আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘের এ বছরের প্রতিপাদ্যকে গত বছরের ধারাবাহিকতা হিসেবেই বিবেচনা করতে হচ্ছে। কারণ, ২০১৬ সালে সদস্যরাষ্ট্রসমূহের সমন্বয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত এবং বৈষম্যহীন একটি টেকসই ও উন্নত বিশ্ব গড়ার জন্য ‘প্ল্যানেট ৫০-৫০: স্টেপ ইট আপ ফর জেন্ডার ইকোয়ালিটি’ স্লোগানের মাধ্যমে লিঙ্গসমতা অর্জনের আবশ্যকতা উল্লেখ করা হয়। ২০১৭ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসে একই প্রতিপাদ্য দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সঙ্গে বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়। প্রকৃতপক্ষে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের বিশেষ সভায় সদস্যরাষ্ট্রসমূহ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই বৈশ্বিক উন্নয়ন বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৭টা টেকসই লক্ষ্য নির্ধারণ করে, যা এসডিজি নামে পরিচিত। এই এসডিজির ৫ নম্বর লক্ষ্য হলো লিঙ্গসমতা, যা গুরুত্বের সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে না পারলে বৈশ্বিক টেকসই উন্নয়ন অর্জন সম্ভব হবে না।
স্বাধীনতার সময়ে অতিদরিদ্র দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ পরবর্তী চার দশকে মানবিক ও অর্থনৈতিক সূচকে অভূতপূর্ব অর্জনের কারণে ‘উন্নয়নের বিস্ময়রূপে খ্যাতি লাভ করেছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ থেকেছে এবং বর্তমান ৭ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছেছে, যা বাংলাদেশের শ্রমশক্তির উদ্যম ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনার বিকাশের ইঙ্গিত বহন করে। সেই প্রেক্ষাপটে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশ হবে, এমনটা আশা করা যাচ্ছে। এ দেশের নারীরা নানা প্রকার সামাজিক প্রতিকূলতা ও লৈঙ্গিক বৈষম্যের মধ্যেও মানবিক উন্নয়নে দর্শনীয় অবদান রাখছে। বেগবান নারী আন্দোলন ও নব্বইয়ের দশক থেকে সরকারের কিছু নারীবান্ধব নীতি ও এনজিওগুলোর প্রশংসনীয় নারী সংবেদনশীল কার্যক্রমের ফলে, বিশেষত গ্রামীণ নারীদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ সৃষ্টি হয়। ক্ষুদ্রঋণের সুচারু ব্যবহারের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাস, নারীশিক্ষার প্রসার, নারীর প্রজনন হারের ব্যাপক হ্রাস, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু হ্রাস, পুরুষের তুলনায় নারীর প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি ইত্যাদি মানবিক উন্নয়নের সূচকে ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের পটভূমি সৃষ্টি হয় এবং ফলে এমডিজি অর্জনে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ বিশেষ অগ্রগামী বিবেচিত হয়। সেই ধারাবাহিকতায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন বর্তমানেও আশাব্যঞ্জক।
এই প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিডব্লিউসি এক গবেষণায় বলেছে, ২০৫০ সালে টেকসই উন্নয়নে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে শীর্ষ তিনটি দেশের একটি হবে এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের মানবিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাকে বিশ্ব অর্থনীতি যে ইতিবাচক দৃষ্টি নিয়ে মূল্যায়ন করেছে, তা টেকসই করতে হলে ২০২০ সালের মধ্যে এসজিডির ৫ নম্বর লক্ষ্য পূরণের পথে আমাদের এগোতে হবে দুর্দমনীয় ও সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে। সংবিধানে উল্লেখিত পুরুষের মতো সমান অধিকার জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীর জন্য নিশ্চিত করতে হবে। নারীর প্রতি বিরাজমান সব বৈষম্য বিলোপ করতে জাতিসংঘ সিডও সনদের প্রয়োগ সরকারের দায়বদ্ধতা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। ‘উন্নয়নের বিস্ময়’ বাংলাদেশে ব্যাপক বাল্যবিবাহ ও নারী নির্যাতনের যে নেতিবাচক রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে, সরকার ও সুশীল সমাজের সাহসী উদ্যোগে তা অচিরে নিরসন করতে হবে। কন্যাশিশু ও নারীর জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে জেন্ডার গ্যাপ দর্শনীয় হারে কমাতে হবে।
দেশকে উদার গণতান্ত্রিক ও ক্ষমতাভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে দীর্ঘ পথপরিক্রমায় চার দশকে নারী দেশের নানা অর্জনে তার অবদানের তালিকা দীর্ঘ করেছে। ২০১৭ সালে এসে নারী তার অবদান, প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার খতিয়ানে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে তার সম-অধিকার আদায়ের সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত। এর জন্য প্রথমে প্রয়োজন সর্বস্তরে নারীর অবস্থা ও মর্যাদার মূল্যায়ন এবং লিঙ্গবৈষম্যকে জাতীয় উন্নয়নের মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিতকরণ। নারীর ব্যক্তিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনি সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার প্রাপ্যতাকে নিশ্চিত করে মজুরিবৈষম্য নিরসন করতে হবে। নারীকে তার সব অধিকার দাবি করতে এবং নিজের জীবন নিয়ন্ত্রণে সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
আমাদের এক বিরাট সম্পদ দেশের বৃহৎ তরুণ শক্তি। বছরে প্রায় ২০ লাখ তরুণ কর্মসংস্থানের জন্য শ্রমবাজারে প্রবেশ করেন। এর মধ্যে অর্ধেক নারী। এই তরুণ গোষ্ঠীকে এসডিজির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেই কেবল টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত লিঙ্গসমতা স্থাপনের মাধ্যমে সুবৃহৎ কর্মবাজার সৃষ্টি সম্ভব, যা অবশেষে দারিদ্র্য বিলোপ, সুস্বাস্থ্য, মানসম্মত শিক্ষা আর বৈষম্য নিরসনের মাধ্যমে বিশ্বকে ইতিবাচকরূপে পরিবর্তন করতে পারে।
পারস্পরিক মর্যাদার ভিত্তিতে লিঙ্গসমতা স্থাপিত হলে নারীর মুক্তি ঘটবে। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় সুসংহত সংগ্রামের মাধ্যমে নারী তার প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসন করে তার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশ এসডিজির লক্ষ্যপূরণে সঠিকভাবে এগিয়ে গেলে এবং লিঙ্গসমতার পথে দুর্দমনীয় ও সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোলে ২০৩০ সালে নতুন বিশ্ব রূপান্তরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ হবে অগ্রদূত।
সালমা খান: অর্থনীতিবিদ, নারীনেত্রী।