মিয়ানমারে দৃশ্যত একটি বেসামরিক সরকার থাকলেও প্রায় স্বচ্ছ পর্দার আড়ালে প্রকৃত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল সেনাবাহিনীর হাতে। সরকার প্রধান অং সান সু চিও বরাবর তাদের তোয়াজ করেই চলেছেন। এরপরও মিয়ানমারে কেন সেনা অভ্যুত্থান হলো, তা নিয়ে বিভিন্ন মতামত আছে।
বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি দুটি কারণ চিহ্নিত করেছেন এর পেছনে। দীর্ঘ সংগ্রাম এবং সবশেষে সমঝোতার পর ২০১৫ সালে সু চির দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। সেনাপতিরা ভেবেছিলেন এ জোয়ার ক্রমে কমে আসবে এবং জাতীয় সংসদের ওপর তাঁদের নিয়ন্ত্রণ বাড়বে। ২০২০-এর নির্বাচনে হয়েছে এর উল্টোটা। সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। আর সেনাসমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) পেয়েছে আগের চেয়ে আরও কম আসন। ফলে শঙ্কা দেখা দিয়েছে যে দীর্ঘকাল ধরে এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের ওপর সেনাবাহিনীর যে সর্বময় কর্তৃত্ব, তা দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
দ্বিতীয় কারণটি সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংকে নিয়ে। সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এই ব্যক্তি অবসরে যাচ্ছেন শিগগিরই। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে অভিযুক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাও আছে। ক্ষমতার ছাতা সরে গেলে তিনি বিপদের সম্মুখীন হতে পারেন। তাঁর খায়েশ ছিল রাষ্ট্রপতি হওয়া, যাতে একদিকে ক্ষমতা, অন্যদিকে সার্বভৌম দায়মুক্তি দুটোই থাকে। শোনা যায় সু চি নাকি তাতে সম্মত হননি।
সামরিক অভ্যুত্থান এবং সু চিকে কারাবন্দী করায় নিন্দার ঢেউ উঠেছে পশ্চিমা বিশ্বজুড়ে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন অংশীদারদের সঙ্গে নিয়ে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার’ এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন। দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনার কথাও বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ক্যুর নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে মুক্তি চেয়েছে সু চির। জাপান মিয়ানমারে গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থনের কথা জানিয়ে সু চির মুক্তি দাবি করেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব এ অভ্যুত্থানের নিন্দা করে একে ব্যর্থ করে দিতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি।
চীনের প্রতিক্রিয়া ছিল পশ্চিমের সম্পূর্ণ বিপরীত। চীন এটিকে সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে গণ্যই করেনি। তাদের মতে, এটি একটি মন্ত্রিসভার রদবদল! পরিস্থিতি মোকাবিলায় চীন যে সামরিক জান্তার পক্ষে শক্তভাবে থাকবে, এটি খুবই স্পষ্ট। আর তার প্রমাণও মিলল খুব তাড়াতাড়ি। মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি সভা বসে ২ ফেব্রুয়ারি। এ-সংক্রান্ত খসড়া ঘোষণা নাকচ হয়ে যায় চীনা ভেটোর কারণে।
অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে কি বড় কোনো পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে? আগের মতো চীন আছে শক্তভাবে মিয়ানমারের পাশে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শক্তি ও প্রভাব বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে মিয়ানমারকে প্রয়োজন চীনের। অপর বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতও মিয়ানমারে ‘গণতন্ত্র’ সমুন্নত রাখার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি করোনা মহামারি মোকাবিলায় সেখানে মানবিক সাহায্য পাঠানোর ঘোষণাও দিয়েছে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। এ সম্পর্ক ভারত নষ্ট করতে চাইবে না। মিয়ানমারের ভূরাজনৈতিক সুবিধা তাই একটুও হ্রাস পাচ্ছে না। পশ্চিম যদি কিছু নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করে, সামরিক জান্তা সে বাধা পেরিয়ে টিকে থাকতে পারবে।
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের ব্যাপারে বাংলাদেশ সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেসনোটে সেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং সাংবিধানিক ব্যবস্থা চলমান থাকবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে সে দেশের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের বর্তমান মূল ইস্যু রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। এ অভ্যুত্থান সে প্রক্রিয়ায় কী প্রভাব ফেলবে, সেটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে বিভিন্নমুখী চিন্তাভাবনা আছে বিশেষজ্ঞদের। আলোচনার টেবিলে যদিও মিয়ানমারের বেসামরিক সরকারের প্রতিনিধিরাই বসছিলেন, ঘুড়ির নাটাই যে সেনা কর্মকর্তাদের হাতে ছিল, তাতে সন্দেহ নেই কারও। পর্দা সরে যাওয়ায় প্রকৃত ক্ষমতার সঙ্গে এখন আলোচনা হবে, এটাকে তাই অনেকে মন্দের ভালো বলছেন। আশাবাদী কারও কারও মতে, সু চিকে অপসারণের ফলে বিশ্বব্যাপী জান্তার বিরুদ্ধে যে নিন্দার ঢেউ উঠেছে, তাকে স্তিমিত করার লক্ষ্যে তারা হয়তো বেশ কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে। হয়তো, তবে এর কোনোটিই নিশ্চিত নয়।
গত ১০ বছরে পশ্চিমা দেশগুলো উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে মিয়ানমারে, বিশেষত খনিজ সম্পদ আহরণে। অর্থনৈতিক স্বার্থের বিবেচনায় গত তিন বছরে তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর কোনো বাস্তব চাপ প্রয়োগ করেনি। তবে গণতন্ত্রের উকিল-মোক্তার হিসেবে চক্ষুলজ্জার খাতিরে এবার হয়তো তাদের কিছু পদক্ষেপ নিতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে মিয়ানমারের চীননির্ভরতা আরও বাড়বে। চীনের উদ্যোগে যে ত্রিপক্ষীয় আলোচনা শুরু হয়েছিল জানুয়ারিতে, তার দ্বিতীয় সভা হওয়ার কথা ছিল ৪ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশ প্রস্তুত ছিল অংশ নিতে, কিন্তু প্রত্যাশিতভাবেই মিয়ানমার কোনো সাড়া দেয়নি। এ মুহূর্তে আরও অনেক জরুরি বিষয় তাদের অগ্রাধিকার তালিকায় আছে।
ত্রিপক্ষীয় সভা কবে হতে পারে, সেটা নিয়ে বরং চীনের সঙ্গে কথা বলতে পারে বাংলাদেশ। একমাত্র তাদের সঙ্গেই নিশ্চিতভাবে জান্তার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। তবে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের মূল আলোচনা হতে হবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের রোডম্যাপ নিয়ে, দু-পাঁচ হাজারের টোকেন প্রত্যাবাসন নিয়ে নয়। কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একমাত্র চীনের চাপই হয়তো নমনীয় করতে পারে মিয়ানমারকে। সে চাপ হতে হবে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ন্যূনতম এবং বিশ্বাসযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টির জন্য। তা না করে শুধু ফেরত নিতে রাজি হলে কোনো ফায়দা হবে না, কারণ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া ফিরে যেতে রাজি হবে না শরণার্থীরা।
রোহিঙ্গা গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে অং সান সু চির প্রতি পশ্চিমা সমাজের ভালোবাসার জোয়ারে বেশ খানিকটা ভাটা পড়েছিল। সেনা অভ্যুত্থানের পর সেখানে উল্টো জোয়ার দেখা যাচ্ছে। তা উঠুক, কিন্তু আমাদের দেখতে হবে, যখনই তাঁর গ্রেপ্তারের নিন্দা এবং ‘সিভিল সরকারের’ ক্ষমতা পুনর্বহালের বিষয় উচ্চারিত হবে, সঙ্গে সঙ্গেই যেন নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের নিরাপদে নিজ বাসভূমে ফেরত যাওয়ার দাবিও জোরালোভাবে তোলা হয়। পরিস্থিতির পরিবর্তন সত্ত্বেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে শুধু চীনের ওপর নির্ভর করা হবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সেনা অভ্যুত্থানের ডামাডোলে রোহিঙ্গা সংকট যাতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে না যায়, তার নিশ্চয়তা বিধানে তৎপর থাকতে হবে বাংলাদেশকে।
সামরিক অভ্যুত্থানের আগে অং সান সু চির সরকার গণহত্যা মামলায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের অভিযোগের জবাব না দিয়ে এ মামলা করার বিষয়ে গাম্বিয়ার এখতিয়ার নিয়ে আবার প্রশ্ন তুলেছে। আদালত গাম্বিয়াকে এর জবাব দেওয়ার জন্য মে মাস পর্যন্ত সময় দিয়েছে। স্পষ্টতই কালক্ষেপণের নীতিতে অবিচল আছে মিয়ানমার। দ্বিপক্ষীয় বা ত্রিপক্ষীয় আলোচনার পাশাপাশি বিচারিক প্রক্রিয়ায় সব ধরনের সহায়তা ধৈর্যের সঙ্গে দিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশকে।
সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে কিছু বিক্ষোভ দানা বাঁধছে মিয়ানমারে। এ বিক্ষোভ যদি ব্যাপক আকার ধারণ করে, সেনাবাহিনী তখন সাধারণ মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে দেওয়ার জন্য মিয়ানমারে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আরেকটি দমন অভিযান শুরু করতে পারে। এমন আশঙ্কা করছেন অনেকেই। সে ক্ষেত্রে কী করবে বাংলাদেশ?
খুব নিষ্ঠুর শোনালেও বাংলাদেশের তরফে সব মহলে এ বার্তা স্পষ্ট করা জরুরি যে অতিরিক্ত কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশ গ্রহণ করবে না। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের উচিত হবে স্থল এবং নৌ সীমান্ত সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া। জান্তার এ সম্ভাব্য অপকর্ম রুখে দেওয়ার দায়িত্ব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের, বাংলাদেশের নয়। গণহত্যাকারী মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গত তিন বছরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করেনি। তার দায়ভার বাংলাদেশ একা বহন করতে পারে না।
মো. তৌহিদ হোসেন: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব