সময়-সময় মিত্র বদলিয়ে বন্দুকের বাণিজ্য সচল রাখে। জাতিসংঘ, নিরাপত্তা পরিষদ আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমর্থনে জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে লিবিয়ার এক-তৃতীয়াংশ, রাজধানী ত্রিপোলিসহ আশপাশের এলাকা। আর খলিফা হাফতারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা, বেনগাজিসহ তেলসমৃদ্ধ অঞ্চল। হাফতারের সমর্থনে রয়েছেন ট্রাম্পের প্রিয় স্বৈরশাসক মিসরের সিসি, আরব আমিরাতসহ সৌদি বলয় আর ফ্রান্স। তবে বার্তা সংস্থা এএফপি দিয়েছে এক চাঞ্চল্যকর সংবাদ। এএফপি ভাষ্যে, লিবিয়ায় হাফতারের পক্ষে অন্তত ৬০০ থেকে ৮০০ রুশ সৈন্য যুদ্ধ করছে। স্নায়ুযুদ্ধের আদর্শিক বৈরিতা ভুলে গিয়ে সৌদি বলয় আর ফরাসিরা এখন রাশিয়ার সঙ্গে মিলেমিশে লিবিয়ায় হাফতারের পক্ষে কাজ করছে। কেননা, লিবিয়ার তেলসম্পদ আছে তাঁর নিয়ন্ত্রণে।
এই চরম অনিশ্চিত গন্তব্যের যুদ্ধে আঙ্কারার শামিল হওয়ার ঘটনা উত্তর আফ্রিকার বর্তমান রাজনৈতিক চিত্রকে পাল্টে দেবে। তুরস্কের জাতীয় সংসদে তুমুল বিতর্কের মধ্যে ৩২৫- ১৮৪ ভোটে লিবিয়ায় সৈন্য পাঠানোর বিল পাস করিয়ে নেয় এরদোয়ানের একেপি। প্রধান বিরোধী দল সিএইচপিসহ অন্য দলগুলো গতানুগতিক ‘না ভোট’ দিলেও একেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রতাপে তা উড়ে গেছে। লিবিয়ায় সৈন্য পাঠিয়ে এরদোয়ান তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ লিবিয়ার লাগামহীন গৃহযুদ্ধ ও ভৌগোলিক অবস্থান। এ কারণেই লিবিয়ার যুদ্ধ সিরিয়ার যুদ্ধ থেকে সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন। সিরিয়ার যুদ্ধে আঙ্কারা প্রতিবেশী দেশ হিসেবে সুবিধা পেয়েছে। পাশাপাশি তারা মার্কিন ও রাশিয়ার ক্ষমতার লড়াই থেকেও সুবিধা নিয়েছে। মোটাদাগে খানিকটা কূটনৈতিক বিজয় অর্জনও করেছিল, কিন্তু লিবিয়ায় আঙ্কারার সঙ্গে কাতার ব্যতীত কেউ নেই। প্রতিপক্ষের তালিকায় রাশিয়া থেকে শুরু করে সবাই। তাই নিকট ভবিষ্যতে লিবিয়ায় তুর্কি সৈন্যদের যেকোনো ধরনের বিপর্যয়ের দায় এরদোয়ানকেই নিতে হবে। স্থানীয় রাজনীতিতে চুপসে যাওয়া এরদোয়ান সেই দায় ঝেড়ে উঠতে পারবেন কি না, তা আগামীর নির্দয় প্রশ্ন হয়ে থাকল।
ত্রিপোলির মাটিতে তুর্কি সৈন্যের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে মূলত আঙ্কারা এক ঢিলে দুই পাখি শিকারে মেতে উঠেছে। প্রথমত, লিবিয়ার জাতীয় ঐকমত্যের সরকারকে টিকিয়ে রেখে তুর্কি-কাতার বলয় উত্তর আফ্রিকা থেকে নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাবের প্রস্থান থামাতে চায়। এরদোয়ান ভালোভাবেই জানেন, ত্রিপোলি হাফতারের করতলগত হলে তিউনিসিয়া ও আলজেরিয়াকেও সৌদি বলয় থেকে রক্ষা করা যাবে না। অন্যদিকে, সৌদি-মার্কিন-ইসরায়েল বলয় তিউনিসিয়ার বর্তমান সরকারে ইসলামপন্থী আন নাহদার প্রভাব আর আগত আলজেরিয়ার নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডপন্থীদের ভালো করার ইঙ্গিত দেখে হাফতারের মধ্যেই উত্তর আফ্রিকায় নিজেদের স্বার্থ দেখছে।
দ্বিতীয়ত, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে লিবিয়া-তুরস্ক বিশেষ অর্থনৈতিক জোন গঠন চুক্তি বহাল রাখা। গত নভেম্বরে ত্রিপোলিতে জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের সঙ্গে এই চুক্তি হয় আঙ্কারার। খলিফা হাফতারের পক্ষ থেকে এই চুক্তি অস্বীকার করে প্রতিহত করার ঘোষণার এসেছে। নিন্দুকেরা বলেন, লিবিয়ার যুদ্ধ থামাতে নয়, বরং এই চুক্তি বহালের তাগিদেই তুর্কি সৈন্যরা এখন ত্রিপোলিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকেই তুরস্ক-গ্রিস বিবাদ শুরু হয় ভূমধ্যসাগরের তেল-গ্যাসের মালিকানা প্রশ্নে।
সম্প্রতি এই বিবাদে শামিল হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী সব দেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজেদের ভবিষ্যৎ জ্বালানি চাহিদার কথা চিন্তা করে আর ভূমধ্যসাগরতীরবর্তী দেশগুলো গ্রিস ও ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, অনেকটা আঙ্কারাবিরোধী অবস্থান থেকে। গত সপ্তাহে এথেন্সে ইসরায়েল, গ্রিক সাইপ্রাস ও গ্রিস প্রায় সাত বিলিয়ন ডলারের ইস্টমেড গ্যাস পাইপলাইন চুক্তি স্বাক্ষর করে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভূগর্ভস্থ এই গ্যাস পাইপলাইন ভূমধ্যসাগরের তলদেশ ব্যবহার করে ইসরায়েলের গ্যাস নিয়ে যাবে ইউরোপে। কিন্তু লিবিয়া-তুরস্কের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল চুক্তি ইস্টমেড গ্যাস পাইপলাইনকে অকেজো করে দিয়েছে। কোনো ধরনের আলাপ-মীমাংসা ছাড়া আঙ্কারা-ত্রিপোলি তাদের সীমানা ইস্টমেড গ্যাস পাইপলাইনকে ব্যবহার করতে দেবে না, তা পরিষ্কার। এখন ইসরায়েলের জন্য সমাধান কোথায়? সমাধান হলো লিবিয়ার জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের বিলুপ্তি অথবা আঙ্কারার সঙ্গে মীমাংসা। সময়ের সঙ্গে সেই উত্তর মিলবে হয়তো।
লিবিয়ার গৃহযুদ্ধের ফলাফল অন্ততপক্ষে দুটি বিষয়ের পরিষ্কার সমাধান করবে—আগামীর ভূমধ্যসাগরের তেল-গ্যাসের মালিকানা ও তুর্কি-কাতার বলয়ের ভবিষ্যৎ। তুর্কি সৈন্যের উপস্থিতিতে ত্রিপোলিতে জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের টিকে গেলে উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোয় ৫০ বিলিয়ন ডলারের তুর্কি বিনিয়োগ রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ভূমধ্যসাগরের তেল-গ্যাসের মালিকানার আলোচনায় আঙ্কারার অবস্থান শক্তিশালী হবে। একই সঙ্গে সাম্প্রতিক কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত সৌদিবিরোধী জোটের প্রথম সফল অভিযান হতে পারে ত্রিপোলি রক্ষা। নিশ্চিতভাবেই মিসরের সিসি নাকের ডগায় এরদোয়ানের উপস্থিতি সহ্য করবেন না। তাই বিশেষজ্ঞরা তুরস্ক-মিসর হাঙ্গামার আশঙ্কা বাতিল করে দিচ্ছেন না। যদি সেই সম্ভাবনা বাস্তব রূপ ধারণ করে, তাহলে তা আঞ্চলিক যুদ্ধ থেকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধে রূপান্তরিত হতেও পারে।
তবে তার আগে রাশিয়া ও তুরস্কের সমঝোতা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে হবে। উভয় দেশের আহ্বানে বিদ্রোহী জেনারেল হাফতার যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছেন। এখন জাতিসংঘ সমর্থিত সরকার ও জেনারেল হাফতারের বাহিনীকে কীভাবে এক রাজনৈতিক বন্দোবস্তে আনা যায়, সেই লক্ষ্যে আলোচনা চালাচ্ছে দেশ দুটি। ঘটনাটা ইরাকের মতো। সাদ্দামকে হটিয়ে ইরাককে কার্যত ইরানের হাতে তুলে দিল আমেরিকা। আর লিবিয়ায় ন্যাটো গাদ্দাফিকে হত্যা করিয়ে কার্যত রাশিয়া এবং তুরস্ককে ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ করে দেওয়া হলো।
রাহুল আনজুম: লেখক, ইস্তাম্বুলে বসবাসরত।