গত ৭ মার্চ রাশিয়া জানিয়েছে, তিনটি উদ্দেশ্য থেকে তারা ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করেছে। সেগুলো হলো ইউক্রেনকে নিরপেক্ষকরণ, ক্রিমিয়ার ওপর রাশিয়ার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা এবং রুশ–সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অঞ্চল লুহানস্ক ও দোনেৎস্কের স্বাধীনতা। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো এখনো প্রকাশ্যে রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সন্ধির ব্যাপারে কোনো বক্তব্য দেয়নি। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি জাতীয় ঐক্য রক্ষা ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যাপারে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত রেখেছেন। শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত ইউক্রেন কিছু বিতর্কিত ও ধোঁয়াশাপূর্ণ অবস্থান ব্যক্ত করেছে। কিন্তু জেলেনস্কিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে আলাপ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি যৌক্তিক অবস্থানে পৌঁছাতে হবে।
ইউক্রেন সরকারের কী করা উচিত, সে সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি এখানে তুলে ধরছি। প্রথমত, যদি শান্তি চুক্তিতে নিরাপত্তার যথেষ্ট নিশ্চয়তা দেওয়া হয়, তবে ইউক্রেনের নিরপেক্ষ অবস্থান শুধু গ্রহণযোগ্যই নয়, সমীচীনও। ইউক্রেনের নিরপেক্ষ অবস্থান শুধু ন্যাটো ও রাশিয়াকে পৃথক রাখবে না, এটা সব পক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক হবে, সারা দুনিয়ার জন্যও মঙ্গলজনক হবে। অস্ট্রিয়া, সাইপ্রাস, আয়ারল্যান্ড, মাল্টা, ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের মতো ইউক্রেন ন্যাটোর বাইরের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
ইউক্রেনের এই নিরপেক্ষতার ব্যাপারে জিম্মাদার কে হবে? আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনসহ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সেই দায়িত্ব নিতে পারে। শান্তি চুক্তিকে স্থায়ী রূপ দিতে হলে চীনকে এখানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চীন। ন্যাটো সম্প্রসারণ নিয়ে রাশিয়ার যে বিরোধিতা, তাতে চীন সমর্থন জানিয়েছে। এশিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটোর আদলে জোট গড়ার বিরোধিতাও করেছে দেশটি। আমার ধারণা, ন্যাটো সম্প্রসারণ করা হবে না, এমন একটা চুক্তিকে অবশ্যই সমর্থন করবে চীন। রাশিয়াও এতে সম্মত হবে।
দ্বিতীয়ত, ক্রিমিয়া কার্যত যে রাশিয়ার অংশ, সেটা মেনে নিতে হবে। একই সঙ্গে ক্রিমিয়া যে রাশিয়ার বিধিসম্মত অংশ নয়, সেই কথাও বলতে হবে। ক্রিমিয়ার বিরোধপূর্ণ ইতিহাস বিষয়ে সবারই জানা আছে। ক্রিমিয়া রাশিয়ার নৌশক্তির কেন্দ্র। ক্রিমিয়ার ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে ইউক্রেন ও পশ্চিমকে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে হবে। বিশ্বের অনেক জায়গার মতো ক্রিমিয়া ‘শীতল’ সংঘাতের বিন্দু হয়ে উঠেছে। কিন্তু ক্রিমিয়া আর সংঘাত সৃষ্টির কেন্দ্র হয়ে থাকতে পারে না।
ইউক্রেন কিংবা ন্যাটো কেউই তাদের নীতিগত অবস্থান অস্পষ্ট রাখতে পারে না। রাশিয়াকে পরাজিত করার মতো যুক্তি থেকেও তাদের সরে আসতে হবে। পুতিন যুদ্ধে পরাজিত হবেন, এ যুক্তি মেনে নিলেও তার আগেই ইউক্রেন একেবারে ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদে পরিণত হবে। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান পুতিনের জন্য সত্যি সত্যি উল্টো ফল এনে দেয়, তাহলে তিনি পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার করে বসতে পারেন।
তৃতীয়ত, দনোবস অঞ্চলের রুশ-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী এলাকাগুলোর স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার ব্যাপারে ইউক্রেনকে অবশ্যই সম্মত হতে হবে। ২০১৫ সালে সম্পাদিত দ্বিতীয় মিনস্ক চুক্তিতে বিষয়টি ছিল। ২০১৫ সালের শেষ দিকে ইউক্রেনের সংবিধানে স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, কিন্তু দ্বিতীয় মিনস্ক চুক্তি কখনো বাস্তবায়িত হয়নি। স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি এখন শান্তি প্রতিষ্ঠার ভিত্তি
হতে পারে।
শান্তি প্রক্রিয়ায় গতি সঞ্চার করতে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের জনগণের সমর্থন আদায় করতে জেলেনস্কি সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সরকারগুলোর সঙ্গে মিলে একটি যৌক্তিক অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। যদিও কিয়েভ, ওয়াশিংটন, ব্রাসেলস, ওয়ারশ এবং বিশ্বের অনেক দেশের পণ্ডিত ও রাজনীতিকেরা এ ধরনের কোনো চুক্তির ব্যাপারে প্রবল বিরোধিতা করছেন। তাঁদের যুক্তি, নিরপেক্ষ অবস্থানের দাবি মেনে নেওয়ার মানে হচ্ছে আত্মসমর্পণ করা। তাঁরা পুতিনের বিরুদ্ধে জয়ী হতে চান, কিন্তু কূটনৈতিকভাবে সমস্যার সমাধান চান না। সম্প্রতি ওয়ারশতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ‘পুতিন আর ক্ষমতায় থাকতে পারেন না’ বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটারই সমর্থন করেন তাঁরা।
এ ধরনের প্রকাশভঙ্গিতে মারাত্মক ভুল হয়। এটা যুদ্ধ ডেকে আনে। বাইডেন বলেছেন, ‘দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য আমাদের মানসিকভাবে দৃঢ় হতে হবে।’ যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে ইউক্রেনে আরও ধ্বংসযজ্ঞ বাড়বে, যুদ্ধ আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়বে। এর বদলে ইউক্রেন ও এর পৃষ্ঠপোষক দেশগুলো নিরপেক্ষতার নীতিতে সম্মত হলে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি হবে।
পুতিন শিগগিরই যুদ্ধে পরাজিত হবেন, সেটা মনে করা মারাত্মক ভুল হবে। রাশিয়ার সেনাবাহিনী এই মুহূর্তে দনবাস অঞ্চলে তাদের মুঠো শক্ত করে চেপে ধরেছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কয়েকজন বলেছেন, খুব তাড়াতাড়ি পুতিনকে ছুড়ে ফেলা হবে। এ ধরনের দূরকল্পনা শুধু বুনোই নয়, সেটা বিপজ্জনকও। এটা কোনো নীতি হতে পারে না। ইউক্রেনকে ধ্বংস করার চেয়ে বেশি সামরাস্ত্র পুতিনের হাতে আছে। রাশিয়ার কাছে মজুত করা পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারের ক্ষুদ্র অংশও যদি ব্যবহৃত হয়, তাহলে মানবসভ্যতার পরিসমাপ্তি হবে।
ইউক্রেন কিংবা ন্যাটো কেউই তাদের নীতিগত অবস্থান অস্পষ্ট রাখতে পারে না। রাশিয়াকে পরাজিত করার মতো যুক্তি থেকেও তাদের সরে আসতে হবে। পুতিন যুদ্ধে পরাজিত হবেন, এ যুক্তি মেনে নিলেও তার আগেই ইউক্রেন একেবারে ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদে পরিণত হবে। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান পুতিনের জন্য সত্যি সত্যি উল্টো ফল এনে দেয়, তাহলে তিনি পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার করে বসতে পারেন। এসব দিক বিবেচনায় ইউক্রেন ও ন্যাটোকে একটি শক্তিশালী, বিচক্ষণ ও যৌক্তিক শান্তি আলোচনার বিষয় ঠিক করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি এ বিষয়ে তারা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে, তত তাড়াতাড়ি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পথ থেকে একটা শান্তির পৃথিবীর দিকে আমরা যেতে পারব।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● জেফরি ডি স্যাক্স কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়নকেন্দ্রের পরিচালক