মতামত

রাষ্ট্রের চাপে ‘নাগরিক’ নেই

বিশ্বজুড়েই চলছে গণতন্ত্রের খরা। প্রতিবছরই বাড়ছে এই খরার তীব্রতা। বলা হয়ে থাকে, গণতন্ত্রের নাকি জোয়ার-ভাটা চলে। গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের জন্য দুঃসংবাদ, বেশ কিছু বছর ধরেই চলছে ভাটার টান। দেশে দেশে নির্বাচনের মধ্য দিয়েই ক্ষমতায় যাচ্ছে এমন সব শাসক, ভোটের মাঠে যাদের অস্ত্র বর্ণবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ আর ধর্ম। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি বিভাজন, ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা আর মানুষে মানুষে দেয়াল। যেখানে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়েও দেশে দেশে রোপিত হচ্ছে স্বৈরতন্ত্রের বীজ, সেখানে একটি দেশে যদি নির্বাচনব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস করে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে থাকে একটি সরকার, তাহলে তার অবস্থাটা কী, তা সহজেই অনুমেয়।

সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি-ডেম ইনস্টিটিউট বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘অটোক্র্যাটাইজেশন গোজ ভাইরাল’ শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, উদার গণতান্ত্রিক সূচকে ১৭৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫৪; স্কোর শূন্য দশমিক ১। ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল যথাক্রমে ১৩৬, ১৩৫, ১৪৫, ১৫৪, ১৫৪। গত বছর আর চলতি বছরের অবস্থান এক থাকলেও গতবারের চেয়ে এ বছর স্কোর কমেছে শূন্য দশমিক শূন্য ১৯। অর্থাৎ বাংলাদেশের পরিস্থিতির ক্রমাবনতি হচ্ছে।

প্রতিবেদনে ‘নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রের সূচকে’ও বাংলাদেশের অবনমন হয়েছে। এই সূচকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ১৩৮, স্কোর শূন্য দশমিক ২৭। স্কোর কমেছে প্রায় শূন্য দশমিক শূন্য ৩১। এ ছাড়া উদারতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬১। সমতা সূচকে ১৭৬, অংশগ্রহণমূলক সূচকে ১৪৩ এবং স্বেচ্ছামূলক সূচকে বাংলাদেশ ১৫৮তম অবস্থানে আছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শাসনতান্ত্রিক দিক থেকে বাংলাদেশ আছে ‘নির্বাচনভিত্তিক স্বৈরতন্ত্র’ বিভাগে। এর অর্থ হলো, এ দেশে গণতন্ত্র ক্ষয়িষ্ণু। আর সে জায়গা দখল করে নিচ্ছে স্বৈরতন্ত্র।

গণতন্ত্রকে মূলমন্ত্র ধরে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে যে দেশটির জন্ম হয়েছিল, সেটি এখন ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের মতে হাইব্রিড রেজিম, ফ্রিডম হাউসের মতে আংশিক মুক্ত, কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশ আসলে একটি স্বৈরতান্ত্রিক দেশ যা ২০১৮ সালেই জার্মান গবেষণা সংস্থা বেরটেলসম্যান স্টিফস্টুং পরিষ্কার ভাষায় ব্যক্ত করেছে। এ সংস্থার ২০২০ সালে প্রকাশিত দেশভিত্তিক বেরটেলসম্যান ট্রান্সফরমেশন ইন্ডেক্স (বিটিআই) বলছে, ২০০৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন সূচকের তুলনা করলে দেখা যায়, নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার-সম্পর্কিত ২০টি সূচকেই বাংলাদেশের অবস্থান নিম্নমুখী।

বাংলাদেশের স্বৈরতান্ত্রিকতার স্বীকৃতি এখন আসছে নানা দিক থেকে। ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে দেওয়া এক যৌথ বিবৃতিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ সাতটি মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট এবং ৭৪-এর বিশেষ ক্ষমতা আইনের উল্লেখ করে বলা হয়, এই করোনাকালে সরকার তার কর্তৃত্ববাদী শাসন আরও বেশি পোক্ত করেছে। ফ্রিডম হাউসের সর্বশেষ রিপোর্টে ইলেক্টোরাল ডেমোক্রেসির তালিকায় বাংলাদেশ আর নেই, যার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার লেশমাত্র নেই।

এ ধরনের সরকার থাকার অবধারিত কিছু মাশুল আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গণমাধ্যমকে ভয় দেখানো, সরকারপন্থী গণমাধ্যম সৃষ্টি, রাষ্ট্রীয় সংস্থার দলীয়করণ, বিরোধীদের ওপর কঠোর নজরদারি, বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ, ভীতি সৃষ্টি, নির্বাচনে কারচুপি ইত্যাদি। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবাধিকার-সম্পর্কিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এর স্পষ্ট প্রতিফলন আছে। প্রতিবেদনটিতে নির্যাতন, কারাগারের বৈরী পরিস্থিতি, বেআইনিভাবে আটক, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন, সহিংসতা, বেআইনিভাবে সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের গ্রেপ্তার, সেন্সরশিপ আরোপ, সাইট ব্লকিং, শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়া ও সংগঠনের অধিকার হরণ, চলাচলের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধ ও সহিংসতা, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সদস্যদের প্রতি সহিংসতা ও হুমকি, সমকামীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, শ্রমিক সংগঠন ও ইউনিয়ন গঠনে কঠোরতা এবং শিশুশ্রমের মতো বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে।

দ্য ন্যারো করিডর: স্টেইটস, সোসাইটিজ অ্যান্ড দ্য ফেইট অব লিবার্টি বইতে একটা শক্তিশালী রাষ্ট্রের পক্ষে কথা বলেছেন ড্যারন এসেমাগলু ও জেমস রবিনসন। তাঁরা বলেছেন, রাষ্ট্রকে হতে হবে বাইবেলে বর্ণিত সামুদ্রিক দানব লেভায়াথানের মতো শক্তিশালী, রাষ্ট্রের প্রান্তিক মানুষটিরও স্বার্থও সে রক্ষা করবে। কিন্তু এর একটা বিপদও আছে, শক্তির দাপটে লেভায়াথান এমন সব ক্ষেত্রে চলে যেতে চাইবে, আখেরে যেগুলো আবার নাগরিকের স্বাধীনতায় চরম বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। এটাকে তারা বলছেন ‘স্বৈরাচারী লেভায়াথান’ পরিস্থিতি। তাঁদের মতে, দুর্বল রাষ্ট্র যেহেতু নাগরিকদের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর, তাই ‘লেভায়াথানহীন’ পরিস্থিতিও কোনোভাবেই কাম্য নয়। সব দিক বিবেচনায় তাঁরা বলেন, রাষ্ট্র নামের এই লেভায়াথান থাকবে, তবে এটা পুরোপুরি স্বাধীন হতে পারবে না। এটিকে হতে হবে শৃঙ্খলিত।

লেভায়াথানকে শৃঙ্খলিত করতে পারে স্বাধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং দৃঢ় সামাজিক শক্তি। একটা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর থাকলেও ঝুঁকি থাকে। পরস্পরের ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ নিশ্চিত না করে সেগুলোর একত্রে মিলে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। সামাজিক শক্তিকে সেই ক্ষেত্রে পরাক্রমশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়াই করতে হয়।

চিন্তায়-চেতনায় সমাজকে হতে হবে শক্তিশালী, যাতে সে তার নিজস্ব একটা সত্তা নিশ্চিত করতে পারে। প্রবল শক্তিশালী রাষ্ট্রকে সে একটা চৌহদ্দি ঠিক করে দেবে, যার বেশি রাষ্ট্র যেতে পারবে না। এভাবে একটা শক্তিশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে যদি একটা শক্তিশালী সামাজিক শক্তি থাকে, তাহলে পরস্পরবিরোধী এই দুই বলের প্রভাবে একটা জায়গা তৈরি হয়, যেখানে নাগরিকেরা তাঁদের স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারেন। এটাই সেই সংকীর্ণ করিডর।

বাংলাদেশে ২০১৪ সালের পর থেকে রাষ্ট্রের সব অঙ্গ কার্যত নির্বাহী বিভাগের অধীনস্থ হয়ে পড়েছে। তৃণমূল পর্যায়েও দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে পরিকল্পিতভাবে সামাজিক শক্তিকে ধ্বংস করা হয়েছে। হ্যাঁ, এই রাষ্ট্রে সামাজিক শক্তি বলে কিছুরই আর অস্তিত্ব নেই। এসেমাগলু ও রবিনসন রাষ্ট্রের ক্ষমতায়নের যে পরিস্থিতিকে ‘স্বৈরাচারী লেভায়াথান’ বলেছেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হওয়ায় এবং কার্যকর সামাজিক শক্তির অনুপস্থিতিতে আমাদের দেশ এখন সেই দিকেই এগোচ্ছে।

পরিণতিতে গত কয়েক বছরে আমরা দেখছি, মানুষের একেবারে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র বনাম নাগরিকের লড়াইয়ে যেখানে নাগরিকের কোনো অস্তিত্বই আর থাকে না, সেখানে মানবাধিকার, মানবিক মর্যাদা আর ইনসাফ তো বহু পরের কথা।

রুমিন ফারহানা বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী