ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্ররা দাবি করছে, তারা ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগদানের অধিকারের পক্ষ সমর্থন করার মাধ্যমে দেশটিকে সুরক্ষা দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তব সত্য ঠিক এর বিপরীত। বাস্তবতা হলো এই পশ্চিমা বন্ধুরা ইউক্রেনের একটি তাত্ত্বিক অধিকার রক্ষার আওয়াজ তুলে দেশটির ওপর রাশিয়ার আক্রমণের আশঙ্কাকে বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এবং দেশটির নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
পশ্চিমা মিত্ররা রাশিয়াকে না খেপিয়ে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তাদানে সক্ষম একটি কূটনৈতিক চুক্তিতে পৌঁছানোর মাধ্যমে ইউক্রেনের স্বাধীনতাকে আরও কার্যকরভাবে রক্ষা করতে পারত। অস্ট্রিয়া, ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের (এ দেশগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য কিন্তু ন্যাটোর সদস্য নয়) সঙ্গে রাশিয়ার এ ধরনের চুক্তি আছে। একটি নন-ন্যাটো দেশ হিসেবে ইউক্রেনের সঙ্গেও এ ধরনের চুক্তি করার বিষয়ে ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক দেনদরবার চালিয়ে যেতে পারত। এখনো সে ধরনের সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা চালানোর সুযোগ আছে।
চুক্তিতে এ বিষয়গুলো রাখা যেতে পারে: রাশিয়া পূর্ব ইউক্রেন থেকে তার সেনা প্রত্যাহার করবে এবং ইউক্রেনের সীমান্তের কাছে সামরিক তৎপরতা নিষ্ক্রিয় করতে সম্মত হবে; এর বদলে ন্যাটো ইউক্রেনে তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করতে চাইলে আগেভাগে তার পূর্বাভাস দেবে। রাশিয়া ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করবে এবং ইউক্রেন রাশিয়ার নিরাপত্তা স্বার্থকে সম্মান করবে। উভয় পক্ষের স্বার্থে এ ধরনের চুক্তি সম্ভব।
এটি প্রায় নিশ্চিত যে যাঁরা ন্যাটোয় ইউক্রেনের সদস্যপদ লাভ করার পক্ষে কথা বলছেন, তাঁদের কাছে এ ধরনের চুক্তিকে বাতুলতা মনে হবে। তাঁরা বলবেন, ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছিল এবং ক্রিমিয়া দখল করে নিয়েছিল। আর এখন ইউক্রেনের আশপাশে লাখখানেক সেনা জড়ো করে এবং নতুন অভিযানের হুমকি দিয়ে রাশিয়া বর্তমানের এ সংকটের সৃষ্টি করেছে। এসব তৎপরতার মধ্য দিয়ে ক্রেমলিন ১৯৯৪ সালে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের শর্ত লঙ্ঘন করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হিসেবে ইউক্রেনের হাতে যেসব পারমাণবিক অস্ত্র ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর সেসব অস্ত্র রাশিয়ার হাতে সমর্পণ করার বিনিময়ে ওই সমঝোতা স্মারকে রাশিয়া কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাতে স্বাক্ষর করেছিল। সেখানে স্পষ্ট করে বলা আছে, রাশিয়া ইউক্রেনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে (ক্রিমিয়ার মালিকানাও এর মধ্যে পড়ে) সম্মান করবে।
ইউক্রেনে ন্যাটোর উপস্থিতি এবং তার সুবাদে একটি নতুন প্রাচীর তোলা আমাদের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে না। বরং ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব এবং ইউরোপসহ গোটা বিশ্বে শান্তি নিশ্চিত করাই আমাদের আসল চিন্তার বিষয় হওয়া উচিত। পূর্ব ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার প্রত্যাহার এবং ইউক্রেনের সীমান্তে রুশ বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করার বিনিময়ে ন্যাটো তার পূর্বমুখী সম্প্রসারণ বন্ধ করলে ইউক্রেন অনায়াসেই অনেক নিরাপদ হবে।
এটা সম্ভব যে রাশিয়া একটি নিরপেক্ষ ইউক্রেনকে মেনে নেবে এবং সম্মান করবে। ইউক্রেনের সেই মর্যাদা অর্জন নিয়ে পশ্চিমারা কখনোই টেবিলে প্রস্তাব তোলেনি। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাব করেছিল, ইউক্রেনকে (এবং জর্জিয়াকে) ন্যাটোতে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সেই পরামর্শ তখন থেকেই এ অঞ্চলে বড় উত্তেজনার সৃষ্টি করে। মার্কিন এ পদক্ষেপকে রাশিয়ার প্রতি উসকানি হিসেবে বিবেচনা করে ফ্রান্স, জার্মানি এবং অন্যান্য অনেক ইউরোপীয় দেশের সরকার ন্যাটো জোটকে তাৎক্ষণিকভাবে ইউক্রেনকে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়ে বাধা দেয়। কিন্তু ইউক্রেনের সঙ্গে একটি যৌথ বিবৃতিতে ন্যাটো নেতারা স্পষ্ট করেন, ইউক্রেন আজ নয়তো কাল ন্যাটোর সদস্য হবে।
ক্রেমলিন মনে করে, ইউক্রেনে ন্যাটোর উপস্থিতি রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। রাশিয়া এবং পশ্চিমা শক্তিগুলোর মধ্যে একটি ভৌগোলিক নিরাপত্তা এলাকা তৈরি করার জন্য সোভিয়েতের রাষ্ট্রীয় কাঠামো সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। সেভাবেই তারা ভৌগোলিক অবস্থানের সুরক্ষা ব্যবস্থা ডিজাইন করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে রাশিয়া প্রাণপণে সাবেক সোভিয়েত ব্লকে ন্যাটোর বিস্তৃতির বিরোধিতা করে আসছে।
হ্যাঁ, এটি ঠিক যে পুতিনের মনোভাব স্নায়ুযুদ্ধের মানসিকতার ধারাবাহিকতাকেই প্রতিফলিত করে; কিন্তু এ–ও সত্য, সেই একই মানসিকতা রাশিয়ার প্রতিপক্ষদেরও মধ্যেও প্রোথিত আছে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ই নিজ নিজ পক্ষের অনুকূল শাসনব্যবস্থা স্থাপন করতে স্থানীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রক্সি যুদ্ধ চালাচ্ছিল, যেটি শীতল যুদ্ধ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সরাসরি লড়াইয়ের ময়দানে না থাকলেও তাদের মদদ নিয়ে স্থানীয় অনুসারীরা সহিংস হয়ে ওঠে। এর ধারাবাহিকতায় যুদ্ধক্ষেত্র বিশ্বজুড়ে বিস্তৃতি পায়। দক্ষিণ–পূর্ব ও মধ্য এশিয়া থেকে আফ্রিকা, পশ্চিম গোলার্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যে রক্তক্ষয়ী লড়াই ছড়িয়ে পড়ে। সে অবস্থা এখন আর নেই। কিন্তু সে আগুন একেবারে নিভেও যায়নি।
আজ, ইউক্রেনে ন্যাটোর উপস্থিতি এবং তার সুবাদে একটি নতুন প্রাচীর তোলা আমাদের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে না। বরং ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব এবং ইউরোপসহ গোটা বিশ্বে শান্তি নিশ্চিত করাই আমাদের আসল চিন্তার বিষয় হওয়া উচিত। পূর্ব ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার প্রত্যাহার এবং ইউক্রেনের সীমান্তে রুশ বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করার বিনিময়ে ন্যাটো তার পূর্বমুখী সম্প্রসারণ বন্ধ করলে ইউক্রেন অনায়াসেই অনেক নিরাপদ হবে।
ইইউ এবং জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা দ্বারা সমর্থিত এ নিরিখেই কূটনীতি এগিয়ে নেওয়া জরুরি।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জেফরি ডি স্যাক্স কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়নকেন্দ্রের পরিচালক