দেশে বিরাজমান বৈষম্যের প্রকটতা নিয়ে মানুষ শুধু উদ্বিগ্নই নয়, এর ক্রমবর্ধমান প্রবণতায় ব্যাপকভাবে হতাশও। মৃত্যুর অল্প আগে এ উদ্বেগ ও হতাশার কথা তুলে ধরে নিবন্ধ লিখেছিলেন অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ (মৃত্যু: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১)। জবাবে সরকারের শিল্প উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা যা বলেছিলেন, এর সারমর্ম হচ্ছে, উন্নয়ন হলে বৈষম্য হবেই। এর মানে হচ্ছে, বৈষম্য রোধে ব্যবস্থা গ্রহণে সম্মত হননি তিনি। ফলে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বৈষম্য বেড়েই চলেছে, যা ড. আকবর আলি খান ২০ ডিসেম্বর সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের আলোচনায় বিস্তারিত তুলে ধরে বলেছেন, ‘সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বৈষম্য বাড়ছে’ (প্রথম আলো, ২১ ডিসেম্বর ২০২১)। অন্যদিকে, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে ২৪ ডিসেম্বর অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, ‘সম্পদ বণ্টনে এখানে বড় ধরনের অন্যায্যতা আছে’ (প্রথম আলো, ২৫ ডিসেম্বর ২০২১)।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৩ বছর সংগ্রাম করে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত রাষ্ট্র কেন বৈষম্যকে পৃষ্ঠপোষকতা দেবে? তা ছাড়া রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দানের বিষয়টি শুধু যে নৈতিকভাবেই অগ্রহণযোগ্য তা–ই নয়, সাংবিধানিকভাবেও অবৈধ। ফলে, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত স্বার্থে যিনি বা যাঁরাই এ পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন, তাঁরা বস্তুত সংবিধান লঙ্ঘন করছেন। সংবিধানের ১৯ (২) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে, ‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ এ অবস্থায় উচ্চতর প্রবৃদ্ধির নামে সাধারণ মানুষকে প্রান্তে ঠেলে দিয়ে রাষ্ট্রের সিংহভাগ সম্পদ মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগীর হাতে তুলে দিয়ে তাদের নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিকৌশল বাংলাদেশের সংবিধান কিছুতেই অনুমোদন করে না।
সামরিক শাসন যেমন অবৈধ কিংবা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী (পরে বিলুপ্ত) যেমন বৈধ নয়, তেমনি বিশেষ শ্রেণিগোষ্ঠীকে সম্পদ-সুবিধাদানের উদ্দেশ্যে প্রণীত নীতিকাঠামো এবং এসবের আওতাধীন সিদ্ধান্তও একইভাবে অবৈধ। ফলে, শুধু বৈষম্য হ্রাসের জন্যই নয়, সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্নেও অবিলম্বে এসব সিদ্ধান্ত বাতিল বা সংশোধন হওয়া উচিত। করোনাকালে গৃহীত যেসব বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্তের কারণে বিতরণকৃত প্রণোদনা তহবিলের ৬৫ শতাংশ বিত্তবানেরা, ২৩ শতাংশ মাঝারিরা এবং মাত্র ৫ শতাংশ কৃষকেরা পেল, সংবিধানের উপরিউক্ত নির্দেশনার আলোকে সেসব সিদ্ধান্তকে অন্যায্য বলতে দ্বিধা থাকার কোনোই কারণ নেই।
বৈষম্যের পরিধি এখন দুর্নীতির মতোই সর্বত্রব্যাপী হয়ে ওঠার কারণে এ নিয়ে আলোচনাও এখন ব্যাপকতা লাভ করেছে। বিবেকবান বুদ্ধিজীবী থেকে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ সবার মুখেই এ নিয়ে উদ্বেগজনক আলোচনা। কিন্তু শুধু আলোচনায় কী হবে? প্রয়োজন তো ব্যবস্থার পরিবর্তন, যার ছিটেফোঁটা ওপরে উল্লেখ করা হলো। বস্তুতই ‘পৃথিবীকে সবাই শুধু ব্যাখ্যা করেছেন, আসলে প্রয়োজন একে পরিবর্তন করা’—কার্ল মার্ক্সের বহুল আলোচিত এ উক্তি বাংলাদেশের চলমান বাস্তবতায় এতটাই প্রাসঙ্গিক, মনে হয় যেন বাংলাদেশকে সামনে রেখেই তিনি এ উক্তি করেছিলেন।
বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে গত ৫০ বছরের অর্জন-অনর্জন নিয়ে নানামাত্রিক যেসব গবেষণা, সমীক্ষা, মূল্যায়ন, বিচার-বিশ্লেষণ ও লেখালেখি হয়েছে, তার সারসংক্ষেপ করলে দাঁড়ায় এই, এ সময়ের মধ্যে কৃষি উৎপাদন, দারিদ্র্য বিমোচন, গড় আয়ুষ্কাল, শিশু ও প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর হার, নারীশিক্ষার হার, মাথাপিছু আয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। অন্যদিকে, অংশগ্রহণভিত্তিক অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তোলা, স্বনির্ভর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা, সম্পদের সুষম বণ্টন, শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন, নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ, মূলধারার সংস্কৃতিচর্চা ইত্যাদি ক্ষেত্রে দেশ এগোতে তো পারেইনি, বরং বহু ক্ষেত্রে পিছিয়ে গিয়েছে। তবে অর্থনীতিসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে এ তথ্য যে দেশে সম্পদবৈষম্য রীতিমতো পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এবং এর সবটাই ঘটছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশ। বহুল আলোচিত ওয়েলথ এক্সের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০-১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ হারে।
দেশে বৈষম্যের মাত্রা বর্তমানে যে হারে বাড়ছে, তাতে মনে হতে পারে, এ থেকে শিগগির মুক্তি পাওয়ার হয়তো কোনো উপায়ই নেই। ক্ষমতাকাঠামোর বর্তমান বিন্যাসের দিকে তাকালে তেমন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, সম্পদ বণ্টনসংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো যাঁরা নিচ্ছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা সুবিধাভোগী বিত্তবানদেরই প্রতিনিধি, অর্থাৎ নিজেদের সম্পদ অর্জনের সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাঁরা নিজেরাই নিচ্ছেন। ফলে, খুব স্বাভাবিকভাবেই এ প্রক্রিয়ায় গৃহীত বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত তাঁদেরসহ অন্য বিত্তবানের পক্ষে যাচ্ছে। তাই এ ব্যবস্থা না পাল্টালে সম্পদের বিদ্যমান বণ্টনপ্রক্রিয়া থেকে ভিন্নতর সিদ্ধান্ত না পাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বিষয়টিকে আশাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখারও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা যদি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম এবং সংবিধানের অঙ্গীকার ও বাধ্যবাধকতার দিকে তাকিয়ে সাধারণ মানুষের প্রতি মমতাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাদের পক্ষে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দানের অগ্রাধিকারগুলো সে অনুযায়ী বদল করতে সম্মত হন, তাহলে খুব সহজেই বিষয়টির সমাধান হয়ে যায়। আর সে আশাবাদকে সামনে রেখেই যে বিষয়গুলো বৈষম্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে সর্বাধিক ভূমিকা রাখছে, সেগুলোর প্রতি সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হলো।
শেষোক্ত বিষয়গুলো হচ্ছে: এক. একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে উদ্যোক্তাদের সবাইকে বা তাদের অংশবিশেষকে বিভিন্ন ধরনের ভর্তুকি ও আর্থিক প্রণোদনাদানের দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অনেক দেশেই রয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক বিকাশের উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পর অত্যন্ত যৌক্তিকভাবেই সেগুলো আবার প্রত্যাহারও করে নেওয়া হয়। ২ হাজার ৫৫৪ ডলার মাথাপিছু আয় নিয়ে বাংলাদেশ এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। ফলে, এ বর্ধিত সক্ষমতা অর্জনের কারণে খুব স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশকে এখন বহু শুল্ক ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা হারাতে হবে। বিষয়টি অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্যও প্রযোজ্য। বাংলাদেশের তাই উচিত হবে সব পর্যায় থেকে অবিলম্বে সব ধরনের নগদ প্রণোদনাদানের রীতি প্রত্যাহার করে নেওয়া, যার সিংহভাগই এখন ভোগ করছে তৈরি পোশাকসহ বিত্তঘেঁষা কতিপয় বিশেষায়িত খাত। দুই. কৃষিঋণ ব্যতীত অন্য কোনো ঋণের সুদের হার হ্রাস এবং এর আসল বা সুদের কোনো অংশ মওকুফ করা যাবে না, যে সুবিধার সিংহভাগই বর্তমানে ভোগ করছে বিত্তবানেরা। তিন. প্রকৃত কৃষক কর্তৃক সরাসরি ব্যবহার্য কৃষি উপকরণ ব্যতীত অন্য কোনো ক্ষেত্রে কর ও শুল্ক মওকুফের সুবিধা দেওয়া যাবে না। চার. জ্বালানি তেল, সয়াবিন, পরিবহনভাড়া ইত্যাদির মতো পণ্য ও সেবার মূল্য নির্ধারণে সাধারণ ভোক্তার স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। পাঁচ. জাতীয় বাজেটের আওতাধীন অধিকাংশ ব্যয় খাত কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে না রেখে স্থানীয় সরকারের হাতে ছেড়ে দিতে হবে এবং স্থানীয় সরকারকে বাজেট প্রণয়ন, রাজস্ব আহরণ ও অর্থ ব্যয়ের ক্ষমতা দিতে হবে। ছয়. একই ধারাবাহিকতায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আদায়ের পরিধি সংকুচিত করে তা আহরণের দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত করতে হবে। এবং সাত. আইন বিভাগ ও কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের সদস্যদের স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রেখে সেগুলো স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে সম্পাদন করতে হবে। এ তালিকা অবশ্যই আরও দীর্ঘ। তবে এটুকু নিয়ে যাত্রা শুরু করতে সম্মত হলে ক্রমান্বয়ে বাকিটাও সম্ভব হবে বলে মনে করি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এটুকু করতেই কি রাজি হবে?
বৈষম্যের পরিধি এখন দুর্নীতির মতোই সর্বত্রব্যাপী হয়ে ওঠার কারণে এ নিয়ে আলোচনাও এখন ব্যাপকতা লাভ করেছে। বিবেকবান বুদ্ধিজীবী থেকে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ সবার মুখেই এ নিয়ে উদ্বেগজনক আলোচনা। কিন্তু শুধু আলোচনায় কী হবে? প্রয়োজন তো ব্যবস্থার পরিবর্তন, যার ছিটেফোঁটা ওপরে উল্লেখ করা হলো। বস্তুতই ‘পৃথিবীকে সবাই শুধু ব্যাখ্যা করেছেন, আসলে প্রয়োজন একে পরিবর্তন করা’—কার্ল মার্ক্সের বহুল আলোচিত এ উক্তি বাংলাদেশের চলমান বাস্তবতায় এতটাই প্রাসঙ্গিক, মনে হয় যেন বাংলাদেশকে সামনে রেখেই তিনি এ উক্তি করেছিলেন। আমরা কি আমাদের বোধ ও মনন দিয়ে তা উপলব্ধি করে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের জন্য উদ্যোগী হব?
আবু তাহের খান গবেষক ও প্রাবন্ধিক
atkhan56@gmail.com