লকডাউন ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই

করোনার বিস্তার ঠেকাতে বাংলাদেশে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি চলছে। অনেক জায়গায় করা হয়েছে লকডাউন। প্রথম আলো ফাইল ছবি
করোনার বিস্তার ঠেকাতে বাংলাদেশে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি চলছে। অনেক জায়গায় করা হয়েছে লকডাউন। প্রথম আলো ফাইল ছবি

লকডাউনে শ্রমজীবী প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। অনাহার-অর্ধাহারে কাটছে তাঁদের দিন। নিম্নমধ্যবিত্তরাও অনেক কষ্টে আছে। তাদের সঞ্চয় নেই, এ মুহূর্তে আয় বন্ধ।

লকডাউন শিথিল বা প্রত্যাহারের মাধ্যমে অর্থনীতি আবার চালু করা বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে। সংক্রমণসংক্রান্ত তথ্যের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও নিঃসন্দেহে বলা যায়, লকডাউনের কারণেই সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কম।

করোনার বিরুদ্ধে কৌশল আছে
সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি বোঝার একটি উপায় হলো, ভাইরাসের প্রজনন হার, অর্থাৎ একজন সংক্রমিত হলে তিনি কজনকে সংক্রমিত করবেন, তা জানা। যখন ভাইরাসের প্রজনন হার সহগের মান ১-এর চেয়ে বেশি হয়, তখন সংক্রমণ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। সহগের মান ১-এর চেয়ে কম হলে সংক্রমণ ধীরগতিতে হয় এবং তা কমতে কমতে একসময় শেষ হয়ে যায়। এটি Flattening the Curve বা ‘বক্ররেখাকে সমতল করা’ জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কৌশলটিরই পরিপূরক। মহামারি সংক্রমণের গতি রোধ করে রোগীর সংখ্যা কমিয়ে এনে আক্রান্ত রোগী ও চিকিৎসাপ্রার্থীর সংখ্যা স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনা সক্ষমতার মধ্যে ধরে রাখাই এই কৌশলের লক্ষ্য।

নভেল করোনাভাইরাসের প্রজনন হারের মান ২ দশমিক ৩৭৯-এর কাছাকাছি। সাধারণ সর্দি-কাশির সংক্রমণের হার ১ দশমিক ৩। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রজনন হারের মান ২ থেকেও বেশি। এই ভাইরাস সাধারণ সর্দি-কাশির তুলনায় দ্বিগুণ মাত্রায় জ্যামিতিক হারে সংক্রমিত হতে পারে। অর্থাৎ খুব অল্প সময়ের মধ্যে রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি বৃদ্ধি পায়। ঘনবসতিপূর্ণ দেশের জন্য মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। এই পরিণতি থেকে রক্ষার উপায়ও গাণিতিকভাবে বের করা সম্ভব।

ভাইরাসের প্রজনন মাত্রা অন্যান্য সূচকের সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত: এক্সপোজার রেট বা সুস্থ ব্যক্তির ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার হার, আক্রান্তদের আইসোলেশনের হার, আইসোলেশন ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির রোগমুক্তির হার, সাধারণ মৃত্যুর হার এবং ভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যুর হার। এসব সূচকের মধ্যে এক্সপোজার রেট এবং আক্রান্ত ব্যক্তির আইসোলেশনের রেটের প্রভাব ভাইরাসের প্রজনন মাত্রার ওপর সবচেয়ে বেশি। ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার হারের সঙ্গে প্রজনন হারের মান সমান অনুপাতে পরিবর্তিত হয়। আর আইসোলেশনের হারের সঙ্গে ভাইরাসের প্রজনন মাত্রা বিপরীত অনুপাতে পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ ভাইরাসের সংস্পর্শে মানুষ যত বেশি যাবে, প্রজনন মাত্রা তত বাড়বে। উল্টোদিকে, আইসোলেশন বাড়াতে পারলে প্রজনন মাত্রা কমবে হ্রাস ।

ভাইরাসের প্রজননহার ১ এর নিচে নামানো
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উল্লিখিত মানগুলো ঠিক কীভাবে ও কী মাত্রায় কমালে বা বাড়ালে ভাইরাস প্রজনন মাত্রার মান ১ থেকে নিচে নেমে আসবে এবং করোনাভাইরাস অতিমারি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য ১১ মে পর্যন্ত সংগৃহীত সরকারি তথ্য থেকে গাণিতিকভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এক্সপোজার রেট বা ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার হার প্রতিদিন হাজারে আনুমানিক ৩ হতে ৪-এর কাছাকাছি। অর্থাৎ প্রতিদিন এক হাজার মানুষের মধ্যে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ জন ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছে। এই মান ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কমিয়ে ১ দশমিক ৬-এর কাছাকাছি আনা সম্ভব হলে প্রজনন অনুপাতের মান ২ দশমিক ৩৭৯ থেকে নামিয়ে শূন্য দশমিক ৮৯৯-এ, অর্থাৎ ১–এর নিচে নামিয়ে আনা। এটা শুধু তখনই সম্ভব, যখন সুস্থ মানুষকে ভাইরাসে সংক্রমিত মানুষের থেকে দূরে রাখা যাবে। কিন্তু কে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটাবে, তা আপাতদৃষ্টিতে বুঝে ওঠা কঠিন। কারণ, সব সংক্রমিত ব্যক্তির উপসর্গ দেখা দেয় না ৭ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত। কিন্তু এই সময়ে তাদের সংস্পর্শে সুস্থ মানুষেরা সংক্রমিত হতে পারে।এই সমস্যা সমাধানের উপায় প্রত্যেক মানুষের মধ্যে শারিরীক দূরত্ব সৃষ্টি করা; পরস্পরের সংস্পর্শ এড়ানো।

‘শারীরিক দূরত্ব’ সৃষ্টির পাশাপাশি আক্রান্ত ব্যক্তির আইসোলেশনের মাত্রা বাড়াতে হবে। বর্তমানে আইসোলেশনের হার প্রতি হাজারে ও প্রতিদিন ১ দশমিক ৩৪৫। এটা বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ বা তার বেশি করা সম্ভব হলে প্রজনন হারের মান ১-এর নিচে নেমে আসবে।

লকডাউন ছাড়া বিকল্প নেই
সুতরাং এটা স্পষ্ট, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় লকডাউনের ভূমিকা কেন এতটা গুরুত্বপূর্ণ। গাণিতিকভাবে দেখা যায়, ৫০ দিনের কঠোর লকডাউনে এ রকম পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশে কঠোর লকডাউন বাস্তবায়িত হয়নি; অনেকেই মেনে চলেনি। ফলে সংক্রমণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি।

সব তথ্য বিবেচনায় নিয়ে সংক্রমণের হার সময়ের সাপেক্ষে পর্যালোচনা করে গাণিতিক বিশ্লেষণে বলা যায়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং অতি মাত্রার সংক্রমণ এড়াতে আরও ৩০ থেকে ৪০ দিনের লকডাউন প্রয়োজন।

জীবন ও জিবীকার মধ্যে ভারসাম্য আনা সম্ভব
দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ যেমন জরুরি, তেমনই লকডাউন শিথিল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জীবন ও জীবিকাকে বিপরীত অবস্থানে দাঁড় করানোর প্রয়োজন নেই। দুটোকেই গুরুত্ব দিয়ে শিথিলকরণের একটি সমন্বিত কৌশল অবলম্বন করা উচিত। পর্যায় ও ক্রমভিত্তিতে জীবন ও জীবিকার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে লকডাউন শিথিলকরণের শর্তযুক্ত নির্দেশিকা তৈরি করতে হবে এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। জীবনের চেয়ে জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে লকডাউন শিথিল করলে জীবন ও জীবিকা দুটোর ওপরেই বিরূপ প্রভাব পড়বে এবং সংক্রমণের বিস্তৃতি ঘটবে।

তৃতীয়ত, ধাপে ধাপে খাত, অঞ্চল ও নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য লকডাউন শিথিল করার ঝুঁকি হ্রাস-সংক্রান্ত সূচক নির্ধারণ করতে হবে। এর আলোকেই লকডাউন শিথিল করতে হবে। এখানে দরকারি শর্ত হলো ডায়াগনস্টিক এবং সারভেলেন্স পরীক্ষা, ট্র্যাকিং এবং সংক্রমণ ট্রেসিংয়ের সক্ষমতা বহু বহু গুণ বাড়াতে হবে। এই সক্ষমতা এখনো অনেক কম। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অংশীজনদের নিয়ে আলোচনা–পরামর্শ জারি রাখতে হবে।

চতুর্থত, মনে রাখতে হবে, লকডাউন শিথিল করা হলে অল্প আয়ের মানুষেরা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে উপার্জন করতে পারবেন না। মানুষ এখন ক্ষুধার্ত, রোজগারহীন ও রাষ্ট্র কর্তৃক প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক সুরক্ষার অভাবে অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি। তাই জরুরি ভিত্তিতে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ছয় মাসের সর্বজনীন প্রাথমিক আয় অনুদানের ব্যবস্থা করতে হবে। এর পরিমাণ এমন হতে হবে যাতে আরও দরিদ্র মানুষ বেড়ে না যায়। আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমা (১ দশমিক ৯০ ডলার) অনুসারে মাথাপিছু প্রতিদিন প্রয়োজন ১৬১ দশমিক ৫ টাকা। অর্থাৎ মাথাপিছু মাসে ৪ হাজার ৮৪৫ টাকা। পরিবারের সদস্যসংখ্যা খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী ৪ দশমিক ৬ জন হলে প্রতিদিন একটি পরিবারের প্রয়োজন ৭৪২ দশমিক ৯ টাকা। পরিবারপ্রতি মাসে প্রয়োজন ২২ হাজার ২৮৭ টাকা।

নানা শ্রেণির পিছিয়ে পড়া মানুষের এখন আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় ব্যাংক হিসাব রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে এমন হিসাবের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৫ লাখ ২০ হাজার ১৩৪। এসব হিসাব হতে পারে নগদ সহায়তা প্রেরণের মাধ্যম। সহজেই নগদ সহায়তা প্রান্তিক মানুষের কাছে সরাসরি পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। যাঁদের নেই তাঁরা জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে ব্যাংক হিসাব খুলবেন।

এ অতিমারি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে রাষ্ট্র কর্তৃক সর্বজনীন মৌলিক প্রয়োজনীয়তা প্রদানের বিকল্প নেই। সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি তথা আয় সহায়তা, বেকার ভাতা, শিশু প্রতিপালন ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, অবসর ভাতা, আবাসন সহায়তা, স্বাস্থ্যভাতা প্রদানের আর্থিক সামর্থ্য বাংলাদেশের আছে।

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারপারসন, উন্নয়ন অন্বেষণ।
rt@du.ac.bd

জান্নাতুন ইরানা ইরা: গণিতবিষয়ক গবেষক