১ নভেম্বর কলকাতায় আমার বন্ধুর বাসায় বসে বাংলাদেশের একটি অনলাইন পত্রিকা খুলতেই দেখি প্রথমে যে সংবাদটি বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয়। ওই সময় সংবাদটিতে তেমন কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা ছিল না। শুধু বলা হয়েছে, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এই বিপর্যয়। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটা নতুন কিছু নয়। অন্য দেশেও এমন বিপর্যয় ঘটতে পারে এবং ঘটেছে। গত সোমবার দিক্ষণ আফ্রিকায় ঘটেছে। আগামী দুই সপ্তাহ তাদের চারটি প্রধান শহর বিদ্যুৎবিহীন থাকবে। এর আগে বাংলাদেশে ২০০৩ ও ২০০৭ সালে জাতীয় গ্রিডে ত্রুটি দেখা দেওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তা-ও বেশ দীর্ঘ সময় পর পুনরায় চালু হয়েছিল।
দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ওপর আরও ব্যাপক জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নির্ভর করে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকলে পানি, গ্যাস সরবরাহ, পেট্রলপাম্পের তেল, ট্রেনের সিগন্যাল বাতি, বিমানবন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম, রেলস্টেশনে টিকিট বিক্রি, মোবাইল ফোন সার্ভিস, পত্রিকা অফিসের কার্যক্রম, রেডিও-টিভির সম্প্রচার সবকিছুই বিঘ্নিত হয়। খবরটা শুনে দেশে আমার মেয়েকে ফোন করি। সে বলে, বেলা ১১টার পর থেকে বিদ্যুৎ নেই। তখন বেলা তিনটা। অ্যাপার্টমেন্টের জেনারেটর ক্লান্ত হয়ে এখন জিরিয়ে নিচ্ছে।
কলকাতা বিমানবন্দরে বসে আমার এক অনুজপ্রতিম সাংবাদিক বন্ধুকে ফোন করে সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাই। সে বলে, তাদের কাছে যে সংবাদ আছে, তাতে তারা জেনেছে যে ভারত থেকে যে সঞ্চালন ভেড়ামারা বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্রের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসে, সেই বিতরণকেন্দ্রে সমস্যা হয়েছে। বিকেল পাঁচটার সময় তা মেরামত করা হয়েছিল। চালু করার কিছুক্ষণ পরই আবার আশুগঞ্জ বিতরণকেন্দ্র ট্রিপ করে। রাতের ফ্লাইটে দেশে ফিরে দেখি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর কণ্ঠেও একই সুর। এটিকে তিনি ভারতের জায়গায় সরকারের ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেছেন। রিজভী আর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামকে ইদানীং বেশ পছন্দ করতে শুরু করেছি। আমি সাধারণত টিভি দেখার সময় পাই না, কিন্তু সংবাদে এই দুজনের বক্তব্য পেশ করার সময় তা শোনার চেষ্টা করি। কারণ, দুজনের কথা বলার স্টাইল আর বক্তব্য দুটিই বেশ আনন্দদায়ক।
বাংলাদেশ বর্তমানে প্রায় ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে, কিন্তু অনেক সময় বিতরণ লাইনের সমস্যার কারণে সাত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বিতরণ করতে গেলেই বিপত্তি ঘটে। কারণ, বিতরণ লাইনের সঞ্চালন ক্ষমতা সীমিত। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪৭০ মেগাওয়াট। যুদ্ধে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে সেই উৎপাদনব্যবস্থায়ও মারাত্মক বিঘ্ন ঘটেছিল। এ ছাড়া সঞ্চালন লাইনগুলো বেশির ভাগ জায়গায় বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব ছিল না। বিদ্যুৎ, পানি বা গ্যাস উৎপাদন সমস্যার সমাধান করলেই হবে না, সরবরাহব্যবস্থা যদি ঠিক না থাকে, তাহলে উৎপাদন অর্থহীন হয়ে যেতে পারে। পানি বা গ্যাস সংরক্ষণ করা যায়। বিদ্যুৎ যখন উৎপাদন তখন সরবরাহ। তাকে সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। যা হোক, সাংবাদিক বন্ধুকে ফোন করে বুঝতে পারলাম বিষয়টা সম্পূর্ণ যান্ত্রিক ত্রুটি এবং একসময় তা সেরে যাবে। তবে যারা বিদ্যুতের ওপর পুরোমাত্রায় নির্ভরশীল, তাদের ভোগান্তি হবে এবং সেখানে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র আবিষ্কারের প্রতিযোগিতা চলবে।
২০০৩ সালের কথা। তখন আমি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে অবস্থান করছি। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের জীবনযাত্রার পুরোটাই বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। কয়েক মিনিটের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হলে সবকিছু অচল। গাড়ি, ট্রেন, বিমানবন্দর চলবে না। পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। বাড়িতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হওয়ার কারণে চুলায় রান্না চড়বে না। বিদ্যুৎ সরবরাহের সমস্যা যদি দীর্ঘায়িত হয়, মোটামুটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় মহাবিপর্যয় নেমে আসতে পারে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার বন্ধু সতর্ক করে দিল, খবরদার রাস্তায় বের হবে না। একটু পর অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় দোকানপাটে লুটতরাজ শুরু হয়ে যেতে পারে। এরপর দাঙ্গা পুলিশ এসে এলোপাতাড়ি লাঠিপেটা শুরু করবে এবং সামনে যাকে পাবে তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যাবে। এমন অবস্থার কথা শুনেছি, তবে কখনো চাক্ষুষ দেখিনি। আমাদের এলাকা কিছুটা শান্ত থাকলেও দূরে বেশ হইহট্টগোল আর গুলি-টিয়ার গ্যাসের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর আগুনের লেলিহান শিখা। সারা রাত আর বিদ্যুৎ আসেনি। পরের দিনও না। মোট দুই দিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার উত্তর-পূর্ব অংশ বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় ছিল এবং এ সময় বিভিন্ন শহরে যে লুটপাট হয়েছে, তার ÿক্ষতির পরিমাণ কয়েক মিলিয়ন ডলার। মানুষের দুর্ভোগ তো ছিলই।
সেদিক দিয়ে বাংলাদেশে ১ নভেম্বরের প্রায় ১০ ঘণ্টার এই বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে তেমন কোনো দুর্ঘটনার কথা শোনা যায়নি। রাত সাড়ে আটটায় আমাদের বহনকারী বিমান যখন ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার জন্য আকাশে চক্কর দিচ্ছে, জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখি, দু-একটি বিচ্ছিন্ন এলাকা ছাড়া সারা শহর অন্ধকার। বিমানবন্দর সড়কে গাড়ির বাতিগুলো দেখা যাচ্ছে। ইমিগ্রেশনে কর্মরত কর্মকর্তারা চেষ্টা করেছেন কিছুটা আলো-অন্ধকার অবস্থায় দ্রুত তাঁদের কাজ সারতে। কারণ, বলা তো যায় না, আবার কখন বিমানবন্দরের স্ট্যান্ডবাই পাওয়ার হাউস ক্লান্ত হয়ে পড়ে। যথারীতি পরদিন সব পত্রিকায় শীর্ষ খবর ছিল আগের দিনের বিদ্যুৎ বিপর্যয়।
ষড়যন্ত্রতত্ত্ব তো ছিলই, তার ওপর ছিল নাশকতাতত্ত্ব। সব তত্ত্বের পেছনে আবার জোরালো যুক্তি খাড়া করার আপ্রাণ চেষ্টাও ছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো তো মোটামুটি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। দু-একজন বলেই ফেলল, এই অপদার্থ আর ‘অবৈধ’ সরকারের এই ব্যর্থতা কাঁধে নিয়ে কালই পদত্যাগ করা উচিত। একজন সাবেক আমলা ফেসবুকে একটি হারিকেনের ছবি দিয়ে সরকারকে নসিহত করলেন আগামী নির্বাচনে যেন আওয়ামী লীগ নৌকা মার্কার বদলে হারিকেন মার্কায় নির্বাচন করে। একজন আবার ফোড়ন কেটে বলেন, ‘আরে ভাই, ২০১২ সালের ৩০ ও ৩১ জুলাই উত্তর ভারতের ২২টি রাজ্যে বিদ্যুৎ ছিল না এবং তার ফলে ৬০ কোটি মানুষ বিদ্যুৎবিহীন ছিল, তাতে কি কংগ্রেসের নির্বাচনী মার্কা বদল হয়েছে? কে শোনে কার কথা।’
শনিবারের বিদ্যুৎ বিপর্যয় কাটিয়ে দ্রুততম সময়ে সরকারের গৃহীত ব্যবস্থার প্রশংসা না করলে এই কর্মযজ্ঞের সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের প্রতি অবিচার করা হবে। এরই মধ্যে সরকার এই বিপর্যয়ের কারণ খুঁজে বের করার জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তারা তদন্ত শুরু করেছে। ইতিমধ্যে তারা সমস্যার প্রথম উৎপত্তিস্থল ভেড়ামারা পরিদর্শন করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। সম্পূর্ণ প্রতিবেদন জমা দিতে আরও এক মাস সময় লাগবে বলে তারা জানিয়েছে। যাদের সামান্যতম কারিগরি জ্ঞান আছে, তারা বুঝবে যে বিদ্যুৎ একটি গ্রিডের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্নভাবে সঞ্চালন করা হয় এবং গ্রিডের মাধ্যমে বিভিন্ন পাওয়ার স্টেশনে বা সাবস্টেশনের মাধ্যমে তার শক্তি নিয়ন্ত্রণ করে এলাকায় বিতরণ করা হয়। উৎপাদন পয়েন্ট থেকে বড় সাবস্টেশনে আসে, সেখান থেকে ছোট সাবস্টেশনে তারপর ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছায়। সব স্টেশনেই সার্কিট ব্রেকার থাকে। আজকাল প্রায় সব বাড়িতেও এ রকম সার্কিট ব্রেকার থাকে। বিদ্যুৎ সঞ্চালনে কোনো ধরনের ত্রুটি থাকলে সার্কিট ব্রেকার ট্রিপ বা পড়ে যেতে পারে। বাড়িতে পড়লে তা আমরা তুলে দিই। কিন্তু একটি পাওয়ার সাবস্টেশনে তা পড়লে ত্রুটি শনাক্ত না করে তেমন করে তুলে দিলে আরও বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে।
তদন্তে হয়তো ত্রুটি ধরা পড়বে। তবে সেটি হবে রোগ নির্ণয়। পরবর্তী সময়ে রোগ সারানোর ব্যবস্থা না নিলে রোগের পুনরাবৃত্তি যেকোনো সময় হতে পারে। বাংলাদেশে এ ধরনের সমস্যার শনাক্তকরণ প্রায় সময় হয়, কিন্তু নিরাময়ের ব্যবস্থা হয় না। আশা করি এবার তেমনটি হবে না, আর একশ্রেণির মানুষ ষড়যন্ত্র ও নাশকতা আবিষ্কারের সুযোগও পাবে না।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।