মতামত

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নতুন সমীকরণ

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপের ভূরাজনীতিতে দ্রুত পরিবর্তন নিয়ে আসছে
 ছবি: রয়টার্স

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দুই মাস পেরিয়েছে। এ যুদ্ধ কবে শেষ হবে, তার সঠিক জবাব কোনো সমরবিদ বা পশ্চিমের গবেষকেরা দিতে পারছেন না। ইউক্রেনে রাশিয়ার সীমিত সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্যই-বা কী বা সামরিক লক্ষ্যবস্তু কী, সেটাও কারও কাছে পরিষ্কার নয়। রাশিয়ার সামরিক পরিকল্পনা সম্বন্ধে কেউ ওয়াকিবহাল নয়, এমনকি রাশিয়ার বর্তমান সামরিক অভিযানের ধরন বা আক্রমণরত সামরিক বাহিনীর সংখ্যাতত্ত্ব কোনো বিচারেই ধারণা করার উপায় নেই। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি যে পরিসংখ্যান পাওয়া গিয়েছিল, সেখান থেকে অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। সাধারণত আক্রমণের জন্য ৩: ১-এর পরিসংখ্যান প্রচলিত; কিন্তু এর স্থলে পশ্চিমা গোয়েন্দার অনুমান, রাশিয়ার সেনাবহর যারা ইউক্রেনে প্রবেশ করেছে, তাদের সংখ্যানুপাত ১:১। এ অনুপাতকে ইউক্রেন দখল করার অভিপ্রায় বলা যায় না। উল্লেখ্য, প্রাপ্ত তথ্যমতে, ইউক্রেনে মোট ২ লাখ চাকরিরত ও ২ দশমিক ৫ লাখ রিজার্ভ সামরিক সদস্য রয়েছে। অপর দিকে, রাশিয়া ইউক্রেন অভিযানে ১ দশমিক ৭৫ লাখ থেকে ১ দশমিক ৯০ লাখ সেনা মোতায়েন করেছে, যার সঙ্গে রয়েছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ হাজার ও লুহানস্কের ১৪ হাজার মিলিশিয়া। অপর দিকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছে আধা সামরিক বাহিনীর ১ লাখ ২০ হাজার ও রিজার্ভ থেকে ৯০ হাজার সেনা। কাজেই তুলনামূলক পরিসংখ্যান বলে দেয়, রাশিয়ার সামরিক শক্তি কিয়েভসহ সম্পূর্ণ ইউক্রেন দখলের জন্য বিন্যাস করা হয়নি। কাজেই রাশিয়ার লক্ষ্য নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে।

তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, রাশিয়ার প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে উত্তর-পূর্ব ও পূর্বাঞ্চলের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চল দখলের মাধ্যমে। যদিও লুহানস্ক অঞ্চলের মারিউপোল শহর ও অন্যতম বন্দর এখনো পুরোপুরি দখল হয়নি। রাশিয়ার দাবি অনুযায়ী, ইউক্রেনের অতি দক্ষিণপন্থী ‘আজভ’ বাহিনীর (যাদের নাৎসি বাহিনী বলে উল্লেখ করে) সদর ঘাঁটি হচ্ছে মারিউপোল। এ বন্দর শহর রাশিয়ান বাহিনী অবরোধ করে রেখেছে। ‘আজভ’ বাহিনীর আত্মসমর্পণ সময়ের ব্যাপারমাত্র। এ বাহিনীর সদর দপ্তর ও শক্ত ঘাঁটি প্রায় চারতলা সমান ভূগর্ভস্থ আজভস্তাল আয়রন অ্যান্ড স্টিল প্ল্যান্টের নিচে। বর্তমানে রাশিয়া বাহিনী সেটি ঘেরাও করে রেখেছে। এখানে অনেক বেসামরিক নাগরিকও রয়েছে বলে দাবি করা হলেও তাদের অবস্থান ও সংখ্যা পরিষ্কার নয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এই মূল ঘাঁটির ‘আজভ’ বাহিনী যতক্ষণ পর্যন্ত রাশিয়ার বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত রাশিয়ার অবরোধ উঠবে না। আজভ বাহিনী এখনো আত্মসমর্পণের কোনো প্রস্তাব পাঠায়নি। রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর এ ধরনের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা রয়েছে।

রাশিয়ার পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের কৌশল পণ্ডিতদের কাছে পরিষ্কার না হলেও প্রায় দুই মাসে যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তাতে রাশিয়ার বাহিনীর প্রাথমিক লক্ষ্য পূরণ হয়েছে বলে মনে হয়। বর্তমানে ইউক্রেনের উত্তর-পূর্ব ও পূর্ব প্রান্তরে, রাশিয়ার পশ্চিম সীমানাসংলগ্ন চারনাহার, দনবাস ও লুহানস্ক অঞ্চল, যার অন্যতম বন্দর মারিউপোল রাশিয়ার দখলে রয়েছে এবং এই দুই অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়ার ঘোষণা যেকোনো সময় আসতে পারে। উল্লেখ্য, ক্রিমিয়ার পরই মারিউপোল ছিল ইউক্রেনের বড় নৌবাহিনী সদর। মারিউপোল যেহেতু এ অঞ্চলের বড় শহর, কাজেই এ অঞ্চলকে আলাদা করতে হলে এবং ‘আজভ’ বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করতে হলে এ বন্দর শহর দখল করার প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার প্রাথমিক লক্ষ্যবস্তু অর্জনের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আপাতদৃষ্টে মনে হয় না, পুতিন কিয়েভ অথবা ইউক্রেন দখলের অভিপ্রায় রাখে, যা সম্ভব হবে না। দনবাস অঞ্চল হবে রাশিয়ার জন্য ‘বাফার’ স্টেট।

যাহোক, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপের ভূরাজনীতিতে দ্রুতগতিতে পরিবর্তন দৃশ্যমান হচ্ছে। শুধু ইউরোপেই নয়, ভূরাজনীতির লক্ষণীয় পরিবর্তন দক্ষিণ এশিয়াসহ পূর্ব এশিয়া অঞ্চলেও। উপমহাদেশের প্রধান রাষ্ট্র ভারত কথিত নির্দলীয় থাকাটাকে পশ্চিমা বিশ্ব সহজভাবে নেয়নি। মনে করা হয়, পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির অস্থিরতার প্রেক্ষাপট এ যুদ্ধ। অপর দিকে ভারতও রয়েছে চাপে, তবে ভারত সর্বদাই ভূকৌশলগত সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে আসছে। এমনকি বাংলাদেশও অদৃশ্য চাপে রয়েছে বলে মনে হয়।

যত দিন অতিবাহিত হচ্ছে, একদিকে যেমন যুদ্ধের গতি-প্রকৃতির পরিবর্তন হচ্ছে, তেমনি বিশ্বব্যাপী নানা ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। বিগত দুই মাসে ড্যানিপার নদী দিয়ে প্রচুর পানি প্রবাহিত হয়েছে। রাশিয়া তার অবস্থানে দৃঢ় রয়েছে এবং অপর দিকে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে ন্যাটোর প্রধান শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও এর ইউরোপীয় সদস্যদের মধ্যেও অস্থিরতা বাড়ছে। বাড়ছে ইউরোপের প্রায় সব দেশের, বিশেষ করে ন্যাটোর বড় শরিকদের, বিশেষ করে ফ্রান্স ও জার্মানির সামরিক ব্যয়। সবচেয়ে বেশি যে দেশটি চর্চায় রয়েছে, সেটি হলো পশ্চিম ইউরোপের পাওয়ার হাউস বলে পরিচিত জার্মানি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি এমন বিপাকে পড়েনি। একদিকে রাশিয়ার জ্বালানিনির্ভরতা, অপর দিকে রাশিয়াকে ঠেকানোর চিন্তা। জার্মানি ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, প্রতিরক্ষা খাতে ২০২৬-এর মধ্যে মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশ বৃদ্ধি করবে। এতে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ বাড়বে প্রতিরক্ষা খাতে। ২০২১ সালে প্রতিরক্ষা খাতের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি ছিল ৪৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন ইউরো, যা ২০২২-এ বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৭৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ইউরো। ২ বিলিয়ন ইউরো বিদেশে প্রতিরক্ষা অনুদান হিসেবে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে জার্মানি। এর মধ্যে সিংহভাগ ইউক্রেনকে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ৪৫০ মিলিয়ন ইউরোর বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দেশটিকে ৫০ মিলিয়ন ইউরো দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ধরনের অসামরিক যেমন ওষুধ, হাসপাতালে ব্যবহার্য বিভিন্ন দ্রব্যাদির জন্য।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) একটি রাষ্ট্রপুঞ্জ হিসেবে গড়ে ওঠার পথে রয়েছে। বহু বছর পর হলেও এই প্রথম ইউরোপ আলাদা সামরিক শক্তির প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে এবং গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এরই মাধ্যমে ক্রমেই পরিবর্তিত হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পুরোনো ভূরাজনীতি। বহু ধরনের অজুহাত দেখিয়ে জার্মানিসহ ইইউ ন্যাটোর শক্তির ছায়াতলে থেকেছে। বিশেষ করে জার্মানি নিজেদের সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করেনি। ন্যাটোর ছায়াতলে থাকার কারণে ইইউর প্রস্তাব অনুযায়ী ত্বরিতগতির অভিযানের জন্য নিজেদের বাহিনী গঠনেও অনেক দেশ রাজি ছিল না, যার মধ্যে প্রধানত ছিল জার্মানি। বছরখানেক আগে তৈরি করেছিল ইউরোপিয়ান পিস ফ্যাসিলিটি (ইইউআই)। সংগঠনটি সন্ত্রাস মোকাবিলার লক্ষ্য নিয়ে তৈরি হলেও রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর এর নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাটোর বাইরে থাকা ইউরোপের নিজস্ব বাহিনী প্রস্তুতের জন্য চাপ দিলেও খুব কাজ হয়নি। কিন্তু এখন ইউরোপ নিজেদের শক্তি সমন্বয়ের জন্য দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ শুধু ইইউর প্রতিক্ষা খাতের বিনিয়োগ বাড়িয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ উন্মুক্ত করেনি, বরং জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর রাস্তা খুলেছে। বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠেছে রুবলের বিনিময়ে রাশিয়ার জ্বালানির মূল্য পরিশোধ করার বিষয়টি নিয়ে। এ কথা নতুন নয় যে ইউরোপের জ্বালানি চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ রাশিয়া থেকে আমদানি করা হয়। এর মধ্যে একমাত্র জার্মানি ২০২১ সালে ৬৩.৭ শতাংশ জ্বালানি রাশিয়া থেকে আমদানি করেছে, যার মধ্যে ৩৪ শতাংশ জ্বালানি তেল রয়েছে।

রাশিয়ার ওপর এখন নিষেধাজ্ঞার পরও ইউরোপ, বিশেষ করে জার্মানির জন্য এখনো অন্য কোনো উপায় নেই। জার্মানি মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য জায়গা থেকে তরল গ্যাস আমদানির জন্য আলাদাভাবে গ্যাস টার্মিনাল তৈরি করতে প্রায় চার বছরের মতো সময় লাগবে। কাজেই জার্মানিসহ অন্যান্য দেশ চাইলেও সহজে রাশিয়ার জ্বালানি কূটনীতির বলয়ের বাইরে যেতে পারছে না। এখন যে সংশয়ে ভুগছে, তা হলো তেলের মূল্য পরিশোধের বিষয়টি। ইতিমধ্যে এ কারণেই পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়ায় সরবরাহ বন্ধ করে দেয় রাশিয়া। কারণ, এই দুই দেশ রুবলে দাম পরিশোধে অপারগতা দেখিয়েছিল।

যাহোক, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপের ভূরাজনীতিতে দ্রুতগতিতে পরিবর্তন দৃশ্যমান হচ্ছে। শুধু ইউরোপেই নয়, ভূরাজনীতির লক্ষণীয় পরিবর্তন দক্ষিণ এশিয়াসহ পূর্ব এশিয়া অঞ্চলেও। উপমহাদেশের প্রধান রাষ্ট্র ভারত কথিত নির্দলীয় থাকাটাকে পশ্চিমা বিশ্ব সহজভাবে নেয়নি। মনে করা হয়, পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির অস্থিরতার প্রেক্ষাপট এ যুদ্ধ। অপর দিকে ভারতও রয়েছে চাপে, তবে ভারত সর্বদাই ভূকৌশলগত সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে আসছে। এমনকি বাংলাদেশও অদৃশ্য চাপে রয়েছে বলে মনে হয়।

পরিশেষে বলতে হয়, এ যুদ্ধ যত দীর্ঘই হোক বা ফলাফল যা-ই হোক, বিশ্বে ভূরাজনীতির যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে, তার প্রেক্ষাপটে বিশ্বে নতুন একাধিক বলয়ের সৃষ্টি হতে যাচ্ছে।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)

hhintlbd@yahoo.com