২২ আগস্ট প্রথম আলোর মহানগর পাতার শীর্ষ খবরটির শিরোনাম ছিল, ‘৫৩ কোটি টাকার সড়কের সুফল পাচ্ছে না মানুষ’। রাজশাহী নগরের নবনির্মিত একটি সড়ককে কেন্দ্র করে প্রকাশিত ওই খবরের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, ‘সড়কটির সিংহভাগই প্রায় অলস পড়ে থাকে।’ সড়ক অলস পড়ে থাকার সংবাদ থেকে এমন মনে হতে পারে যে রাজশাহী নগরের উন্নয়ন উপচে পড়ছে। অর্থাৎ প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করা হয়েছে। আবার এমনও মনে হতে পারে, আজ যা উপচে পড়ছে, কাল তা কাজে লাগবে। অর্থাৎ, দূর ভবিষ্যতের চিন্তা মাথায় রেখে অত্যন্ত পরিকল্পিত পথে এগোচ্ছে রাজশাহী নগর।
বাস্তব অবস্থা হলো, যাঁরা উন্নয়নের মহিমাকীর্তন করেন, ৫৩ কোটি টাকার ফায়ার ব্রিগেড-সিটিহাট সড়কটি তাঁদের গালে থাপড় মেরে দেখিয়ে দিচ্ছে রাজশাহী নগরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কতটা অপরিকল্পিত। আসলে রাজশাহী নগরের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিনোদপুর-উৎসব সিনেমা, আলুপট্টি-সাহেববাজার-ফায়ার ব্রিগেড, সাগরপাড়া বটতলা-রানীবাজার সড়কগুলো যখন যানজট-জনজটে বছরের পর বছর স্থবির হয়ে থাকে, তখন অলস পড়ে থাকা ফায়ার ব্রিগেড-সিটিহাট সড়কটি উন্নয়নের ক্ষেত্রে কেবল এক বিদ্রূপাত্মক প্রতীকে পরিণত হয়।
ইট-বালু-সিমেন্টের পোশাকি উন্নয়ন ধারণা এ দেশের সাধারণ মানুষের চোখে ঠুলি পরিয়ে রেখেছে। ফলে কেবল ভৌত অবকাঠামো বা অট্টালিকা তাদের কাছে হয়ে উঠেছে উন্নয়নের মাপকাঠি। উন্নয়নের সঙ্গে নাগরিকের নানা অধিকার ও দায়িত্ববোধের সম্পর্ককে অনেকেই এখন আর বোধে আনেন না। বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধিও এই সুযোগটিই গ্রহণ করেন। হীন ব্যক্তিস্বার্থে তাঁরা নানা দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাধারণের চোখে ধুলা দিয়ে চলেন।
রাজশাহী নগরের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলোর কর্তারা কতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন, তার প্রমাণ মেলে ২৩ আগস্ট প্রথম আলোয় প্রকাশিত আর একটি খবর থেকে। প্রথম পাতায় প্রকাশিত খবরটির শিরোনাম হলো ‘কাটা রাস্তার নগর রাজশাহী: মেরামতের উদ্যোগ নেই’। খবরটির মূল তথ্য হলো, বছর দুই আগে রাজশাহী নগরের বাসাবাড়িতে গ্যাসের সংযোগ দেওয়া শুরু হয়। নিয়ম অনুযায়ী গ্রাহকদের কাছ থেকে সংযোগের আগেই রাস্তা খোঁড়া ও মেরামতের জন্য নিয়ে নেওয়া হয় টাকা। সিটি করপোরেশন এভাবে পাকা রাস্তার জন্য প্রতি বর্গমিটারে ৩ হাজার ১৯০ টাকা করে নিয়েছে। কিন্তু দুই বছরেও রাস্তা মেরামত করা হয়নি। বর্তমানে নগরের ৪১০ কিলোমিটার রাস্তায় ৮ হাজার ৮০০ স্থানে খোঁড়াখুঁড়ি রয়েছে। এতে বিশেষ করে বয়স্ক ও অসুস্থ যাত্রীরা রিকশা ও অন্যান্য যানবাহনের ধাক্কায় প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। রাতের অন্ধকারে কাটা রাস্তার ধাক্কায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে অনেকেই। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তাদের এতে ভ্রুক্ষেপ নেই।
সাধারণত টাকার অভাবে রাস্তার কাজ হয় না, এমন কথা শুনেই মানুষ অভ্যস্ত। কিন্তু নিজ পকেটের টাকা খরচ করে দুর্ভোগ কেনার এমন নজিরে মানুষ হতবাক। সিটি করপোরেশন ‘এই তো হচ্ছে–হবে’ গোছের জবাব দিয়ে যাচ্ছে। এভাবে একদিন গ্যাসের খোঁড়াখুঁড়ি যখন মেরামত হয়ে যাবে, তখন হয়তো শুরু হবে পানির লাইন বা নর্দমার খোঁড়াখুঁড়ি। মোটকথা, সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ‘উন্নয়নের’ হাত থেকে নগরবাসীর রেহাই নেই।
গত পাঁচ থেকে সাত বছরে রাজশাহী নগরের কিছু পরিবর্তন বাইরে থেকে চোখে পড়ে। পদ্মার ধারে গেলে বেশ ফিটফাট মনে হয়। সাহেববাজার থেকে গৌরহাঙ্গা পর্যন্ত অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত রাস্তায় চলতে এখন আগের চেয়ে ভালোই লাগে। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, এসব উন্নয়ন অন্তঃসারশূন্য।
রাজশাহী নগরের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ এখনো সাপ্লাই পানির সুযোগ থেকে বঞ্চিত। অন্যদিকে, প্রায় শতভাগ মানুষই বঞ্চিত বিশুদ্ধ পানির অধিকার থেকে। এখানে প্রতিদিন পানির চাহিদা প্রায় ১৫ কোটি লিটার। অথচ ৮ থেকে ৯ কোটি লিটারের বেশি পানি পাওয়া যায় না। আর এ পানি কতটা বিশুদ্ধ, সে প্রশ্নের জবাব মিলবে যখন আপনি স্নানাগারে প্রবেশ করবেন। মাথার ওপরের ঝরনা থেকে ভালো পানি আসতে আসতে হঠাৎ করেই নেমে আসবে কালো মরিচা মেশানো পানি। তখন দেখতে পাবেন ‘উন্নয়ন’ আপনার গা বেয়ে চুইয়ে পড়ছে।
চার বছর আগে পদ্মার পানি শোধন করার জন্য ৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে শ্যামপুরে একটি শোধনাগার নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এটি বছরের মধ্যে কয়েক মাস মাত্র চালু থাকে। আর যখন চালু থাকে, তখন বিশুদ্ধ পানির চাহিদা মেটে সামান্যই। এখানকার গভীর নলকূপগুলোর পানিতে মরিচাজাতীয় নোংরা এত বেশি থাকে যে পানির পাইপ, ট্যাপ বা ঝরনা ঘন ঘন জ্যাম হয়ে যায়। আর চর্মরোগসহ অন্য অসুখ তো লেগেই থাকে। অথচ এই পানির জন্য নগরবাসীকে পয়সা গুনতে হয় ঠিকই।
নগরজুড়ে এখন ব্যাটারিচালিত ত্রিচক্রযানের দাপট। করপোরেশন বলছে, অনুমোদিত গাড়ির সংখ্যা চার হাজারের বেশি নয়। বাস্তবে গাড়ি চলছে প্রায় ১০ হাজার। প্রয়োজনের অতিরিক্ত এসব গাড়ির কারণে রাস্তা পারাপার পর্যন্ত অসম্ভব হয়ে ওঠে। ইদানীং আবার ব্যাটারির সংযোগ দিয়ে বিপুলসংখ্যক রিকশাও রাস্তায় নেমেছে। এগুলোর গতি নিয়ন্ত্রিত না হওয়ায় আরোহীকে সব সময় আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। ঘন ঘন ঘটে দুর্ঘটনা। কে বা কারা রিকশায় ব্যাটারিচালিত মোটর সংযোগের বুদ্ধি বাতলেছে, তা-ও জানা শক্ত। সবকিছু চলছে যথেচ্ছ। কী করলে জনপরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব, এমন ভাবনা ভাবার মানুষ আছে বলে আর মনে হয় না।
নগরের শিশু-কিশোরেরা সব থেকে বেশি অসহায়। মহল্লায় তাদের ছোটাছুটি বা খেলার কোনো মাঠ নেই। নেই কোনো পার্ক। সাঁতার কাটার জন্য নেই কোনো পুকুর। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে অসংখ্য পুকুর ভরাট করে ফেলেছেন। যত্রতত্র অপরিকল্পিত নির্মাণকাজ ক্রমান্বয়ে শিশু-কিশোরদের শ্বাসরোধ করে ফেলছে। অবশ্য শিশুমন শ্বাসরোধের এই বাধা মানবে কেন? তাই বিকেল হলেই তারা ব্যাট-বল নিয়ে নেমে পড়ছে গলির রাস্তায়। এরপর পাশের বাড়ির জানালার কাচ ভাঙছে। চলন্ত যানবাহনের চালক-যাত্রীরা নাজেহাল হচ্ছে। খেলা উঠছে মাথায়। শিশুরা জড়িয়ে পড়ছে বচসায়।
নগরে বিনোদনের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। একসময় নগরে চারটি সিনেমা হল ছিল, এখন তা একটিতে দাঁড়িয়েছে। এখানে থিয়েটারের কোনো হল নেই। ঐতিহ্যবাহী টাউন হল ভেঙে মার্কেট বানানো হয়েছে। সুস্থ সাংস্কৃতিক আড্ডারও কোনো স্থান নেই নগরে। অথচ রাজনৈতিক নেতারা বড়াই করে এই নগরকে বলছেন শিক্ষার নগর। শিক্ষা-সংস্কৃতি থেকে আলাদা কিছু অথবা উন্নত সংস্কৃতি নির্মাণ শিক্ষার উদ্দেশ্য নয়, এমন কুশিক্ষা আজকের প্রজন্ম অর্জন করছে এই নেতাদের কাছ থেকেই।
রাজশাহী নগরে সুষ্ঠু কোনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। একসময় রাস্তার মোড়ে মোড়ে সিমেন্টেড ডাস্টবিন নির্মাণ করা হলো। কিছুদিন পর দেখা গেল, সেগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। এখন করপোরেশনের কর্মীরা সন্ধ্যায় ভ্যানগাড়িতে করে ডাস্টবিন নিয়ে বাড়ি বাড়ি হাজিরা দেন। বাঁশি বাজিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁরা এ জন্য প্রতি মাসে টাকাও নিয়ে থাকেন। বাড়িতে লোক থাকলে এই চলমান ডাস্টবিনে নোংরা ফেলা সম্ভব হয়। কিন্তু বাড়িতে নির্ধারিত সময়ে লোক না থাকলে অথবা কোনো দিন ভোরে বা দুপুরে বাসাবাড়ির লোকজন সবাই কয়েক দিনের জন্য বাইরে চলে গেলে বাসার জমানো নোংরা তারা কোথায় ফেলবেন, সেই চিন্তা কিন্তু করপোরেশনের কর্তাদের মাথায় নেই।
আগেই উল্লেখ করেছি, নগরের বাসাবাড়িতে দুই বছর আগে পাইপলাইনে গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হয়। এই সংযোগের মাধ্যমে নগরবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা আলোর মুখ দেখে। এর পেছনে সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের প্রচেষ্টাও ছিল। কিন্তু এই গ্যাসের সংযোগকাল এখন বিপুলসংখ্যক গ্রাহককে বৈষম্যের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। গ্যাসের সংযোগ পাওয়ার জন্য আবেদন ছিল প্রায় ২১ হাজার।
সংযোগ পেয়েছেন সাড়ে ৯ হাজারের মতো গ্রাহক। এরপরই সংযোগ বন্ধ। ফলে দুই বছর হলো সংযোগবঞ্চিত প্রায় সাড়ে ১১ হাজার গ্রাহক গৃহস্থালির জ্বালানির জন্য চার গুণ বেশি ব্যয় করছেন। নগরবাসী সবাই সমান কর দেন। সুতরাং কেন কিছুসংখ্যক মানুষ বৈষম্যের শিকার হবেন, এ প্রশ্নের উত্তর কি কর্তাব্যক্তিরা দিতে পারেন?
কর্তারা সাধারণত জবাব দেন না। নির্বিকার থাকেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে অধিকার আদায়ের ব্যাপারে নির্বিকার নগরবাসীও। যেন এটাই নিয়তি হিসেবে তাঁরা মেনে নিয়েছেন। অবশ্য রাজশাহী শহর রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের কিছু কর্মী বেশ কয়েক বছর হলো সোচ্চার। মাঝেমধ্যে নানা কর্মসূচি ও দাবিতে তাঁরা মাঠেও নামেন। তবে নানা বৈষম্য ও অধিকার বিষয়ে নগরবাসীর পক্ষে তাঁরা এখন পর্যন্ত কোনো ক্ষতিপূরণ মামলা করেছেন কি না, তা জানা যায় না। মামলা করে রাতারাতি সমস্যার সমাধান হবে এমন নয়। কিন্তু এতে তো অন্তত জনসচেতনতা সৃষ্টি হতে পারে। নগরবাসীর মধ্যে এ বোধ জাগ্রত হতে পারে যে তাদের দুর্ভোগ কোনো নিয়তি নয়।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার।