অনেকেরই স্মরণে থাকার কথা, খ্রিষ্টীয় ২০২০ অব্দটি আসার কুড়ি বছর আগে থেকেই বছরটিতে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা কী রূপ ধারণ করবে, সে সম্পর্কে আলোচনা ও জল্পনাকল্পনা হয়েছে। মনে আছে, ২০০০-২০০১-এর দিকে এ সম্পর্কে লেখালেখি ও আলোচনা হয়েছে। যেসব সম্ভাবনা সম্পর্কে তখন ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, কোনো কোনো ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে তার চেয়ে বেশি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক হয়নি, এবং অনেক ক্ষেত্রে অবস্থার অবনতি হয়েছে।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করে। তবে সরকারি নীতিনির্ধারণে জামায়াতের প্রভাবই ছিল বেশি। প্রধান দল বিএনপির জন্য যে তা আত্মঘাতী হবে, তা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া উপলব্ধি করার প্রয়োজনবোধ করেননি। সম্ভবত দুই দলের নেতাদেরই স্বপ্ন এবং দৃঢ় প্রত্যয় ছিল, তাঁরা অক্লেশে ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন। তার ফলে একটি আধুনিক সমৃদ্ধ জাতি গঠনে জরুরি, যা করণীয় তা নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা ছিল না।
রক্ষণশীল নীতি-আদর্শ নিয়েও একটি দেশ অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করতে পারে, যদি থাকে সরকারের প্রশাসনিক দক্ষতা। সুষ্ঠু গণতন্ত্র ছাড়াও দেশের জিডিপি বাড়ানো সম্ভব। দুর্নীতি সত্ত্বেও অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকতে পারে, এমনকি অগ্রগতিও অর্জন করতে পারে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি অকার্যকর হয়, তা হলে উন্নয়নের ধারা বাধাগ্রস্ত হয়।
একুশ শতকের প্রথম দশকটি বিএনপি-জামায়াত জোটের হাতে পড়ে স্রেফ অপচয় হয়েছে। তারা কোনো সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। যেকোনো উপায়ে নামকাওয়াস্তে একটি নির্বাচনে ‘জয়লাভ’ করে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার তাদের অপ্রতিরোধ্য প্রচেষ্টা অসাংবিধানিক শক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে সহায়তা করে। ২০০১ থেকে ২০২০ সময়সীমায় জাতি যে টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে পারত, তা ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হয়।
২০০৭-০৮-এর অগণতান্ত্রিক অসাংবিধানিক প্রশাসন দেশের প্রধান দুই দলের নেতাদের ধরপাকড় করে মানুষকে জানান দিতে চাইল তারা যুধিষ্ঠির এবং সততার পরাকাষ্ঠা। রাজনৈতিক নেতারা দুর্নীতিবাজ। দেশকে তাঁরা সাফসুতরো করে পরিষ্কার করবেন। উটকো ক্ষমতা নেওয়ায় দুই বছরী প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের ২০২০ সালে বাংলাদেশের কী হবে, তা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না।
যা হোক, বিএনপি-জামায়াত সরকার ও দুই বছরী প্রশাসন অতীত। ২০০৯-এর জানুয়ারিতে যে নির্বাচিত সরকার গঠিত হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, তারা কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা বা পারসপেক্টিভ প্ল্যান প্রণয়ন করে। তাদের ২০ বছর মেয়াদি দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-২০৪১) : ‘রূপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়ন শুরু হবে আগামী বছর। ২০২১ স্বাধীনতারও সুবর্ণজয়ন্তী। স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরের একটি নির্মোহ মূল্যায়ন ছাড়া পরবর্তী ২০ বছরের প্রেক্ষিত পরিকল্পনার কাজ শুরু করা সুবিবেচনার কাজ হবে না। কাগজে রচিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সক্ষমতা অর্জন না করলে এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো সুষ্ঠুভাবে কাজ না করলে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ফলপ্রসূ হবে না। আধা বাস্তবায়িত হবে, আধা থাকবে অবাস্তবায়িত।
এটা ভাবা একেবারেই অবাস্তব যে, যে সরকার প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে, আগামী কুড়ি বছর সেই সরকারই ক্ষমতায় থাকবে। কোনো কারণে থাকতেও পারে, আবার না-ও থাকতে পারে। বাংলাদেশে এ রকম দৃষ্টান্ত যথেষ্ট, এক সরকারের পরিকল্পনা অন্য সরকার বাস্তবায়ন না করে বাতিল করেছে। সেই জন্যই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা বিশেষ দরকার। সেগুলো যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে সরকার বদল হলেও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় ব্যাঘাত ঘটে না।
দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনার লক্ষ্য, ২০৪১ সালে ৯ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি। গড় মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ১২ হাজার ৫০০ ডলার, দারিদ্র্যের হার নেমে আসবে ৫ শতাংশে। সত্যি যদি তা হয় এবং পরিবেশ অনুকূল থাকলে হওয়া অসম্ভব নয়, তা যেমন অশেষ খুশির কথা, তেমনি তার জন্য এখন থেকেই কঠোর প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কী কী সম্ভাব্য সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতা দেখা দিতে পারে, তা নিয়েও ভাবতে হবে।
কুড়ি শতকের শেষ পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস থেকে দেখা গেছে, যেসব দেশ নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রেখেছে, তাদের টেকসই উন্নয়ন হয়েছে। একই সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করলেও পাকিস্তানে গণতন্ত্র না থাকায় তার অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর ঠিক উদার গণতান্ত্রিক না হলেও কঠোর আইনি ব্যবস্থা বজায় রেখে উন্নতি করেছে। দলীয়করণ বা সরকারি দলের লোক হওয়ার কারণে সেখানে কারও অনিয়ম দুর্নীতি করার সুযোগ নেই। নির্বাচনী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সেখানে কার্যকর রয়েছে। সেসব দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ত্রুটিমুক্ত। নির্বাচন কমিশন এমন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, যার নিরপেক্ষ ভূমিকা ছাড়া জনগণের ভোটাধিকার অর্থহীন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন বর্তমানে যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেখান থেকে তাকে যদি উদ্ধার করা না যায়, রাষ্ট্রের অনেক অর্জনই ম্লান হয়ে যাবে। সরকারের অনুগত নির্বাচন কমিশন থাকার চেয়ে না থাকা ভালো।
প্রবৃদ্ধি বাড়ার ওপর সরকার জোর দিচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নতির ওটা একটা মাপকাঠি বটে, কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি জনগণের সুখশান্তি না বাড়ে, সেই প্রবৃদ্ধির মূল্য কী? দূরদর্শী নেতৃত্ব ও দক্ষ প্রশাসন ছাড়া আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। দক্ষতা অর্জিত হয় মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে। বাংলাদেশে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার মান দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশের মধ্যে সবচেয়ে নিচে। শিক্ষার হার বেড়েছে, মান তলানিতে। ওদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরে যাচ্ছে শহর, বন্দর, জনপদ। তার অনেকগুলোতেই মানসম্মত শিক্ষার চেয়ে দুর্নীতি বেশি।
রূপকল্প ২০২১-২০৪১ বাস্তবায়নের জন্য যে ধরনের মানুষ দরকার, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা থেকে তেমন মানুষ পাওয়া যাবে না। অগণিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যাঁরা সনদ নিয়ে ‘শিক্ষিত’ হয়ে বেরোচ্ছেন, তাঁদের জাতিকে কিছু দেওয়ার ক্ষমতা না থাকলেও তাঁরা বাড়াচ্ছেন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। তাঁদের সংখ্যা আরও বাড়লে তাঁরাই সরকারকে বেকায়দায় ফেলবেন।
আগামী দুই দশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্মাণ হচ্ছে না সড়ক ও মহাসড়ক এবং রেল যোগাযোগব্যবস্থা।
যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তোলার পরিকল্পনায় গলদ রয়েছে। জনবহুল দেশে গণপরিবহনে কিছু সমস্যা থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু তার মাত্রা কতটা? পৃথিবীর ১৬৭ দেশের মধ্যে যোগাযোগের অবকাঠামোতে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯। দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের সঙ্গে আমরা তুলনা করতে যাব না, তার অবস্থান ৫, কিন্তু মালয়েশিয়ার তো ৩৩ এবং থাইল্যান্ডের স্থান ৪১। যোগাযোগব্যবস্থায় এত পিছিয়ে থাকলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা কীভাবে অর্জিত হবে?
প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটা ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অবস্থাও তথৈবচ। বাংলাদেশে ব্যাংকমালিকেরাই শতভাগ স্বাধীন, সুতরাং তাঁরা বাংলাদেশ ব্যাংক বা অর্থ মন্ত্রণালয়কে পরোয়া করতে বাধ্য নন। বিভিন্ন দেশে ব্যাংকের সুদের হার নির্ধারণ করে অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের এ দুটি এখন কমজোর, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে যা বাধা। ঋণখেলাপি হওয়ার অনুকূল পরিবেশ ও সুবর্ণ সুযোগ থাকলে দুনিয়াতে কোন বেকুব তার সদ্ব্যবহার করবে না?
বিচিত্র বাংলাদেশ! দুর্নীতি কমানোর কথা শুনে কর্মকর্তাদের মেজাজ গরম হয়ে গেছে। তাঁদের মনোভাব অনেকটা এ রকম: কেনাকাটায় টাকা মারবার না দিলে কামই করুম না। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে: ‘[দুর্নীতির] ওপর গণমাধ্যমে বারবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে আলোচনা-সমালোচনার কারণে ক্রয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে একধরনের ভীতির সঞ্চার করেছে। অনেকেই এ ধরনের পদে থাকতে চাইছেন না। আবার অনেকে ক্রয় প্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকছেন কিংবা ক্রয় প্রক্রিয়া বিলম্বিত করছেন। এতে করে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন বিঘ্নিত ও সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়।’
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় আসামি করা হচ্ছে সংবাদমাধ্যম ও দুদককে। ‘গত এক বছরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকের অভিযানে স্বাস্থ্য খাতে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন, কেউ গ্রেপ্তার-আতঙ্কে আছেন। আবার গ্রেপ্তার থেকে বাঁচতে কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, কেউ গা-ঢাকা দিয়েছেন।’ [সমকাল, ১২ জানুয়ারি]
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই বিজ্ঞাপনের পর এখন দুদকের একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া দরকার। সেটা হবে এ রকম: পর্দা কেনা হোক, সোফা কেনা হোক, গ্লাভস কেনা হোক, কোটি কোটি টাকা চুরি করুন, ২০৪১ সাল পর্যন্ত দুদক কোনো ব্যবস্থা নেবে না।
উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে বাংলাদেশ, কিন্তু দেশের ৮০ ভাগ মানুষ উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা পাবে না, তা তো পরিহাসের মতো শোনায়। রাজধানী ঢাকার ৭৫ ভাগ মানুষ বিশুদ্ধ পানি পায় না। অধিকাংশ মানুষ পানি ফুটিয়ে পান করে। গত ৫০ বছরে বহু সংক্রামক রোগ দমন করা গেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা দেখা দিয়েছে। সরকারের পাশাপাশি এনজিওগুলোও ভূমিকা পালন করেছে। সব উপজেলায়ই হাসপাতালের দালান আছে, সেখানে নেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক ডাক্তার, নেই সাধারণ রোগের ওষুধ। কেন নেই, তা দুদকের কর্মকর্তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে।
জনগণের আশা রূপকল্প ২০২১-২০৪১ সফল হোক। বাংলাদেশের নাম উন্নত দেশের তালিকায় স্থান পাক। কিন্তু সাংবিধানিক সংস্থা ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা, শৃঙ্খলা ও জবাবদিহি যদি নিশ্চিত করা না যায়, উন্নত দেশ হওয়ার রূপকল্প রূপকথা বা কল্পকথা হয়ে থাকবে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক