আগামী ৩ জানুয়ারি আত্মিক চাকমার তিন বছর পূর্ণ হবে। একই দিন তার বাবা মিঠুন চাকমার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। এটা আন্দাজ করা যায়, খাগড়াছড়ি সদরের আত্মিক চাকমা যত দিন বেঁচে থাকবে, তত দিন তার নিজের জন্মদিনের আনন্দ উপভোগ করা হবে না। কিন্তু পরিবারটির মনোবেদনা এই মুহূর্তে আরও অনেক গভীর। স্ত্রী রিনা দেওয়ান জানান, বাড়ি থেকে ডেকে প্রকাশ্যে মিঠুনকে খুনের ৯ মাস পেরোলেও তদন্তকারী কেউ তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে আসেনি। তিনি এই হত্যার বিচারের ব্যাপারে আশাবাদী নন, বরং পরিবারের অন্যদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
একই রকম আশাহীন প্রতিভাস চাকমাও। তিনি ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাঁর বাবা পার্বত্য জনসংহতি সমিতির তিনবারের সম্পাদক ৬১ বছর বয়সী চন্দ্র শেখর চাকমা গুলিবিদ্ধ হন রাঙামাটির চম্পকনগরে ২০০৯ সালের ৯ আগস্ট। প্রতিভাসের মা দ্বিপ্তী চাকমাও স্বামী হত্যার বিচার পাননি। বিচার পাচ্ছেন না যুবনেতা সুদীর্ঘ চাকমার স্ত্রী অরুমিতা চাকমাও। দুই সন্তানের বাবা সুদীর্ঘ নিহত হন লংগুদুতে ২০১৩ সালের ১২ মার্চ।
চন্দ্র শেখর পার্বত্য চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের একজন। আর বর্তমান প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে মিঠুন ও সুদীর্ঘ চাকমা সুপরিচিত দুই মুখ। গত ৩ মে সেখানে একইভাবে খুন হন নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা। নিহত ব্যক্তিদের এ রকম তালিকা অনেক দীর্ঘ। অনেকটা যুদ্ধ–পরিস্থিতির ক্ষয়ক্ষতির মতো।
বয়স ও মতাদর্শনির্বিশেষে এ রকম মৃত্যু ও বিচারহীনতা সমাজে সবার জন্যই খারাপ বার্তা। এ রকম মৃত্যুর মিছিল প্রচণ্ড স্নায়ুচাপ তৈরি করে যেকোনো সমাজে। চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে কথা বলে এমন কাউকে পাওয়া যাওয়া যায় না,Ñ যাঁরা কমিউনিটি ও নিজেদের
ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী। সর্বগ্রাসী মানসিক অশান্তির শিকার তাঁরা।
জাতীয় পরিসরেও পার্বত্য পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা-আশাবাদ ক্ষীণ। অথচ এলাকাটি বাংলাদেশের এগারো ভাগের এক ভাগ। জাতীয় বাজেটের বড় এক হিস্যা খরচ হয় সেখানে। কিন্তু সেখানে অস্বস্তি কাটছে না।
দুই.
পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৬টি উপজেলায় মাত্র ১৬ লাখ মানুষের জন্য ২০ বছর ধরে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় কাজ করছে। টাকার হিসাবে রাষ্ট্র সেখানে যা খরচ করে, তা ছোট অঙ্ক নয়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরের এক পরিপত্রে দেখা যায়, শুধু পরবর্তী বছরে এই তিন জেলায় ৮২০টি প্রকল্পের পেছনে ২৬০ কোটি টাকা মঞ্জুর হয়েছে। তারপরও প্রায় স্থায়ী রূপ নেওয়া নিরাপত্তাহীনতা স্পষ্ট বলছে, অনুন্নয়নই এই জনপদের প্রধান সমস্যা নয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের চেয়েও অধিক কিছু প্রয়োজন সেখানে। সে বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য দরকার। সেই ঐকমত্য ও অঙ্গীকার না থাকায় ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তিও প্রত্যাশিত
সুফল আনেনি। আর কিছুদিন পরই ওই চুক্তির ২১ বছর পূর্তি হবে। প্রতিবছরের ২ ডিসেম্বর এলেই প্রচারমাধ্যমে পার্বত্য চুক্তির প্রত্যাশাগুলো স্মরণ করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী প্রকৃতই নির্বাহী অনেক দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের বিশ্বাসযোগ্য একটা তালিকাও প্রচারিত হয়। কিন্তু কোথাও এ রকম অনুসন্ধান নেই, কেন ওই চুক্তি স্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে স্বশাসনের ন্যূনতম বোধ তৈরি করতে পারল না, যা স্বস্তি ও শান্তির জন্য জরুরি।
পার্বত্য পরিষদগুলো কেন প্রায় ৩০ বছর অনির্বাচিত ব্যক্তিদের জিম্মায় রয়েছে, তারও পুনর্ভাবনা জরুরি। নিশ্চয়ই এগুলো মনোনীত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের জন্য ছিল না। সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হলে পার্বত্য পরিষদগুলো সবার আশা-হতাশা-ক্ষোভের মূল সুরাহাকেন্দ্র হতে পারত। সেটাই ছিল ২১ বছরের পুরোনো চুক্তির বড় অঙ্গীকার ও প্রত্যাশা। অনির্বাচিত ব্যক্তিদের পরিচালনার কারণে পার্বত্য জনজীবনে এসব পরিষদের রাজনৈতিক প্রাধান্য সৃষ্টির সুযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে অঞ্চলটির নৈতিক কর্তৃত্বের ভরকেন্দ্রও কারও হাতে নেই ।
গুম-খুনের অজ্ঞাতনামা হোতাদের জন্য এ রকম পরিস্থিতি সুবিধাজনক হলেও তরুণ-তরুণীদের সামনে তা অন্ধকারময় ভবিষ্যৎ নির্দেশ করছে। গত ২১ বছরে কয়েক শ যুবক খুন বা গুম হয়েছেন এই পরিবেশে। হারিয়ে যাওয়া অনেকে মিঠুন চাকমার মতোই স্ত্রী-পরিজন রেখে গেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে যুদ্ধ ছাড়াই অনেক যুদ্ধবিধবার দেখা মেলে। সংঘাতময় পরিস্থিতি এই নারীদের ঘরে-বাইরে বিপন্ন অবস্থায় ফেলেছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিচারহীনতার মর্মপীড়া। তরুণীদের অপহরণের মতো ভীতিকর সংস্কৃতিরও প্রসার ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারির মধ্যেও কীভাবে এসব ঘটতে পারছে, সেটাই উদ্বেগের বিষয়।
তিন.
নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে এই পরিস্থিতির দায় সেখানকার জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের দাবিদার সংগঠনগুলোরও কম নয়। তিন–চারটি উপদলে বিভক্ত পাহাড়ি সংগঠকেরা পরস্পর হানাহানির সশস্ত্র আবহে আটকা পড়েছেন। এই অন্তর্দ্বন্দ্ব সেখানে কিশোর-তরুণদের নিরাপত্তাহীনতার বড় এক উৎস। এতে পাহাড়ি রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর ইমেজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এসব সংগঠন কতটা অর্থনৈতিক স্বার্থ দ্বারা পরিচালিতÑ আর কতটা সমাজের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সক্রিয়, এ নিয়ে তীব্র হতাশা আছে। গত বছরগুলোয় চোরাগোপ্তা খুনোখুনির বাইরে রাজনৈতিক প্রসঙ্গগুলো নিয়ে আঞ্চলিক সংগঠনগুলো গঠনমূলক আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলতে পেরেছে সামান্যই। জুমিয়ারা যে ফসলের ন্যায্য দাম পান না এবং বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চলে খাদ্যাভাবের এটা যে এক বড় কারণ, সেটাও ধামাচাপা পড়ে আছে রক্তপাতের বৃত্তান্তের নিচে। সম্প্রতি কোনো তরফ থেকে দাবি ছাড়াই যে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য নির্ধারিত কোটা বাতিল হলো, তারও সোচ্চার আপত্তি তুলতে পারেনি পার্বত্য কোনো সংগঠন। এ রকম রাজনৈতিক সংগঠকেরা অবশ্য তাঁদের নিষ্ক্রিয়তার জন্য স্বাভাবিক পরিবেশের অনুপস্থিতিকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। বিবদমান প্রতিপক্ষগুলোকে সালিসে বসাতে পার্বত্য জেলাগুলোর শ্রদ্ধাভাজন অভিভাবক সমাজের অস্তিত্ব ও কর্তৃত্বও হারিয়ে গেছে বহুদিন।
জাতীয় পরিসরে রাজনৈতিক সংলাপ না থাকলেও সভা-সেমিনারে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে মাঝেমধ্যে কিছু মৃদু কথা হয়। তাতে সবাই স্বাস্থ্যকর রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য সেখানে স্বাভাবিক রাজনীতির বিকাশকে জরুরি মনে করেন। কিন্তু বর্তমান পরিবেশে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে জনগণের প্রাত্যহিক যোগাযোগ দুরূহ। ৭৫ বছর বয়সী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা, তাতিন্দ্রলাল চাকমা কিংবা তরুণ প্রসীত বিকাশ খীসা—কেউ সেখানে হত্যা ও মুক্তিপণের সংস্কৃতি রোধে কার্যকর নেতৃত্ব দিতে পারছেন না। বরং সামনে নির্বাচনী আবহে পরিস্থিতির অধিকতর অবনতির শঙ্কা করছেন অনেকে। তাতে রিনা দেওয়ানদের সংখ্যাই বাড়বে কেবল। সেই উদ্বেগই ধ্বনিত হলো অন্যতম জ্যেষ্ঠ নেতা আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য সুধাসিন্ধু খীসার কণ্ঠে। তাঁর ভাষায়, ‘আমাদের এক জায়গায় বসা কঠিন হয়ে গেছে। অথচ খুনোখুনির রাজনীতি বন্ধ না হলে পাহাড়িরা টিকতে পারবে না।’ আক্ষেপ করে বললেন, ‘আমার সন্তানেরাই আমাকে খাগড়াছড়ি যেতে দিতে চায় না।’
হতাশার এরূপ স্থায়ী আবহ ভবিষ্যতের জন্য উদ্বেগের। আত্মিক চাকমার মতো শিশুরা বড় হয়ে জানবে রাষ্ট্র তাদের বাবার খুনের বিচার করেনি। এটা তাদের মাঝে নিরাময়–অযোগ্য হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দিতে পারে। উপরন্তু তরুণী বিধবাদের ক্রমবৃদ্ধিও পার্বত্য চট্টগ্রামের সব উন্নয়নচেষ্টার ইমেজ ম্লান করে দিতে যথেষ্ট। সবচেয়ে বড় বিষয়, রিনা দেওয়ানরা মনে করছেন, তাঁদের বিচার চাওয়ার আঞ্চলিক বা জাতীয় কোনো পরিসর নেই। যুদ্ধহীন পরিবেশের এরূপ শত শত যুদ্ধবিধবা এখন কী করবেন?
এই দমবন্ধ ভয়ের সংস্কৃতি পাল্টাতে পার্বত্য পরিস্থিতি জাতীয় নীতিনির্ধারকদের কাছে পুনর্ভাবনা দাবি করছে। সর্বাগ্রে জরুরি জীবনের নিরাপত্তা এবং তরুণ-তরুণীদের মন থেকে ভয়ের আবহ দূর করা। এ দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনের নয়, জাতীয় নেতৃত্বের।
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক