উন্নয়নশীল দেশে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল মেলে কি না, তা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা কয়েক দশক ধরেই চলছে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ হলো দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতা। বিকল্প হিসেবে বেসরকারীকরণ, সংস্কার ও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের টোটকা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিল্প জাতীয়করণ নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, এম ফাওজুল কবির খানের উইন: হাও পাবলিক এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ক্যান ট্রান্সফর্ম দ্য ডেভেলপিং ওয়ার্ল্ড বইয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ বিষয়ে নতুন করে আলোকপাত করা হয়েছে। তাতে কিছু গৎবাঁধা ধারণার অবসান ঘটেছে বলেই ধরে নেওয়া যায়।
লেখকের বক্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গঠিত প্রতিষ্ঠান যে সফলতার মুখ দেখতে পারে, তার নজির হচ্ছে ইডকল বা ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড। এটি বাংলাদেশের শতভাগ রাষ্ট্রমালিকানাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৭ সালের ১৪ মে বাংলাদেশ সরকার এটি প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠানটি অবকাঠামো, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও জ্বালানি সাশ্রয়ী প্রকল্পে অর্থায়ন করে। লেখক এম ফাওজুল কবির খান এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী ছিলেন। এই কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ছিল মাত্র ১ লাখ টাকা। আর ইডকলের ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন দাঁড়িয়েছে ৬৫০ কোটি টাকা। কোম্পানির ২২ বছরের অগ্রযাত্রা দেখে বোঝা যায়, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ বিফলে যায়নি।
বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে লেখক এম ফাওজুল কবির খান বলছেন, বাংলাদেশে সরকারি কার্যালয়ে শিকড় গেড়ে বসা অদক্ষ ও গয়ংগচ্ছ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে ইডকলকে কাজ করতে হয়েছে। সেখান থেকে উঠে আসতে তাদের এনজিও, বেসরকারি খাত ও বিদ্যায়তনের সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে। এটাই ছিল চ্যালেঞ্জ। কারণ, শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অনেক দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান এ–জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে চায় না। গহিন গ্রামাঞ্চলে ইডকল যেভাবে মানুষকে মৌলিক বিদ্যুৎ–সেবা পৌঁছে দিতে সহায়তা করেছে, বিশ্বে আর কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান তা করতে পেরেছে কি না সন্দেহ। এ সফলতার ফসল হলো দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেখানে দাতাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, সেখানে দাতারা ইডকলে বিনিয়োগ করতে উল্টো মুখিয়ে থাকে। ফলে দাতা-সমর্থিত প্রকল্প হিসেবে কাজ শুরু করলেও পরে স্থায়ী প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে ইডকল।
বিষয়টি হচ্ছে কারখানা বা কোম্পানি সরকারি হলেই জবাবদিহি থাকবে না বা সেখানে বিস্তর দুর্নীতি হবে, এসব একধরনের গৎবাঁধা কথা। সবকিছুই নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের ওপর। মধ্যম সারির ও সম্মুখসারির কর্মীদের স্পৃহা প্রতিষ্ঠানকে শক্তি জোগায়। ফলে স্বাধীনতার পর শিল্পের জাতীয়করণের কারণেই যে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার হয়েছিল, এই কথা ধোপে টেকে না। অনেক উন্নয়নশীল দেশেই প্রথম দিকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের আধিক্য থাকে। দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান বা চীনের কথাই ধরুন না, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ তাদের উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ধীরে ধীরে সেখানে বেসরকারি খাতের বিকাশ ঘটেছে। এখনো চীনে রাষ্ট্রীয় খাত বড়। সেখানে অবশ্য কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আছে।
সুশাসন নিশ্চিত করাটাই বড় কথা। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, অদক্ষতা, দূরদৃষ্টির অভাব থাকলে কোনো উদ্যোগই সফলতার মুখ দেখবে না—এসব এখন বলা বাহুল্য।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু পরিকল্পনা কমিশন গঠন করে জাতির সবচেয়ে মেধাবী মানুষদের দায়িত্ব দেন। কিন্তু সেই কমিশন কীভাবে আমলাতন্ত্রের চাপে ভেঙে পড়ে, আমরা তা জানি। কিছু মানুষকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কঠোর হতে হয়।
ফাওজুল কবির খান বিবৃত একটি ঘটনা উল্লেখ করা যাক। তিনি প্রধান নির্বাহী থাকাকালীন এক নিয়োগ পরীক্ষা হয়। তাতে সর্বোচ্চ নম্বর পান আইবিএ স্নাতক এক হিন্দু নারী। নিয়োগ বোর্ডের এক সদস্য আপত্তি জানালেন, বললেন, হিন্দু মেয়ে নিয়োগ দেওয়া ঠিক হবে না। এ ঘটনায় এম ফাওজুল কবির খান দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘নিয়োগের ব্যাপারে আমাদের নিরপেক্ষ থাকতে হবে। আর মেয়েটি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে।’ যাহোক, শেষ পর্যন্ত এম ফাওজুল কবিরের অনমনীয়তার কারণে বাকি সেই সদস্য ক্ষান্ত দেন এবং মেয়েটি নিয়োগ পায়। নতুন দক্ষ মানুষদের সঙ্গে অভিজ্ঞদের মেলবন্ধন ঘটাতে গিয়েও তিনি অনেক বিপত্তির মুখে পড়েছেন। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তিনি এসব সমস্যা মোকাবিলা করেছেন।
চাইলে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ কী করতে পারে, তার জলজ্যান্ত নজির ইডকল। এমন একসময়ে তারা এটা করেছে, যখন দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন একরকম স্থবির ছিল। ফলে বহু মানুষ সৌরবিদ্যুতের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে। সমস্যা এসেছে, তার ত্বরিত সমাধান করেছেন এম ফাওজুল কবির খান। আমলাতন্ত্রের মানুষ হিসেবে এসব করা অনেক ক্ষেত্রে সহজ হয়েছে। কোনো বেসরকারি উদ্যোগের পক্ষে এভাবে সৌরবিদ্যুতে ঋণ দেওয়া সম্ভব হতো কি না, বলা সত্যি মুশকিল।
● প্রতীক বর্ধন প্রথম আলোর সহসম্পাদক
bardhanprotik@gmail.com