ইউক্রেন সীমান্তে ক্রেমলিনের সমরসজ্জার প্রতিক্রিয়ায় ন্যাটোও বড় ধরনের সমর প্রস্তুতি নিয়েছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে যদি নতুন একটা যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে কি খাদ্যঘাটতি দেখা দেবে? রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বের বড় দুটি শস্য রপ্তানিকারক দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, দেশ দুটি যে পরিমাণ গম রপ্তানি করে, তা বিশ্বের মোট উৎপাদিত গমের (২০৬ দশমিক ৯ মিলিয়ন মেগা টন) চার ভাগের একভাগ।
ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে যদি সত্যি সত্যি সংঘাত শুরু হয় এবং তাতে করে যদি বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে বড় দুই গম আমদানিকারক দেশ তুরস্ক ও মিসরকে বড় ধরনের খাদ্যসংকটে পড়তে হবে।
২০১৪ সালের পর থেকে পূর্ব ইউরোপে স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করেছে। এরপরও ২০২১ সালে বিশ্বের খাদ্যপণ্যের দাম আগের বছরের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেড়েছে। গত বছরের গ্রীষ্মে চাষ করা বেশির ভাগ খাদ্যশস্য এরই মধ্যে রপ্তানি করে ফেলেছে ইউক্রেন। রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হলে এ বছর চাষাবাদ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জ্বালানিমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও বাণিজ্য বিধিনিষেধের কারণে দেশ দুটির কৃষকেরা সারসংকটে পড়ায় এখনই বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন।
সামরিক আগ্রাসনের কারণে যদি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্ররা রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাহলে রাশিয়া থেকে পশ্চিম এশিয়ায় খাদ্য সরবরাহ সীমিত হয়ে আসবে। তখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় ইউক্রেনের গমের চাহিদা বাড়বে। ইউক্রেনের খাদ্যশস্যের বাজার সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে সম্প্রসারিত হয়েছে। খাদ্যশস্য উৎপাদনে ইউক্রেনের এ সক্ষমতা অবশ্য নতুন নয়। সোভিয়েত জমানায় অভ্যন্তরীণ শস্যের বড় সরবরাহকারী ছিল ইউক্রেন। এখন ব্ল্যাক সি অঞ্চলে আরেকটি যুদ্ধ বাধলে ইউক্রেনের শস্য উৎপাদনসক্ষমতাতেই শুধু প্রভাব ফেলবে না, তাদের গম ও খাদ্যশস্য সরবরাহের সামর্থ্যও কমবে। লেবানন, মিসর, ইয়েমেন, ইসরায়েল ও ওমান—যারা ইউক্রেনের খাদ্যশস্যের প্রধান ক্রেতা, তাদের ওপর এ ঘটনায় বড় প্রভাব পড়বে। লেবানন ও ইয়েমেন ইতিমধ্যে খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। খাদ্য সরবরাহব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হলে দেশ দুটিতে বড় মানবিক বিপর্যয় হতে বাধ্য।
আরব উপসাগরীয় দেশগুলোতেও এর প্রভাব পড়বে। ২০২০ সালে ইউক্রেন থেকে মুরগি আমদানি করা দেশগুলোর শীর্ষ ১১টির মধ্যে ৫টিই ছিল মধ্যপ্রাচ্যের। ইউক্রেনের মুরগির মাংসনির্ভর খাদ্যপণ্যের প্রধান ক্রেতা কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব।
এর আগে, ২০১০ সালে খরার কারণে রাশিয়ায় গম উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল। মস্কো সে সময় অভ্যন্তরীণ খাদ্যনিরাপত্তার জন্য গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। কিন্তু সেই খাদ্যসংকটের একটা অপরোক্ষ ফলাফল হচ্ছে আরব বসন্ত। বিশ্বে তখন গমের দাম বেড়েছিল। রাশিয়ার খাদ্যশস্যের বড় ক্রেতা ছিল মিসর। দেশটিতে রুটির দাম যাতে না বাড়ানো হয়, সেই দাবিতে মানুষ প্রতিবাদ করেছিলেন। মিসর, তিউনিসিয়াসহ সেখানকার গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম কারণ ছিল বৈশ্বিক খাদ্যসংকট।
বিশ্বে রাশিয়া শুধু অস্ত্র ও জ্বালানি রপ্তানি করে, এমন একটা ধারণা সবার মধ্যে আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে রাশিয়া এখন অনেক বড় খাদ্য রপ্তানিকারক দেশ। তবে মধ্যপ্রাচ্যই তাদের খাদ্যের একমাত্র ক্রেতা নয়।
যদি পশ্চিমারা রাশিয়ার খাদ্যপণ্য রপ্তানির ওপর নিষেধজ্ঞা দেয় কিংবা আন্তর্জাতিক লেনদেনব্যবস্থা সুইফট থেকে দেশটির ব্যাংকগুলোকে বাদ দিয়ে দেয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে খাদ্যের দাম রকেটগতিতে বাড়তে থাকবে। বিশ্বের ষষ্ঠ গম রপ্তানিকারক দেশ ইউক্রেন যদি তাদের দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন এবং সেগুলো রপ্তানি করতে না পারে, তাহলেও বিশ্ব খাদ্যনিরাপত্তায় হুমকি তৈরি হবে।
জাতিসংঘ খাদ্যনিরাপত্তার যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে, তাতে বিশ্বের সর্বত্র ও সব মানুষের কাছে পর্যাপ্ত, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের জোগান ও প্রবেশগম্যতার কথা বলা হয়েছে। অতীতের আর সব যুদ্ধের ভীতিকর অভিজ্ঞতার মতো রাশিয়া-ইউক্রেন সামরিক সংঘাত বাধলে মানুষের মৌলিক মানবাধিকারগুলো বিপন্ন হবে। খাদ্যের অভাবের একটা বড় কারণ যুদ্ধ। সংঘাতের কারণে অবধারিতভাবে খাদ্যের দাম বাড়ে। অচলাবস্থার মধ্যেও রাশিয়া ও পশ্চিমারা একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজছে। মধ্যপ্রাচ্যের আসন্ন খাদ্যসংকটকেও এ ক্ষেত্রে কূটনৈতিক বিবেচনায় রাখতে হবে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● নিকোলাই মিকোভিচ সার্বিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক