জি-৭ নেতাদের প্রতিশ্রুতি নিশ্চয়ই ফাঁকা আওয়াজ নয়
জি-৭ নেতাদের  প্রতিশ্রুতি নিশ্চয়ই ফাঁকা আওয়াজ নয়

মতামত

রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা, পশ্চিমের হাতে কেন আর সময় নেই?

এ সপ্তাহে জার্মানির বাভারিয়ায় জি-৭ নেতারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াইকে ‘দ্ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন দেওয়ার’ প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এরপর তাঁরা মাদ্রিদে ন্যাটো সম্মেলনে ভ্লাদিমির পুতিনের চলমান আগ্রাসনের বিপরীতে সামরিক এ জোটকে কীভাবে শক্তিশালী করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

জি-৭ নেতাদের এই প্রতিশ্রুতি নিশ্চয়ই ফাঁকা আওয়াজ নয়। রাশিয়ার স্বর্ণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ কীভাবে করা যায় তা নিয়ে একটা আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত তাঁরা নিয়েছেন। রাশিয়ার রপ্তানির সুযোগ সীমিত করে দিতে জ্বালানি তেলের দামের ওপর ‘প্রাইস ক্যাপ’ (নির্দিষ্ট দাম বেঁধে দেওয়া) বেঁধে দেওয়ার একটি উপায়ের বিষয়েও তাঁরা আলোচনা করেছেন। এবারের ন্যাটো সম্মেলনের শুরুতেই একটি সাফল্য আসে। ন্যাটোতে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের অন্তর্ভুক্তিকে সমর্থন দেয় তুরস্ক।

পুতিনের যুদ্ধ পঞ্চম মাসে প্রবেশ করেছে। ক্রেমলিন এখন পর্যন্ত এ যুদ্ধ বন্ধে আন্তরিক কোনো কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় যেতে রাজি হয়নি। এ পরিস্থিতিতে জি-৭ এবং ন্যাটোকে অবশ্যই কিয়েভকে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে যেসব চ্যালেঞ্জ আছে, সেগুলো মোকাবিলা করার কার্যকর পথ খুঁজে বের করতে হবে।

প্রথম বিষয় হচ্ছে, পশ্চিমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে রাশিয়াকে পরাজিত করার ক্ষেত্রে তারা যে কৌশল গ্রহণ করছে, সেটি যেন টেকসই হয়। এ জন্য খুব বেশি সময় হাতে নেই পশ্চিমা নেতাদের। কেননা, নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে এবং তার ফলে জনচাপ তৈরি হচ্ছে।

আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় পার পেয়ে যাওয়ার পথ খোলা নেই ক্রেমলিনের কাছে। নিজের নব্য-সাম্রাজ্যবাদী মনোবাসনা পূরণ করতে গিয়ে রাশিয়ার অর্থনীতিকে ‘স্বৈরতান্ত্রিক’ কাদায় ফেলে দিয়ে দিব্যি আনন্দে আছেন পুতিন। আবার তিনি এ আশাও করে যাচ্ছেন, মুক্তবাজার অর্থনীতির সূত্র ধরে বাজারের ইচ্ছা অনুযায়ী রাশিয়া তাদের তেল-গ্যাস রপ্তানি করে যাবে; আবার তাদের রুবল বিনিময়যোগ্য মুদ্রা হিসেবেও থেকে যাবে। রাশিয়া এ–ও মনে করে যাচ্ছে, তারা তাদের প্রযুক্তিপণ্য তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে বিক্রি করে যাবে। পুতিন মনে করছেন, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তা পশ্চিমের দেশগুলোর মধ্যে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে।

এই ব্যর্থতাকে উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। কেননা, বিশ্ব অর্থনীতির এখনকার যে বাজে অবস্থা, সেটির পেছনে রাশিয়া যে দায়ী, তার অনেকগুলো বিশ্বাসযোগ্য কারণ রয়েছে। বিশ্বের কৃষিবাজারে আজকের যে বিশৃঙ্খল দশা, তার জন্য ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন দায়ী। ইউরোপে গ্যাস সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে রাশিয়া। ইউক্রেনের কৃষি উৎপাদন ও বাণিজ্যে অবরোধ দিয়েছে ক্রেমলিন।

এই বিশ্বাসই এখন রাশিয়ার প্রোপাগান্ডার প্রধান অস্ত্র। রাশিয়ার পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার চেয়ে পশ্চিমারা বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে। এটা খোলা মিথ্যা কথা। কারণ, ২০২২ সালের প্রথম চার মাসে রাশিয়ায় ৬৯ শতাংশ দারিদ্র্য বেড়েছে। এটা যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার প্রথম পাঁচ সপ্তাহের প্রভাব। এর বিপরীতে পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব পড়েছে, এমন নজির খুব সামান্য।

নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে পশ্চিমের অর্থনীতি শোচনীয় হয়েছে এ রকম একটা ধারণা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে এ–ও দাবি করছেন যে নিষেধাজ্ঞার ফলে ডলারের আধিপত্য কমার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের বর্তমান মুদ্রা ও অর্থনৈতিকব্যবস্থার পরিসমাপ্তি হতে যাচ্ছে। অনেকে তো ‘আমেরিকান সাম্রাজ্য’ পরিসমাপ্তির ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন।

যদিও এসব কল্পনাপ্রসূত পূর্বাভাস সত্যে পরিণত হওয়ার সুযোগ খুব কম, তারপরও রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের নীতির ক্ষেত্রে যে দুর্বলতা, তাতে পশ্চিমা দেশগুলোকে বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে সেটি আরও বাড়বে। মস্কো এখন যেসব ইউরোপীয় দেশ তাদের রুবলে তেল-গ্যাসের দাম পরিশোধ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে, বেছে বেছে তাদের তেল-গ্যাস দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ইউরোপের এই বাণিজ্যের সুযোগ খোলা রাখা, রুবলকে বিনিময়ে এবং তেল-গ্যাস বিক্রির মুদ্রা হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ খোলা রাখায় মস্কোর রাজস্ব আয় আবার বাড়তে শুরু করেছে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ও এর পাল্টা হিসাবে রাশিয়ার ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার ফলে তেল-গ্যাসের দাম আকাশচুম্বী হয়েছে। এতে পশ্চিমের দেশগুলো মূল্যস্ফীতির মুখে পড়েছে। আগামী শীতে গ্যাস রেশনিং ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জার্মানি। রাশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশ। যুদ্ধের কারণে বিশ্বে সারের সংকট দেখা দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এতে শুধু বিশ্বের অর্থনৈতিক সরবরাহ শৃঙ্খলে হুমকি তৈরি হচ্ছে না, কৃষকদের জীবনযাত্রাও হুমকিতে পড়ছে। এসব চাপ অব্যাহত থাকবে যদি রাশিয়ার আগ্রাসন চলতেই থাকে। কিন্তু রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি। রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর ‘প্রাইস ক্যাপ’ বসানোর প্রস্তাবও কেবল বিবেচনাধীন রয়েছে। জি-৭ সম্মেলনে নেতারা এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

এখন পশ্চিমাদের এমন এক নীতি গ্রহণ করতে হবে, যাতে রাশিয়ার অর্থনীতি ও যুদ্ধাস্ত্রকে নিবৃত্ত করা যায়

এখন পশ্চিমাদের এমন এক নীতি গ্রহণ করতে হবে, যাতে রাশিয়ার অর্থনীতি ও যুদ্ধাস্ত্রকে নিবৃত্ত করা যায়। সেটিকে বাড়ানোর উপায়ও খুঁজতে হবে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নিষেধাজ্ঞার পক্ষে জনসমর্থন গড়ে তোলা। বাইডেন প্রশাসন এ রকম কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল। তারা মূল্যস্ফীতির জন্য ভ্লাদিমির পুতিনকে দোষারোপ করেছিল এবং জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিকে ‘পুতিনের কারণে মূল্যবৃদ্ধি’—এ রকম তকমা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাতে সফলতা আসেনি।

এই ব্যর্থতাকে উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। কেননা, বিশ্ব অর্থনীতির এখনকার যে বাজে অবস্থা, সেটির পেছনে রাশিয়া যে দায়ী, তার অনেকগুলো বিশ্বাসযোগ্য কারণ রয়েছে। বিশ্বের কৃষিবাজারে আজকের যে বিশৃঙ্খল দশা, তার জন্য ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন দায়ী। ইউরোপে গ্যাস সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে রাশিয়া। ইউক্রেনের কৃষি উৎপাদন ও বাণিজ্যে অবরোধ দিয়েছে ক্রেমলিন।

মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা পশ্চিমের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দুর্ভোগের উৎস নয়। পশ্চিমকে অবশ্যই স্পষ্ট করতে হবে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত ইউক্রেনীয়দের রক্তের দাগ রাশিয়ার হাতে লেগে থাকবে, তত দিন পর্যন্ত মস্কো তাদের গ্রহণযোগ্য অংশীদার হতে পারে না।
পশ্চিমা দেশগুলোতে জনগণের মনোযোগ এখন ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে সরে যাচ্ছে। ভোটাররা মানবিক সংকটের চেয়ে অর্থনৈতিক সংকটকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আগামী নির্বাচনগুলোতে এর প্রভাব পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে খুব স্পষ্ট করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফিরে আসার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ট্রাম্প ফিরলে ন্যাটোতে আবার অনৈক্য ফিরে আসবে। ক্রেমলিনের ওপর নিষেধাজ্ঞাও প্রত্যাহার করে নিতে পারেন তিনি। একই ধরনের হুমকি ইউরোপেও রয়েছে। জনতুষ্টিবাদী অতি ডান কিংবা অতি বামেরা সেখানে ক্ষমতায় আসতে পারে। সে কারণে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধে জেতার জন্য নিষেধাজ্ঞাকে বিধিবদ্ধ করার সময় এসেছে।

আল জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে
ম্যাক্সিমিলিয়ান হেস লন্ডনভিত্তিক ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ফেলো