রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম কি এভাবেই চলবে?

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

বাংলাদেশের চারদিকে পৃথিবী ঘোরে এবং দুনিয়ার সবাই নিয়ম করে বিটিভি দেখে আর বেতার শোনে—গেল কয়েক দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের সম্প্রচার নিয়ে এ দেশের রাজনীতিবিদ আর আমলাদের কর্মকাণ্ড দেখে আমাদের এই-ই মনে হয়। বিটিভি দেশের একমাত্র টেরিস্ট্রিয়াল চ্যানেল, এর নেটওয়ার্ক প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকাজুড়ে। বিটিভির বিরাট সম্ভাবনা ছিল দায়িত্বশীল ও দর্শকপ্রিয় গণমাধ্যম হিসেবে বিকশিত হওয়ার। কিন্তু সে আশার রুটিতে কেবলই পিঁপড়ে। 
প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, ‘বাধ্য না হলে এখন কেউ বিটিভি দেখে না। এটা মূলত সরকার ও সরকারি দলের নেতা-সমর্থকদের প্রচারযন্ত্রে পরিণত হয়েছে...এক দশক আগেও বিটিভির বছরে লাভ ছিল ৫২ কোটি টাকা, আর এখন লোকসানের পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি টাকা।’ (১১ নভেম্বর, ২০১৪) কেন বিটিভির এ অবস্থা? বিভিন্ন সরকারের অবহেলা ও ভুল নীতি, ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগপদ্ধতি এবং অযৌক্তিক পদোন্নতি এই প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। বিটিভি এখন আমলানির্ভর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সব উঁচু পদে রাজনৈতিক বিবেচনায় এমন আমলাদের নিয়োগ করা হয়েছে, সংবাদমাধ্যম চালানোর পেশাগত দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা যাঁদের নেই। প্রতিটি সরকারই নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য চ্যানেলটি ব্যবহার করেছে। এতে সরকার কতটা লাভবান হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু বিটিভির যে ক্ষতি হয়েছে, তা প্রশ্নাতীত। বেসরকারি চ্যানেলে যখন বিটিভির খবর প্রচার শুরু হয়, তখন দর্শক দ্রুত অন্য চ্যানেলে চলে যায়। নিউজ ভ্যালুর বিপরীতে বিটিভি এখনো চলছে প্রটোকল ভ্যালু দিয়ে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর যেকোনো খবর লিড করতে হবে—বিটিভি এই অপেশাদার বদভ্যাস থেকে কখনোই বেরোতে পারেনি। সংবাদ বাছাই ও পরিবেশনে বস্তুনিষ্ঠতা ও পক্ষপাতহীনতার কোনো বালাই এখনো নেই, কখনো ছিল না। 
একই কথা প্রযোজ্য বাংলাদেশ বেতারের ক্ষেত্রেও। বেতারে এক যুগ আগেও বিজ্ঞাপন খাতে আয় ছিল ২২ কোটি টাকা, এখন ১০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। বছরে সরকার দেয় ১০৫ কোটি টাকা। (প্রথম আলো, ১২ নভেম্বর, ২০১৪) আয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জনপ্রিয়তাও কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। এর কারণ সম্প্রচারের জন্য পেশাদার, দক্ষ বা যোগ্য লোকের অভাব, অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও দুর্নীতি। ঢাকায় বেতারের বিকল্প হিসেবে এফএম রেডিও জনপ্রিয় হয়েছে, গ্রামে জনপ্রিয় হচ্ছে কমিউনিটি রেডিও। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেতারের অনুষ্ঠান শোনার জন্য নির্ভর করতে হয় রেডিও সেটের ওপর। কিন্তু এফএমের যুগে এএম-উপযোগী রেডিও এখন পাওয়া যায় না। বিশ্বের কোনো দেশ এএম প্রযুক্তির বিষয় মাথায় রেখে আর রেডিও বানায় না। বেতারে সম্প্রসারণ, আধুনিকায়ন, উন্নয়ন, স্বয়ংসম্পূর্ণ, সমৃদ্ধকরণসহ বিভিন্ন শব্দ কেবল কথায়, কাজে নয়। দুঃখজনক যে এটি এখন ‘আসি-যাই-বেতন-পাই’ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, ডিজিটালাইজেশনে পরিণত হয়েছে কেবলই মুখের বুলিতে।
নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের পর সবাই আশা করেছিল এবং তিন জোটের রূপরেখায় বিটিভি-বেতারের স্বায়ত্তশাসনের স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ছিল। বেতার-টিভির স্বায়ত্তশাসনের জন্য অপেক্ষা তাই দুই যুগের বেশি। জনগণের প্রত্যাশা ছিল, সম্প্রচারমাধ্যম দুটি চলমান ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন উপস্থাপন করবে, জনশিক্ষা প্রসারে সচেষ্ট হবে, অনুষ্ঠানমালায় দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তুলে ধরবে এবং জনমানুষের সুস্থ চিত্তবিনোদনের প্রয়োজন মেটাবে। কিন্তু এই দুটি সম্প্রচারমাধ্যম জনগণের প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা দেখেছি, সব সরকারই নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনকে ‘যুক্তিহীনভাবে’ ব্যবহার করেছে। এই দুটি গণমাধ্যম বরাবরই সরকারের ‘বশংবদ প্রচারাস্ত্র’ হিসেবে কাজ করে গেছে। অডিয়েন্সের কাছে এই দুটি গণমাধ্যমে পরিবেশিত সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতা বলতে গেলে শূন্যের কোঠায়। জেনারেল এরশাদ, শেখ হাসিনা কিংবা খালেদা জিয়া—প্রত্যেক সরকারই তাদের ‘প্রোপাগান্ডা মেশিন’ হিসেবে রেডিও-টিভিকে যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করেছে। অধিকন্তু এই দুটি মাধ্যমে কে খবর পাঠ করবেন, কোন শিল্পী গান করবেন, কার নাটক বা অনুষ্ঠান কেনা হবে, কোন প্রোগ্রাম প্রচার হবে বা হবে না, টক শোতে কারা আলোচক হিসেবে আমন্ত্রিত হবেন, আর কারা হবেন না—এর সব সিদ্ধান্তই নেওয়া হতো রাজনৈতিক বিবেচনা মাথায় রেখে। বিএনপি সরকার যখন ক্ষমতায়, রেডিও-বিটিভিতে তখন থাকে বিএনপির শিল্পী, নাট্যকার, অভিনেতা, খবর পাঠকদের প্রাধান্য; আর আওয়ামী লীগের সময় থাকে আওয়ামী আদর্শের শিল্পী-অভিনেতাদের। বিএনপি সরকারের সময় আওয়ামী আদর্শের শিল্পীরা নির্বাসিত আর আওয়ামী লীগের সময় বিএনপির শিল্পীরা দ্বীপান্তরিত। বিটিভি ও বেতার যদি ‘গণমাধ্যম’ হয়ে থাকে, তাহলে ‘গণ’ মানুষের অংশগ্রহণ ও চিন্তার প্রতিফলন অপরিহার্য। এটিকে পাশ কাটিয়ে গণতন্ত্র সম্ভব নয়, তা সে গণতন্ত্র যে ধাঁচের, যে ধরনেরই হোক না কেন! প্রশ্ন হচ্ছে, বিটিভি-বেতার থেকে মানুষ কেন অসত্য, অর্ধসত্য সংবাদ শুনতে বাধ্য হচ্ছে? 
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলেই আসাফ্উদ্দৌলাহ্কে চেয়ারম্যান করে ১৬ সদস্যের একটি স্বায়ত্তশাসন নীতিমালা প্রণয়ন কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশন ব্রিটেন, ভারত, ফিলিপাইনসহ পৃথিবীর বেশ কটি দেশ ঘুরে সেসব দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের দেশের বাস্তবতায় বেতার-টিভির পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের মধ্যভাগে সরকারের কাছে সুপারিশসহ প্রতিবেদন পেশ করে। তা কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বিটিভি-বেতারকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া উচিত এবং এখনই কেন নয়? কারণ, জনগণের টাকায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠান দুটি সরকারি প্রচারযন্ত্রের বলি হতে পারে না। আমরা মনে করি, বিটিভির বিপুলসংখ্যক দর্শকের কাছে টেরিস্ট্রিয়াল টেলিভিশনের সত্যিকারের সুবিধা অবারিত করা দরকার। বিজ্ঞাপনদাতাদের মন জুগিয়েই বেসরকারি গণমাধ্যমগুলো তাদের বাজারমুখী সেবা ও ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে। এতে করে অনেক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের চেয়ে গোষ্ঠী ও করপোরেট স্বার্থই প্রাধান্য পায় এবং কখনো কখনো স্বাধীন পেশাদারির মনোভাবকেও বাধ্য হয়ে জলাঞ্জলি দিতে হয়। সেখানে হামেশা বিজ্ঞাপন মোড়কে সংবাদ পরিবেশিত হতে দেখি। পক্ষপাতহীন সাংবাদিকতার প্রশ্নে ‘সিটিসেল সংবাদ’, ‘গ্রামীণফোন কিংবা বাংলালিংক সংবাদ’ অথবা কোনো ব্যাংক-বিমা বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠানের নাম যখন সংবাদের ‘সুপারলিড’ হয়, তখন তা ভারসাম্য হারায়। বিবিসি সারা বিশ্বের কোটি কোটি অডিয়েন্সের বিশ্বস্ত গণমাধ্যম হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিবিসি রেডিও বা বিবিসি টেলিভিশনের মতো করে কি বিটিভি-বেতারকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া যায় না? সরকারের মুখপত্র, প্রোপাগান্ডা মেশিন কিংবা ‘লয়াল ইলেকট্রনিক মিডিয়া’র বদনাম ঘোচাতে হলে ব্রিটেন, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও চিলির আদলে বিটিভি-বেতারকে পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং (পিএসবি) হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এতে প্রটোকল ভ্যালু পরিবর্তিত হবে নিউজ ভ্যালু দিয়ে। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ‘ম্যাসমিডিয়া’ কোনো বিচারেই ‘ক্লাসমিডিয়া’ হবে না। এটা জাতীয় সম্পদ। তথ্যের উৎপাদন ও বণ্টনে এখানে সমাজের সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। এ জন্য যা করতে হবে: বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারের পরিচালন, অর্থায়ন ও ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে প্রতিষ্ঠান দুটিকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে আনতে হবে। মনে রাখা ভালো যে বর্তমান বিশ্বে গণমাধ্যম ডিসকোর্সে ‘নিয়ন্ত্রণের’ বিপরীতে বরং ‘ডিসেন্ট্রালাইজড রেগুলেটরি মেকানিজমই’ সমাদৃত প্রপঞ্চ।
একটি স্থায়ী সম্প্রচার কমিশন গঠন করতে হবে, যা হবে সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন। 
কমিশনের কাজ হবে দক্ষ, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক একটি ‘মিডিয়া রেগুলেটরি মেকানিজম’ প্রতিষ্ঠা করা। 
কমিশন রেডিও-টিভির লাইসেন্স ফি আদায় করবে এবং টিভি ও রেডিওর জন্য বাজেট অনুমোদন করবে।
বিবিসির মতো বিটিভি ও রেডিও তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করবে পার্লামেন্টের কাছে।
প্রতিষ্ঠান দুটি যেহেতু জনগণের করের টাকায় চলে, তাই বেতার-বিটিভির অনুষ্ঠানের কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন কিংবা সংবাদের 
বস্তুনিষ্ঠ হওয়ার দাবি আমরা কখনোই ছাড়তে পারি না; আর এ জন্য ছাড়তে পারি না স্বায়ত্তশাসনের দাবিও।
রোবায়েত ফেরদৌস: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
robaet.ferdous@gmail.com