সময় চিত্র

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ভ্রান্তি

ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে আমরা বিরল কিছু প্রতিক্রিয়া দেখলাম শাসক দল আওয়ামী লীগের কাছ থেকে। এই রায় একটি সর্বসম্মত রায় হলেও তা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের মূল আপত্তি অবশ্য প্রধান বিচারপতির কিছু পর্যবেক্ষণ নিয়ে। এসব নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী প্রধান বিচারপতি ও উচ্চ আদালতের প্রতি অবমাননাকর শব্দাবলি ব্যবহার করেছেন। রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে আপত্তি জানাতে প্রধান বিচারপতির বাড়িতে শাসক দলের সাধারণ সম্পাদক বৈঠকও করেছেন।

এই রায় নিয়ে রিভিউ করার বা সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের আলোকে কোনো প্রতিকার (নির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য প্রত্যাহার) চাওয়ার সুযোগ সরকারের রয়েছে। রিভিউ করার সিদ্ধান্তও সরকারের রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে এটি এখনো একটি বিচারাধীন বিষয় বলা যায়। বিচারাধীন বিষয়ে সংক্ষুব্ধ একটি পক্ষের প্রধান বিচারপতির বাসভবনে গিয়ে দেখা করার এই ঘটনা ন্যায়বিচারের অন্তরায়। এটি একটি খারাপ নজিরও বটে। রায় নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে ঘটা করে যেভাবে জানানো হয়েছে, তা-ও বিরল একটি ঘটনা। এককথায় এই রায় নিয়ে শাসক দলের প্রতিক্রিয়া অভাবনীয় ও অভূতপূর্ব!

এই প্রতিক্রিয়া একই সঙ্গে ভ্রান্তও অনেক ক্ষেত্রে।

২.

মোটা দাগে শাসক দলের প্রতিক্রিয়াগুলোকে আমরা দুভাবে ভাগ করতে পারি। একটি আইনগত ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, অন্যটি স্রেফ মেঠো বক্তৃতা ধরনের। মেঠো বক্তৃতা নিয়ে বেশি আলোচনার কিছু নেই। কিন্তু এই মেঠো বক্তৃতা যদি আদালত অবমাননার দায়ে ইতিমধ্যে দোষী একজন মন্ত্রী কিংবা সরকারের একজন কর্মরত সচিবের কাছ থেকে আসে, তবে তা নৈরাজ্যকর বলে বিবেচিত হওয়ার মতো। বিচার ও আইনকাঠামো বলে দেশে সত্যি কিছু থাকলে অবশ্যই এ দুজনের বক্তব্য উচ্চ আদালতের ধর্তব্যের মধ্যে নেওয়া উচিত।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সরকারের লোকজন আইনগত কিছু যুক্তি দিয়েছেন। তাঁরা এই রায় প্রদানে উচ্চ আদালতের এখতিয়ার নিয়ে পর্যন্ত প্রশ্ন তুলেছেন। এই প্রশ্নটি তোলার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। বাংলাদেশের সংবিধান নিজেই উচ্চ আদালতকে সংবিধানের রক্ষকের মর্যাদা দিয়েছে। সংবিধানের মৌলিক কাঠামো (বেসিক স্ট্রাকচার) রক্ষার প্রয়োজনে উচ্চ আদালত সংসদ কর্তৃক প্রণীত যেকোনো সংবিধান সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করার ক্ষমতা রাখেন। ইতিপূর্বে সংবিধানের আরও চারটি সংশোধনী (পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, ত্রয়োদশ) এই তত্ত্বের আলোকেই বাতিল বলে ঘোষিত হয়েছে।

ভারতে কেশবানন্দ মামলার রায়ের পরবর্তী সময়ে বেসিক স্ট্রাকচার বলতে আসলে সংবিধানের কোনো নির্দিষ্ট বিধানকে (যেমন আমাদের সংবিধানের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল-সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ) নাকি বিশেষ নীতিকে (যেমন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা) বোঝায়, এ নিয়ে বহু বিচারিক বিতর্ক হয়েছে। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের বিরোধিতায় এসব তাত্ত্বিক বিতর্কের ছায়ামাত্র নেই, এতে সরাসরি উচ্চ আদালতের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। ইতিপূর্বে চারটি সংশোধনী বাতিলের রায়ে আওয়ামী লীগ কখনো এ ধরনের প্রশ্ন তোলেনি। সে ক্ষেত্রে এখন শুধু ষোড়শ সংশোধনীর ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের এখতিয়ার নিয়েপ্রশ্ন তোলা নৈতিকভাবেও সঠিক নয়।

সংবিধান সংশোধনীর ক্ষেত্রে শুধু উচ্চ আদালতের নজরদারি নয়, গণভোটের মাধ্যমে সংসদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ বা সীমাবদ্ধ করার বিধান পৃথিবীর বহু সংবিধানে রয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে গণভোটের বিধানটি তুলে দেওয়ার পর এখন উচ্চ আদালতের ক্ষমতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। কিন্তু সংবিধান সংশোধনে সংসদের ক্ষমতা যদি পুরোপুরি অবাধ হয়, তাহলে সংবিধানের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব (সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ) কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না।

উল্লেখ্য, আমাদের সাংসদেরা নিজেরাই ২০১১ সালে সংবিধানের ৭খ অনুচ্ছেদে সংবিধানের অর্ধশতাধিক বিধানকে অপরিবর্তনীয় বলে এক ঢালাও বিধান করে রেখেছেন। যে সংসদ ভবিষ্যতের সমস্ত সংসদের সংবিধান সংশোধনীর ক্ষমতাকে বহুলাংশে নাকচ করে রেখেছে, সে সংসদ তার নিজের ক্ষমতাকে অবারিত ভাবে কীভাবে? আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন যে সংসদ নিজেই ১৯৭২ সালের বহু বিধানকে বাতিল বা হেয় করে সামরিক ফরমানবলে প্রতিষ্ঠিত বিধানকে (যেমন রাষ্ট্রধর্ম, জাতীয়তা, নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ) পঞ্চদশ সংশোধনী বলে সংবিধানে স্থান দিয়েছে, তারা ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের ক্ষেত্রে ১৯৭২ সালের সংবিধানকে রক্ষার প্রসঙ্গই তোলে কীভাবে?

৩.

ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে তবু সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিজেকে সংক্ষুব্ধ ভাবতে পারে। এই সংশোধনী এবং এর আলোকে খসড়া আইনটির মাধ্যমে সরকার উচ্চ আদালতকে সম্পূর্ণভাবে নিজের করায়ত্ত রাখতে চেয়েছিল। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ার কারণে তা আর করা যাবে না আপাতত। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা রক্ষার্থে ১৯৭২ সালের ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপনের গুরুত্বও তুলে ধরা হয়েছে। এসব নিয়ে আওয়ামী লীগের মনোবেদনা থাকতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া এখানে সীমাবদ্ধ থাকেনি।

রায়ে প্রধান বিচারপতিরপর্যবেক্ষণে রাজনৈতিক ইতিহাস, দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচনী ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ বেশি ÿক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে এসব নিয়ে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, এসব পর্যবেক্ষণ অপ্রাসঙ্গিক ও উদ্দেশ্যমূলক। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে উচ্চ আদালতের রায়ে এ ধরনের পর্যবেক্ষণ নতুন নয়। গত আট বছরে সাংবিধানিক বিভিন্ন রায়ের পর্যবেক্ষণে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে এমন বহু কিছু বলা হয়েছে, যার সঙ্গে বিচার্য বিষয়ের সরাসরি সম্পর্ক নেই। যে খায়রুল হক নিজে ষোড়শ সংশোধনী রায়ের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন, তাঁরই বিভিন্ন রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের প্রতি বহু বক্তব্য, এমনকি স্মৃতিচারণামূলক কাহিনির বিবরণ রয়েছে, যার সঙ্গে মামলার মূল বিষয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।

রায়ের  পর্যবেক্ষণে কী বলা যাবে, তা নিয়ে বাংলাদেশে কোনো বিচারিক দর্শন বা সুপ্রতিষ্ঠিত রেওয়াজ নেই। আমরা অতীতে বিচারপতি মোস্তাফা  কামাল, বদরুল হায়দার চৌধুরী এবং পরে বিচারপতি এম এ মতিন বা আবদুর রশীদের রায়ের পর্যবেক্ষণে যে পরিমিতিবোধ, গভীরতা ও প্রাসঙ্গিকতা পেতাম, তা পরবর্তী সময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রায়ে পাওয়া যায়নি। এসব কিছু রায়ে সাংবিধানিক ইতিহাস বর্ণনার সময়ও দৃষ্টিকটু ধরনের বিচ্যুতি (যেমন সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া) দেখা গেছে। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর্যবেক্ষণে সে তুলনায় অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক ও যথোচিত বক্তব্য রয়েছে।

যেমন এই রায়ে সংসদীয় গণতন্ত্রকে অপরিপক্ব বলা হয়েছে। যে সংসদের হাতে উচ্চ আদালতের বিচারকদের চাকরিচ্যুতির পুরো ক্ষমতা তুলে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, তার পরিপক্বতা নিয়ে রায়ে বক্তব্য থাকাই স্বাভাবিক। আর সংসদে বিতর্কের মান, সাংসদদের অংশগ্রহণের হার, কমিটিগুলোর কার্যক্রম, প্রণীত আইনের দুর্বলতা এবং জনগুরুত্বপূর্ণ বহু বিষয় (যেমন গুম, রামপাল প্রকল্প, নিয়োগ-বাণিজ্য) স্রেফ এড়িয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রকে অপরিপক্ব বলায় ভুল কোথায়?

সরকার বিশেষভাবেÿ ক্ষুব্ধ হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে ইঙ্গিত করে একটি বক্তব্য প্রদান করা হয়েছে বলে। কিন্তু এটি বঙ্গবন্ধুকে ইঙ্গিত করে বা তাঁকেই মিন করা বলা হয়েছে, এমন কোনো প্রমাণ আছে কি? তাহলে তা নিজে নিজে বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিরূপ মন্তব্য হিসেবে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন কী?

ভবিষ্যতে বিএনপি বা অন্য কেউ যদি রায়ের পর্যবেক্ষণকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে, তাতেও বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। স্বাধীনতাযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব বাংলাদেশের সংবিধান, ইতিহাস ও আত্মোপলব্ধির মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত। একটি রায়ের পর্যবেক্ষণের কোনো অস্পষ্ট ইঙ্গিত তা কোনোভাবেই ম্লান বা দুর্বল করতে পারবে না।

এই রায়ে আবেগাপ্লুত প্রতিক্রিয়ার আরও বহু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু যে আবেগ নিজের জন্য অনিষ্টকর এবং অন্যের জন্য অবোধগম্য, তা প্রকাশে সংযত থাকাই শ্রেয়।

৪.

ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে সরকার ও আওয়ামী লীগের নেতারা ইতিমধ্যে বহু বেসামাল বক্তব্য দিয়েছেন। আমি মনে করি, এর কোনোই প্রয়োজন ছিল না। সরকারের যা বক্তব্য, তা রিভিউ আবেদনেই বলা উচিত।

এই রায়ে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উল্লাসে আওয়ামী লীগ অস্বস্তিবোধ করছে। আওয়ামী লীগের বরং উচিত একই কৌশল গ্রহণ করা। রায়ে অন্য পক্ষের প্রতি অস্বস্তিকর মন্তব্যগুলো রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার দিকে মন দেওয়া।

এই রায়ে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র ও সুশাসনের অভাবের বহু বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বেশি উচিত, এ অবস্থার উন্নয়নে আন্তরিক প্রচেষ্টা নেওয়া।

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।