গেল সপ্তাহে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে শান্তি প্রাসাদে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যে শুনানি চলছিল, সেখানে ঘুরেফিরে বাংলাদেশের কথা এসেছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যার উদ্দেশ্যে পাইকারি হারে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, জনপদ নিশ্চিহ্ন করার মতো বিভিন্ন গুরুতর অপরাধের বিষয়ে গাম্বিয়ার আরজির ওপর এই শুনানি হয়। গাম্বিয়ার আরজি আদালত শুনতে রাজি হওয়ার কারণ হচ্ছে, দেশটি রোহিঙ্গাদের আরও গণহত্যার আশু হুমকি থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ছয়টি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চেয়েছে।
শুনানিতে আরজির পক্ষে ও বিপক্ষে, অর্থাৎ গাম্বিয়া ও মিয়ানমারের উভয় তরফেই আইনজীবীদের যুক্তিতর্কে বাংলাদেশের কথা এসেছে। আর আদালতের বাইরে রোহিঙ্গা অধিকারের পক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জড়ো হওয়া লোকজনও বাংলাদেশের কথা বলেছেন। তাঁরা ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য ‘থ্যাংক ইউ বাংলাদেশ’ স্লোগান দিয়েছেন। এ ছাড়া ওই শহরে আরও দুটি জায়গায় বাংলাদেশের উদারতা ও আতিথেয়তার প্রশংসা শোনা গেছে। একটি ছিল গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদুর সংবর্ধনা অনুষ্ঠান, যা ছিল মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাংলাদেশের যৌথ আয়োজন। অন্যটি ছিল ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে রোহিঙ্গাদের জবাব দেওয়ার অধিকার বিষয়ে একটি আলোচনা। এসব আলোচনায় কানাডার প্রধানমন্ত্রীর রোহিঙ্গাবিষয়ক দূত বব রেসহ কূটনীতিকদের অনেকেই অংশ নিয়েছেন। গাম্বিয়ার মামলায় সহযোগিতার জন্য এই দুই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ প্রশংসিত হয়।
আদালতের ভেতরের চিত্রটি অবশ্য বাইরের মতো ছিল না, বরং মিয়ানমারের আইনজীবীদের একটি কৌশলই ছিল, বাংলাদেশের গত কয়েক বছরের ভূমিকাকে তাদের অপরাধ আড়ালের চেষ্টায় ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা। অন্তত দুটি ক্ষেত্রে এটি করা হয়েছে। ১. সরাসরি সংক্ষুব্ধ দেশ মামলা করেনি এবং ২. রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানকারী হিসেবে প্রত্যাবাসনের আলোচনা চালু থাকায় নতুন করে গণহত্যার আশু ঝুঁকির কারণে অন্তর্বর্তী আদেশের যৌক্তিকতা। বিষয়টি মোটেও উপেক্ষণীয় নয়।
গাম্বিয়ার আরজি খারিজের জন্য মিয়ানমারের একটা বড় যুক্তি, তাদের বিরুদ্ধে যেসব অন্যায়ের অভিযোগ করা হচ্ছে, সেগুলোর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিতাড়িত রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে। সুতরাং গণহত্যা সনদের কথিত লঙ্ঘনে সরাসরি যদি কেউ সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকে, সেটি হচ্ছে বাংলাদেশ, কিন্তু বাংলাদেশ কোনো গণহত্যার অভিযোগ করেনি। মিয়ানমারের পক্ষে আইনজীবী ক্রিস্টোফার স্টকার আদালতকে বলেন, ‘গাম্বিয়া বলেছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে তারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত কোনো পক্ষ নয়। তবে গণহত্যা সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে এ বিষয়ে আদালতের কাছে পদক্ষেপ চাওয়ার অধিকার তার রয়েছে।...রোহিঙ্গা ইস্যুতে গাম্বিয়ার “সর্বজনীন অধিকার” না থাকায় এবং দেশটি সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত কোনো পক্ষ না হওয়ায় বা এতে তার স্বার্থ যুক্ত না থাকায় তারা এ নিয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে না।’
প্রথম দফায় যুক্তি পেশের সময়ে স্টকার বলেন, এই ইস্যুতে নিশ্চিতভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ বাংলাদেশ, কিন্তু গণহত্যা সনদের ধারা ৯-এ বাংলাদেশের আপত্তি থাকায় মিয়ানমারের সম্মতি ছাড়া এ বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হওয়ার সুযোগ বাংলাদেশের নেই। প্রকৃতপক্ষে গণহত্যা সনদ স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে লাওস ছাড়া মিয়ানমারের আর কোনো প্রতিবেশী দেশ নেই, যারা এমন মামলায় পক্ষভুক্ত হতে পারে। তাঁরা আরও যুক্তি দেন যে গণহত্যা সনদের অধীনে এই আদালতের কাছে এর আগে যত মামলা এসেছে, তাতে আবেদনকারী দেশ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ ছিল। বসনিয়া গণহত্যা মামলার বিচারেও বিচারপতি ওডা এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট মত দিয়েছেন।
গাম্বিয়ার পক্ষের আইনজীবীরা দ্বিতীয় দফা শুনানিতে অংশ নিয়ে মিয়ানমারের অপরাধের বোঝা যে সরাসরি বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপেছে, সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত করেননি। সেটা সম্ভবও নয়। তাঁরা বরং সনদের স্বাক্ষরকারী হিসেবে সনদ লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদনের সর্বজনীন অধিকার গাম্বিয়ার রয়েছে বলে যুক্তি দেন। পিয়ের দ্যঁ আর্জেন এবং অধ্যাপক ফিলিপ স্যান্ডস বলেন, ১৯৪৮-এর গণহত্যা সনদের বাধ্যবাধকতা মিয়ানমার পূরণ করছে কি না, সে প্রশ্ন তোলার অধিকার গাম্বিয়ার অবশ্যই রয়েছে। অধ্যাপক স্যান্ডস অতীত রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক সনদের অংশীদার হিসেবে অন্তর্বর্তী আদেশের আবেদন করার অধিকার গাম্বিয়ার রয়েছে।
মিয়ানমারের পক্ষে স্টকার তাঁর সমাপনী যুক্তি পেশের সময় সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন গাম্বিয়ার মামলা করার অধিকারের বিষয়ে এবং এই আইনি লড়াইয়ে বাংলাদেশের নিষ্ক্রিয়তার ওপর। স্টকারের যুক্তি ছিল, বাংলাদেশ যে সরাসরি সংক্ষুব্ধ, সে বিষয়ে গাম্বিয়ার আইনজীবীরা দ্বিমত করেননি। স্টকার দাবি করেন, গণহত্যা সনদের ৯ ধারায় বাংলাদেশের আপত্তি থাকার কারণে ওই ধারার অধীনে মামলা করা সম্ভব না হলেও ৮ ধারায় সর্বজনীন অধিকার প্রয়োগ সম্ভব ছিল। তিনি আন্তর্জাতিক আইন কমিশন আইএলসির ২০০১ সালে তৈরি আন্তর্জাতিক পরিসরে অন্যায় বা অপরাধ (ইন্টারন্যাশনালি রংফুল অ্যাক্ট) এবং রাষ্ট্রের দায়িত্বের নির্ধারিত সংজ্ঞা উদ্ধৃত করে দাবি করেন, সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত নয় এমন কোনো তৃতীয় রাষ্ট্রের মামলা করার অধিকার নেই। বাংলাদেশ যদি গণহত্যা বিবেচনা করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন মনে না করে, তাহলে গাম্বিয়ার দাবিকে অযৌক্তিক প্রমাণের চেষ্টাতেই তিনি এমনটি দাবি করেন।
একইভাবে, গাম্বিয়া যেসব অন্তর্বর্তী আদেশের আরজি জানিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে যে রাখাইনে এখনো রোহিঙ্গা নির্যাতন চলছে। মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর যে ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার মুখে নারী-শিশুসহ অসংখ্য রোহিঙ্গার প্রাণহানি ঘটেছে এবং প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা দেশটি থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, সে ধরনের অন্যায়-অপরাধ অব্যাহত আছে এবং পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন না ঘটায় সেখানে থাকা আরও ছয় লাখ রোহিঙ্গা আরও গণহত্যার শিকার হওয়ার আশু ঝুঁকিতে রয়েছে। সুতরাং, এদের সুরক্ষার প্রয়োজনে আদালত অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার নির্দেশ দিন।
মিয়ানমারের পক্ষে আরেক আইনজীবী আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক মিস ফোবে ওকোয়া অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপের বিরোধিতা করতে গিয়ে বলেন, প্রথমটি হলো, অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপের নির্দেশ সেখানেই দেওয়া হয়, যেখানে মানবাধিকারের অপূরণীয় ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ সব সময় ভবিষ্যৎ হুমকির কথা চিন্তা করে নেওয়া হয়; অতীতের কোনো ঘটনার জন্য নয়। আদালতকে গাম্বিয়ার অবশ্যই এই যুক্তি দেখাতে হবে যে সেখানে এখন মানবাধিকারের অপূরণীয় ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
মিস ওকোয়া বলেন, আবেদন করা হয়েছে ২০১৯ সালের নভেম্বরের শেষে। যার মানে দাঁড়ায়, নভেম্বর বা অক্টোবরে এমন কিছু ঘটেছে, যার কারণে আবেদনটি করা হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের প্রধান সহায়তাকারী জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর)। এর সঙ্গে আছে জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনডিপি)। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সহযোগিতার জন্য ২০১৮ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে ইউএনএইচসিআর। এই বছরের মে মাসে এই সমঝোতা স্মারকের সময় ২০২০ সালের ৫ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এই সংকট মোকাবিলা করা দেশ বাংলাদেশও মিয়ানমারের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তিতে প্রবেশ করেছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ মনে করছে না যে ফিরে আসা মুসলমানরা গণহত্যার মতো ঝুঁকিতে আছে।
গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে সমাপনী বক্তব্যে উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের বক্তব্যকে প্রতারণা অভিহিত করে রাইখলার বলেন, মিয়ানমার নিজেই স্বীকার করেছে যে খুব সামান্যসংখ্যকই ফিরেছে। প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমার যেসব ব্যবস্থার কথা দাবি করেছে, তা প্রতারণা (ফ্রড)। তিনি বলেন, প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব মিয়ানমারের এবং তারা সেটি পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি এ ক্ষেত্রে নভেম্বরে বাংলাদেশের দেওয়া সর্বসাম্প্রতিক বিবৃতি থেকে উদ্ধৃত করে বলেন, মিয়ানমার নিরাপদ ও মর্যাদার সঙ্গে ফেরার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে কিছুই করেনি।
মিয়ানমার এই বক্তব্যের জবাবে আবারও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় তাদের বিভিন্ন প্রস্তুতির কথা বলেছে। তারা একই সঙ্গে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে আদালত কোনো অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার নির্দেশ দিলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। বহুমাত্রিক কূটনীতি আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ, দ্বিপক্ষীয়-বহুপক্ষীয়, সরকারি ও বেসরকারি নানা পর্যায়ে চলতে পারে। যুদ্ধের সময়েও বিবদমান পক্ষগুলো এ ধরনের সংযোগ রক্ষা করে থাকে। কিন্তু উচ্চপর্যায়ের আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ সব সময়ে চলে না। মিয়ানমারের ওপর চাপ বজায় রাখার জন্য আমরা শুরু থেকেই কঠোর হওয়ার জন্য বলে আসছি। রোহিঙ্গা নিধনকে গণহত্যা অভিহিত করতে বাংলাদেশের দ্বিধা কিসের, সে প্রশ্নও তুলেছি। চীন ও ভারতের মধ্যস্থতার উদ্যোগে সাড়া দিতে নিরুৎসাহিত না করলেও তাদের ওপর ভরসা না করার কথা বলেছি। এসব সমালোচনা ও পরামর্শ খুব একটা সমাদৃত হয়নি, বরং বিরক্তি প্রকাশ করা হয়েছে। এখন আমরা তাই প্রশ্ন করতেই পারি, বাংলাদেশকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ মিয়ানমারকে কি আমরাই করে দিইনি?
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক