ইউক্রেনীয়রা রুশ বাহিনীকে প্রতিরোধ করেছে এবং যুদ্ধ প্রলম্বিত হয়েছে
ইউক্রেনীয়রা রুশ বাহিনীকে প্রতিরোধ করেছে এবং যুদ্ধ প্রলম্বিত হয়েছে

রাশিয়াকে চাপে রেখে কতটা ফল পাবে পশ্চিম

এ বছরটা রাশিয়ার বিড়ালদের জন্যও ভালো গেল না। গত ৩ মার্চ ইন্টারন্যাশনাল ফেলিন ফেডারেশন আন্তর্জাতিক বিড়াল প্রদর্শনীতে রুশ বিড়ালের অংশগ্রহণকে নিষিদ্ধ করেছে। রুশ বিড়াল কেন নিষিদ্ধ করা হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে ফেডারেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর ফেডারেশন ‘কিছু করতে’ পারেনি, তাই এর মধ্য দিয়ে তারা ‘কিছু একটা’ করল।

এরপর অল ইংল্যান্ড লন টেনিস অ্যাসোসিয়েশন এপ্রিলে উইম্বলডন টুর্নামেন্টে রুশ অ্যাথলেটদের নিষিদ্ধ করে। এর কারণ হিসেবে অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, এই টুর্নামেন্টে রুশ টেনিস খেলোয়াড়েরা যোগ দিতে পারলে সেটি ‘রুশ প্রোপাগান্ডার লাভ’ হবে। যে খেলোয়াড়দের বেশির ভাগই রাশিয়ার বাইরে বড় হয়েছেন এবং রাশিয়ায় আর ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তাঁরা এ খেলায় যোগ দিলে কীভাবে রুশ প্রোপাগান্ডার লাভ হবে, সে বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অবশ্য বিস্তারিত কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।

ঠিক একইভাবে এখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত রুশ অভিজাত ব্যবসায়ীদের নিশানা করা হচ্ছে। তাঁদের এখন নানা ধরনের আইনের মারপ্যাঁচে আটকানো হচ্ছে। তাঁরা কখন কোথায় কোন আইন লঙ্ঘন করেছেন, তা খুঁজে খুঁজে বের করে মামলা দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার বিরুদ্ধে পশ্চিমা সমাজে একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে উঠেছে। সব পর্যায় থেকে রাশিয়ার এ অন্যায্য আক্রমণের নিন্দা জানানো হচ্ছে। এবার আসুন আমরা একটু পেছনের দিকে ফিরে তাকাই।

১৯৮৯ সালের ২০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র পানামার ক্ষমতাসীন জেনারেল ম্যানুয়েল নরিয়েগার পতন ঘটানোর জন্য অভিযান চালিয়েছিল। কুখ্যাত নরিয়েগা সর্বজনবিদিত একজন আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। একসময় সিআইএর ‘মূল্যবান সম্পদ’ও ছিলেন নরিয়েগা। মাত্র পাঁচ সপ্তাহের অভিযানে ২৩ জন আমেরিকান সেনার প্রাণহানির মধ্য দিয়ে নরিয়েগা সরকারের পতন হয় এবং পানামায় যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত একটি পুতুল সরকার ক্ষমতায় বসে। জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র পানামায় স্পষ্ট একতরফা আক্রমণ হওয়ায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৭৫-২০ ভোটে নিন্দা প্রস্তাব পাস হয়েছিল। সে সময় ভোটদানে বিরত ছিল ৪০টি দেশ। নিরাপত্তা পরিষদেও নিন্দা প্রস্তাব তোলা হয়েছিল। তাতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ভেটো দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ আগ্রাসন আন্তর্জাতিকভাবে কোনো তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারেনি।

১৯৭৩ সালে ভারত আন্তর্জাতিক মহলের সমালোচনা ওঠার আগেই একঝটকায় সিকিম দখল করে ফেলেছিল। ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে জয় করা সিরিয়ার গোলান উপত্যকা ১৯৮১ সালে একীভূত করে নেয়। এর বিরুদ্ধে বিশ্ব সম্প্রদায় কখনোই উচ্চকিত হয়নি। কিন্তু ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করার পর পশ্চিমারা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেয়। এখন সমগ্র পশ্চিম ইউক্রেনকে সহায়তা দিচ্ছে এবং রাশিয়াকে সব দিক থেকে কোণঠাসা করছে। এর একটাই পরিণতি। সেটি হলো দীর্ঘমেয়াদি লড়াই। আর এর একটাই সমাধান। সেটি হলো আলোচনার টেবিল ও কূটনীতি।

২০০৩ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদেশ যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও পোল্যান্ডকে সঙ্গে নিয়ে ইরাকে যে অভিযান চালায়, তার পক্ষে যুক্ত দিতে গিয়ে তারা বলেছিল, ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে এবং সেই অস্ত্রের হুমকি থেকে বিশ্ববাসীকে বাঁচানোর জন্য তারা অভিযান চালিয়েছে। পরে দেখা গেছে, সাদ্দামের হাতে সে ধরনের কোনো অস্ত্র ছিল না। এবারও ওয়াশিংটন তার সামরিক অভিযানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়। তার মানে পশ্চিমারা সম্পূর্ণ অবৈধ উপায়ে এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন করে ইরাকে আক্রমণ করেছিল। তৎকালীন বুশ প্রশাসনও এ অভিযানকে ‘অবৈধ কিন্তু ন্যায়সংগত’ বলে দাবি করেছিলেন।

অতি আশ্চর্য রকমভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে, রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানকে নিন্দা জানিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে যেভাবে জনমত গড়ে তোলা হয়েছে, তার সিকি ভাগও ইরাক যুদ্ধের সময় পশ্চিমা সমাজে দেখা যায়নি। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া একতরফা যুদ্ধের কারণে কেউ তখন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা উচিত বলে মন্তব্যও করেনি। তখন কেউ সাদ্দাম হোসেনের প্রতি কোনো অনুকম্পা দেখায়নি। ওই যুদ্ধের অভিঘাতে কী পরিমাণ বৈশ্বিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা নিয়ে এখনকার মতো কোনো প্রচার–প্রচারণাও ছিল না।

অবশ্য খেলাটা যদি ভ্লাদিমির পুতিনের হিসাব–নিকাশ অনুযায়ী হতো, তাহলে হয়তো তাঁকে এখন যতটা চাপের মুখে পড়তে হচ্ছে, ততটা পড়তে হতো না। পুতিন ভেবেছিলেন, ইউক্রেনের মানুষ, বিশেষ করে রুশপন্থী ইউক্রেনীয়রা রুশ বাহিনীকে স্বাগত জানাবে এবং অতি দ্রুত তিনি ভলোদিমির জেলেনস্কিকে সরিয়ে সেখানে একজন রুশপন্থী নেতাকে বসিয়ে আসতে পারবেন। কিন্তু সোভিয়েত ভাঙার পর ইউক্রেনের মানুষের মধ্য থেকে রাশিয়ার মোহ যে কেটে গেছে, তা হয়তো তিনি বুঝতে পারেননি। এ কারণে ইউক্রেনীয়রা জাতীয়তাবাদী চেতনা নিয়ে রুশ বাহিনীকে প্রতিরোধ করেছে এবং যুদ্ধ প্রলম্বিত হয়েছে। এটি রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমের প্রচারকে জোরালো করতে সহায়তা করছে। চীনের গৃহযুদ্ধ কিংবা ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে প্রথম আফগান যুদ্ধে আমেরিকা সুচিন্তিতভাবে পরাজিত হওয়ার পথে থাকা পক্ষকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছে। সেই পক্ষ লড়াই চালিয়ে যেতে না চাইলেও আমেরিকা তাদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে তাদের মাঠে রেখেছে। ইউক্রেনেও যুক্তরাষ্ট্র একই কাজ করছে।

১৯৭৩ সালে ভারত আন্তর্জাতিক মহলের সমালোচনা ওঠার আগেই একঝটকায় সিকিম দখল করে ফেলেছিল। ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে জয় করা সিরিয়ার গোলান উপত্যকা ১৯৮১ সালে একীভূত করে নেয়। এর বিরুদ্ধে বিশ্ব সম্প্রদায় কখনোই উচ্চকিত হয়নি। কিন্তু ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করার পর পশ্চিমারা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেয়। এখন সমগ্র পশ্চিম ইউক্রেনকে সহায়তা দিচ্ছে এবং রাশিয়াকে সব দিক থেকে কোণঠাসা করছে। এর একটাই পরিণতি। সেটি হলো দীর্ঘমেয়াদি লড়াই। আর এর একটাই সমাধান। সেটি হলো আলোচনার টেবিল ও কূটনীতি।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
আলেক্সান্ডার ক্যাসেলা সুইজারল্যান্ডের বংশোদ্ভূত সাংবাদিক