আবরার হত্যাকাণ্ডের মূলে আছে ভিন্নমত প্রকাশ করতে না দেওয়ার এক ভয়াবহ দমবন্ধ পরিবেশ। এই ভয় এখন সর্বত্র বিরাজমান। এটা শাসকেরা নানান দেশে তৈরি করতে তাদের স্টিমরোলার চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশেও কেউ কিছু বলার আগে সাতবার ভাবে। ভাই বোনকে বলে, ‘এই, স্ট্যাটাস দিস না।’ মানুষ একা একা কথা বলেও পেছন ফিরে তাকায়। কেউ শুনে ফেলল না তো! দেশে বহু ব্লগ বন্ধ কেন? কোনো ব্লগে কেউ ক্ষতিকর বেআইনি কথা বলে ফেলতেই পারে, তাহলে সেই নির্দিষ্ট লেখা এবং লেখকের বিরুদ্ধে আইনসম্মত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু গোটা ব্লগই কেন বন্ধ থাকবে? সৈয়দ শামসুল হক লিখেছিলেন: এসো ছিনিয়ে নিই আমাদের স্বাধীনতা, কথা বলবার স্বাধীনতা, অক্ষরের ডান পাশে অক্ষর বসিয়ে শব্দগুলো তৈরি করবার স্বাধীনতা!
২.
বুয়েটে এবং আমাদের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছে নিপীড়নতন্ত্র। বড় ভাইয়েরা চড়-চাপড় মারে, স্ট্যাম্প দিয়ে পেটায়, গণরুমে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করে, গেস্টরুমে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করে। যে প্রতিষ্ঠানগুলোয় রাজনীতি আছে, সেখানে রাজনীতির বড় ভাই এবং তাদের চ্যালাচামুণ্ডারা তা করে, যেখানে রাজনীতি নেই, সেখানে করে সিনিয়ররা।
সমস্যা যতটা না ছাত্ররাজনীতির, তার চেয়েও বেশি হচ্ছে রাজনীতিতে ভারসাম্য না থাকা এবং গণতান্ত্রিক সহাবস্থান না থাকা। আমাদের কালে সব ছাত্রসংগঠন নবীনদের ফুল দিয়ে, উপহার দিয়ে বরণ করে নিত; কে কার চেয়ে মধুর ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের চিত্ত জয় করতে পারবে, তার প্রতিযোগিতা হতো। ছাত্ররাজনীতি থেকে আদর্শ গেল চলে, টেন্ডারবাজি-মাস্তানি-চাঁদাবাজি এসে আদর্শের জায়গা নিয়ে নিল। এখন আছে ক্যাডার, পেটোয়া বাহিনী, নিপীড়নযন্ত্র। তবে আশি ও নব্বইয়ের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায়ই গোলাগুলি হতো, বোমাবাজি হতো। বহু ছাত্র গুলিতে-বোমায় মারা গেছে। এখন অন্তত সেই গোলাগুলির শব্দ শুনতে হয় না।
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে। সে দাবি মেনে নিন। বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করুন। তার বদলে খেলাধুলা, সংস্কৃতিচর্চা, নাট্যচর্চা, সংগীত, বিতর্ক, বইপড়া, পরিবেশ ক্লাব, বিজ্ঞান ক্লাব ধরনের কার্যক্রমের বন্যা বইয়ে দিন। সে জন্য ইউকসুর মতো নির্বাচিত ছাত্র সংসদ লাগবে। দলীয় রাজনীতির বাইরে আমরা কি তা হতে দেব?
৩.
ক্ষমতাশ্রয়ী ছাত্ররাজনীতি আজ কলুষিততম জায়গায় চলে গেছে। ছাত্রনেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজের বাজেট থেকে কোটি টাকার বখরা চায়। ছাত্রসংগঠনের শাখা কমিটির পদে নিয়োগের জন্য লাখ লাখ টাকা চায়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের অংশ হিসেবে একটা আগাপাছতলা শুদ্ধি অভিযান দরকার।
৪.
বুয়েটে আবরারকে মারা হয়েছে, আবরার মারা গেছে বলে আজকে আমাদের হুঁশ হয়েছে। কিন্তু দেশের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই ধরনের নির্যাতন চলছেই এবং এটা শুধু যেখানে রাজনীতি আছে সেখানে হচ্ছে না, যেখানে রাজনীতি নিষিদ্ধ সেখানেও হচ্ছে।
ইত্তেফাক-এ ১৬ মে ২০১৭ মোহাম্মদ অঙ্কন লিখেছিলেন:
‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে র্যাগিং সংস্কৃতিটা দেশের সবচেয়ে মেধাবীরাই অনুশীলন করে। এটাকে তারা “মজা”, “আদবকায়দা শেখানো”, “বাস্তব পৃথিবীর জন্য তৈরি করা” ও “সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্কোন্নয়ন” ইত্যাদি নামে প্রচার করে। এসবের নামে নবীন শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক সব রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের পরিচয় মুখস্থ রাখা, পিতা-মাতা ও পরিবারের অন্যদের জড়িয়ে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার, সবার সামনে পুরোপুরি নগ্ন করে নাচানো, সবার সম্মুখে চরম অশ্লীল বই পড়তে বাধ্য করা, সবার সামনে যৌন অভিনয়ে বাধ্য করা, পেস্ট খেতে বাধ্য করা, সবার সামনে পর্নো দৃশ্য দেখতে বাধ্য করা, রাতে মশার কামড় খাওয়ানোর জন্য বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা, কান ধরে ওঠবস, বুকডন, মুরগি হয়ে বসিয়ে রাখা, প্রকাশ্যে কোনো মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে বাধ্য করা, শীতের মধ্যে পানিতে নামানো ও ফুটবল খেলতে বাধ্য করা, শীতের রাতে সিনিয়রদের কাজে বাইরে পাঠানো, সিগারেট-গাঁজা-মদপানে বাধ্য করা, ম্যাচের কাঠি দিয়ে রুম-মাঠের মাপ নেওয়া, কোনো আদেশ না মানলে গায়ে হাত তোলা ছাড়াও কথার মারপ্যাঁচে বিব্রত করা হয়।’
প্রিয়ডটকমে ২০১৩ সালের ৩০ জানুয়ারির একটা লেখায় পাচ্ছি:
জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে আমার এক বোন (কাজিন) আজ প্রথম ক্লাস করতে গেছে, আইটি ডিপার্টমেন্টে, ফার্স্ট ইয়ার। ভাই! বোনটা আমার সারা দিন কাঁদল, কাঁদল আমার খালা...কিছুই করতে পারলাম না ভাই! ও জাহানারা হলে থাকে। ওর ডিপার্টমেন্টের বড় আপুরা ওকে ডেকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে লাঞ্ছিত করে আধমরা করে দিয়েছে। ওর বড় আপুরা ওকে বলেছে, ‘ক্লাসের বড় ভাইদের কাছে গিয়ে তোমার...মাপ দিয়ে আসো...’
কম্পিউটার সায়েন্সে উচ্চশিক্ষা নিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন মিজানুর রহমান। কিন্তু তাঁর কম্পিউটার বিষয়ে প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন প্রথম বর্ষেই ভেঙে গেছে। ফেব্রুয়ারিতে নিজ বিভাগের সিনিয়র শিক্ষার্থীর দ্বারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে হাজারো আশা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো রিকশাচালক বাবাকেই চিনতে পারেননি তিনি। শেষে শিক্ষা কার্যক্রম বাদ দিয়ে বাড়িতে ফিরতে হয়েছে মিজানুরকে। (মানবজমিন, ৩ এপ্রিল ২০১৮) এর আগে জানুয়ারিতে র্যাগিংয়ের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়রদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ত্যাগ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। ওই মাসেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ভর্তি হওয়া এক শিক্ষার্থীকে র্যাগ করা নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে। এখানেই শেষ নয়।
বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের এক প্রাক্তন ছাত্রী তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমার জীবনের প্রথম র্যাগিংয়ের অভিজ্ঞতা বুয়েটে। প্রথমে চার ঘণ্টা একটা জানালাহীন ঘরে তালা দিয়ে আটকে রাখা। তারপর মেয়েরা কাঠের এবং ছেলেরা লোহার টুল মাথায় নিয়ে একতলা থেকে চারতলা ওঠা আর নামা।
তারপর?
চার হাত-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে একটি স্টুডিও বা ক্লাসঘরে ঢুকতে বাধ্য হওয়া, হামাগুড়ি দিয়ে ছাড়া যেন ঢোকা না যায়, সে জন্য বড় বড় লোহার টেবিল দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে দরজার মুখটা। প্রত্যেকে চার পায়ে ঢুকবে, টেবিলের তলা দিয়ে। টেবিলের ওপর উৎসাহী ভাইয়ারা ময়দা, ডিম, নীলের গুঁড়ো, মুরগি-খাসি-গরুর হাড়, চকের গুঁড়ো নিয়ে অপেক্ষা করছে। যে যে ঢুকবে তার মাথা এবং শরীরে মাখিয়ে দেওয়া হবে। র্যাগিংয়ের আগে কোনো মেয়ে যেন বড় গলার কামিজ পরে না আসে, সে বিষয়ে কেন আগেভাগেই আপারা জানিয়ে দিয়েছিল, সেটা বুঝতে বুঝতে...এক ক্লাসবোঝাই সিনিয়রদের সামনে দাঁড়ানো। কেউ কিছু করতে অস্বীকার করলে অকথ্য গালি আর চড়-থাপ্পড়ও আছে, আছে গায়ে-মাথায় ঢিল মারা।
এরপর যা যা আমাদের করতে বলা হলো, লিখতে বলা হলো, বলতে বলা হলো আর আমাদের ডাকা হলো আর বলা হলো, সেই গল্প আরেক দিনের। সবচেয়ে সাধারণ গল্পটাই একটু বলা যেতে পারে। আমার এক সহপাঠিনীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “এই তুই খালি না ভরা?”
সে মিনমিন করে বলেছিল, “খালি”।
আর হইহই করতে করতে ছেলেরা বলেছিল, “তুই খালি থাকলেই কী, ভরা থাকলেই কী!”
আমার সেই বন্ধু যাকে বলে “দেখতে ভালো নয়”, সে যে মাথা নিচু করে তিক্ত চোখের পানি ফেলেছিল, তা আমি কখনো ভুলব না।’
তবে যেখানে ছাত্ররাজনীতি নেই, সেসব প্রতিষ্ঠানেও র্যাগিং হয়। যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে শিক্ষার্থীরা দেশসেবক, আইন রক্ষাকারী, নিরাপত্তা রক্ষাকারী হবে বলে আশা করি, সেসবেও হয়। এবং যাঁরা এই লেখা পড়ছেন, তাঁদের অনেকেরই এটা জানা। অনেকেই এই অমানবিকতার শিকার নিজে হয়েছেন, কেউ কেউ আবার সিনিয়র হয়ে নিজেরা নিপীড়ন করেছেন। আমরা যাঁরা আজ প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছি, আমাদের কেউ কেউ কি জুনিয়র ছেলেমেয়েদের/ক্ষমতাহীন ছেলেমেয়েদের নিজেরাই নিপীড়ন করিনি, হয়রানি করিনি, র্যাগিং করিনি?
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সব ক্যাম্পাসে অভিযান চালানো হবে। অভিযান চলুক।
কিন্তু ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের অপমান, আঘাত, যৌন হয়রানি করবে একই প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতাধর, মস্তান, সংগঠিত, সিনিয়র শিক্ষার্থীরাই আর তা দমন করতে যাবে পুলিশ?
আমাদের লজ্জা হয় না?
৫.
আমরা লীগের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাস্তানি, খুনোখুনির অবসান চাই। আমরা দলের বা শিবিরের গোলাগুলি, বোমাবাজি, হাত কাটার দিনগুলোয় ফিরে যেতে চাই না।
আমরা টর্চার সেল, গেস্টরুম অত্যাচার, গণরুম অত্যাচারের যুগের অবসান চাই।
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক