মতামত

রোজিনার মামলায় ‘সরকারি গোপনীয়তা’ ও ‘গুপ্তচরবৃত্তি’ গুলিয়ে ফেলা হয়েছে

সম্প্রতি সরকারি গোপনীয়তার আইনটি নিয়ে অনেক নাটকীয়তা হয়েছে। প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সরকারি গোপনীয় তথ্য চুরির কথিত অভিযোগে সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের একান্ত সচিবের অফিস কক্ষে দীর্ঘ ৬ ঘণ্টা জোরপূর্বক আটকে রেখে হেস্তনেস্ত করা হয়। একজন নারী সাংবাদিককে নিয়ে টেলিভিশন বা ইউটিউবে প্রচারিত লাইভ দৃশ্য বেদনাদায়ক ও দৃষ্টিকটু মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, গুলিস্তানের জটলায় একজন পেশাদার পকেটমারকে হাতেনাতে ধরে গণপিটুনি দেওয়া হচ্ছিল। অতঃপর তাঁকে গ্রেপ্তার করে রাতে থানায় অফিশিয়াল সিক্রেটস আইনের অধীনে আনুষ্ঠানিক ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়। টানাহেঁচড়া করে তাঁকে আদালতে নেওয়া হয় এবং সেখান থেকে কারাগারে চালান করা হয়। সম্মানীয়া নারী বিধায় দৃশ্যটিকে মানহানিকর দেখাচ্ছিল। প্রায় ৬ দিন কারারুদ্ধ থাকার পর তিনি জামিনে মুক্ত হন। মামলা চালু রাখা হয়েছে। গণমাধ্যমের সুবাদে ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সবাই অবহিত থেকেছেন।

আইনটির বোধগম্য উদ্দেশ্য গুপ্তচরবৃত্তি রোধ করে গোপনীয় সামরিক বা আধা সামরিক বিষয়াদির সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তবে আইনটির শিরোনাম যথাযথ নয়। এটি বিভ্রান্তিকর। শিরোনাম হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল গুপ্তচরবৃত্তি আইন (এসপিওনাজ অ্যাক্ট)। আইনের ধারা ২ (৮)-এ ‘নিষিদ্ধ স্থান’–এর বিস্তৃত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

বলা প্রয়োজন, সেনানিবাস, অস্ত্রাগার, যুদ্ধজাহাজ, যুদ্ধবিমান, সাবমেরিন, সব ধরনের যুদ্ধ উপকরণ—ইত্যাদির পাশাপাশি বড় বড় অসামরিক স্থাপনা যথা, ব্রিজ, সেতু, কালভার্ট, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্টসহ অনুরূপ সব বিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্ট, যোগাযোগ টাওয়ার, রেডিও-টেলিভিশন সম্প্রচার কেন্দ্র, তেল শোধনাগার, খনি, সড়কপথ, নৌপথ, রেলপথ ইত্যাদিও পরোক্ষভাবে বিশেষ বিশেষ সময়ে সামরিক স্থাপনা গণ্য হতে পারে।

নিষিদ্ধ স্থানে স্পর্শকাতর সামরিক-অসামরিক স্থাপনাগুলো অবস্থিত এবং স্পর্শকাতর সামরিক অস্ত্র, গোলাবারুদ, সরঞ্জামাদি ইত্যাদি জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে গোপনে সংরক্ষণ করা হয়। অনুরূপ স্থান ও স্থাপনাগুলোয় সর্বসাধারণের অবাধ প্রবেশ ও বিচরণ নিষিদ্ধ, নিয়ন্ত্রিত বা সরকারি আদেশ দ্বারা, সময়-সময়, নিয়ন্ত্রণযোগ্য।

আইনের ধারা ৩ (১) মতে, কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের স্বার্থ বা নিরাপত্তার ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে আইনের ধারা ২ (৮)-এ বর্ণিত নিষিদ্ধ কোনো স্থান, স্থাপনা বা বিষয়ের গোপন কোনো তথ্য, যথা, ম্যাপ, স্কেচ, মডেল, ছবি, প্ল্যান, নথি, কোড, পাসওয়ার্ড, দলিল, ইত্যাদি শত্রুকে সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে অথবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শত্রুর ব্যবহার বা উপকারার্থে অননুমোদিতভাবে সংগ্রহ করতে পারবেন না। আইনের প্রণিধানযোগ্য চারটি বিষয় হচ্ছে (ক) নিষিদ্ধ স্থান, (খ) নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত বিষয় (গ) নিজ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্বার্থ বিঘ্নিত করার উদ্দেশ্য এবং (ঘ) শত্রুরাষ্ট্রের উপকার সাধনের অভিপ্রায়।

এদিক থেকে বিবেচনা করা হলে আইনটি ইউএস এসপিওনাজ অ্যাক্ট, ১৯১৭–এর অনুরূপ একটি গুপ্তচরবৃত্তি আইন (এসপিওনাজ অ্যাক্ট) হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল।
সরকারি গোপনীয়তা আইন বা অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩ শিরোনাম হওয়ার কারণে আইনটির অর্থ, উদ্দেশ্য ও অন্তর্নিহিত বিধানাবলি বিষয়ে বিভ্রান্তি, অস্পষ্টতা, দুর্বোধ্যতা ইত্যাদি রয়েছে। আইনের ধারা ৩ (১)–এর উপ শিরোনামে ‘গুপ্তচরবৃত্তির দণ্ডসমূহ’ বলা হয়েছে। আইনপ্রণেতারা নিজেরাই সম্ভবত: এ ক্ষেত্রে ‘সরকারি গোপনীয়তা’ এবং ‘গুপ্তচরবৃত্তি’কে গুলিয়ে ফেলেছেন। আইনটি রহিত করে ‘সরকারি গোপনীয়তা’ এবং ‘গুপ্তচরবৃত্তি’ বিষয়ে পৃথক পৃথক আইন প্রণয়ন করা হলে অনভিপ্রেত এ জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি এবং আইনের এমন অবাঞ্ছনীয় ও অনভিপ্রেত অপপ্রয়োগের সুযোগ হ্রাস পেতে পারে।

আমি আইন পড়েছি। কিছুকাল আইন পেশায় থেকেছি। বিচারক হিসেবে দীর্ঘ সময় সহকারী জজ থেকে জেলা জজ পর্যন্ত সব পদে কাজ করেছি। আইন মন্ত্রণালয়ে সহকারী সচিব থেকে সচিব পর্যন্ত প্রতিটি পদেও দায়িত্ব পালন করেছি। সরকারি গোপনীয়তা আইন বা অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩–এর সঙ্গে তখন থেকে পরিচয়। আইনের শিরোনামের কারণে শুরুতে আমি আইনটিকে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের কথিত অনুরূপ অপরাধের আইন হিসেবেই জেনেছিলাম। বারবার পাঠ করে সঠিক অর্থ বুঝতে পেরেছিলাম। আমি নিশ্চিত, সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, পুলিশ, আমলা, জজ, আইনের শিক্ষক অনেকেই আইনটি সাবলীলভাবে পাঠ করে এর সঠিক অর্থ সহজে হৃদয়ঙ্গম করতে পারবেন না। দীর্ঘ সাধনা লাগবে।

সচিবালয়ে সরকারি নথির গোপনীয়তা রক্ষার প্রয়োজন হলে, তা কীভাবে করতে হবে সচিবালয় নির্দেশমালায় তার বিস্তারিত বিধানাবলি রয়েছে। নথি গোপনীয় হলে নথির প্রচ্ছদে লাল কালিতে ‘গোপনীয়’ বা ‘অতি গোপনীয়’ স্লিপ সাঁটিয়ে পর্যাপ্ত সতর্কতার সঙ্গে অনুরূপ নথি হ্যান্ডেল করতে হবে। প্রথমত, কথিত গোপনীয় তথ্যের নন-ডিসক্লোজার চুক্তির নথি, যদি সত্যই গোপনীয় হয়ে থাকত, সচিবের একান্ত সচিবের কক্ষে টেবিলের ওপর পড়ে থাকল কীভাবে! দ্বিতীয়ত, নথিগুলো কি আদৌ গোপনীয় ছিল। তৃতীয়ত, রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সহযোগিতার (অ্যাবেটমেন্ট) ফৌজদারি মামলা বা দায়িত্বহীনতার অভিযোগে নিদেনপক্ষে প্রশাসনিক শৃঙ্খলামূলক মামলা হয়েছে কি?

প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতার চলমান ঘোষিত নীতির সঙ্গে তথ্যানুসন্ধান এভাবে বাধাগ্রস্ত হলে রাষ্ট্রীয় নীতিতে তা বৈপরীত্যের প্রকট আভাস ইঙ্গিত করে। তথ্য বা সংবাদ সংগ্রহের জন্য সাংবাদিকদের সরকারিভাবেই সচিবালয়ে প্রবেশের অনুমতি সংবলিত কার্ড সরবরাহ করা হয়ে থাকে। সচিবালয় তাহলে ‘নিষিদ্ধ স্থান’ হয় কীভাবে, সরকারি তথ্য কীভাবে ‘গোপনীয়’ এবং তথ্য আহরণ কীভাবে তথ্য চুরি বা গুপ্তচরবৃত্তি হতে পারে?

সচিবালয় নিষিদ্ধ স্থান নয়। সচিবালয়ে রক্ষিত কতিপয় তথ্য ও নথি প্রশাসনিকভাবে গোপনীয় হলেও, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩–এর আওতাধীন সংবিধিবদ্ধভাবে (বাই ল) রাষ্ট্রীয় গোপনীয় তথ্য নয়, যা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট এবং শত্রু রাষ্ট্রের জন্য উপকারী। সংবিধিবদ্ধভাবে গোপনীয় এবং প্রশাসনিকভাবে গোপনীয় সমার্থক নয়। ইসরায়েল আরবদের শত্রুরাষ্ট্র হতে পারে। বাংলাদেশের কোনো ঘোষিত শত্রুরাষ্ট্র রয়েছে কি না, জানা নেই। যুদ্ধমন্ত্রী প্রফুমো ও যৌনকর্মী খ্রিষ্টিন কিলারের কেলেঙ্কারিতে গুপ্তচরবৃত্তি প্রতিরোধে ব্যর্থতার দায় নিয়ে বিলেতের প্রধানমন্ত্রী ম্যাকমিলানের সরকার ১৯৬৩ সালে ইস্তফা দিয়ে নজির স্থাপন করেছিলেন। লরেন্স অব আরাবিয়া বিলেতের গুপ্তচর হয়ে সেনানায়ক হিসেবে আরবদের সঙ্গে এক হয়ে অটোমান সাম্রাজ্য ধ্বংসে সফল ভূমিকা রেখেছিলেন।

ইসরায়েলি গুপ্তচর এলি কোহেন স্বীয় দক্ষতায় অবলিলাক্রমে ১৯৬১-১৯৬৫ সাল পর্যন্ত সিরীয় আরবদের পরম বন্ধুবেশে সিরিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টা হয়ে অবাধে গোপনীয় সামরিক তথ্য শত্রুরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সরবরাহ করেছিলেন।

গুপ্তচরবৃত্তিতে দুটি পরস্পর শত্রুরাষ্ট্রের প্রয়োজন হয়, যা অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩–এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছিলেন, রোজিনা ইসলাম ভ্যাকসিন সম্পর্কিত নন–ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট থেকে গোপনীয় তথ্য সংগ্রহ করছিলেন, যা প্রকাশ পেলে বাংলাদেশ চুক্তিভঙ্গের জন্য দায়ী হতে পারত। নন–ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (এনডিএ) কখনো গোপন দলিল নয়।

সেখানে কখনোই কোনো গোপন তথ্য থাকে না। সাধারণত: দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক চুক্তির ক্ষেত্রে এনডিএর মাধ্যমে পক্ষদ্বয় আগাম পরস্পর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে থাকে যে মূল সরবরাহ বা উৎপাদন চুক্তির বাস্তবায়নকালে কোনো এক পক্ষ তার কোনো গোপন তথ্য (ট্রেড সিক্রেটস) অপর পক্ষের নিকট প্রকাশ করলে ওই অপর পক্ষ ওই গোপন তথ্য তৃতীয় কোনো পক্ষের নিকট প্রকাশ করবে না।

অনেকেই অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩-কে ঔপনিবেশিক মন্দ আইন আখ্যায়িত করে অবিলম্বে তা রহিত করার দাবি করছেন। আইনটির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, সরকারি আমলাদের হাতে বিশেষ উদ্দেশ্যে অপপ্রয়োগের কারণে আইনটি দায়ী বা মন্দ হতে পারে না। প্রয়োজনে, অপপ্রয়োগ রোধকল্পে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আইনটির প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, পরিমার্জন বা পুনঃ প্রণয়ন হতে পারে। আইনি অজ্ঞতা ও অপপ্রয়োগের দায়ে দায়ীকে জবাবদিহির আওতায় আনা যেতে পারে।

কাজী হাবিবুল আউয়াল সাবেক সিনিয়র সচিব।