নির্মমতা

রাজন রে!

সামিউল রাজন
সামিউল রাজন

রাজন মানে রাজা। এক দরিদ্র বাবা-মায়ের বড় ছেলের এই ডাকনামের সঙ্গে নিশ্চয় জড়িয়ে ছিল অনেক আদর আর অনেক বড় স্বপ্ন। এই বাবা-মা অনেক দুঃখ-কষ্ট করে ১৪ বছর রাজনকে লালন করেছিলেন। আরও বড় করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু ৮ জুলাই সকালে সিলেট মহানগরের কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডে জনা চারেক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ, একজনের বয়স ৪৫, বড় রাস্তার ধারে দোকানঘরের খুঁটিতে বেঁধে লোহার রোলার দিয়ে পিটিয়ে রাজনকে হত্যা করলেন। অভিযোগ, শিশুটি তাঁদের ওয়ার্কশপ থেকে একটি ভ্যানরিকশা চুরি করছিল।
অন্তত আধা ঘণ্টা ধরে শিশুটিকে তাঁরা চোরের মার মারলেন। আরও তিন-চারজন সেখানে হাজির ছিলেন। কেউ ঠেকালেন না। ছোট্ট ছেলেটাকে বাঁচানোর মতো রহম অথবা সাহস কারও হলো না। বরং নির্যাতনকারীদের নির্দেশে এঁদের একজন ফেসবুকে তোলার জন্য চোর-শাসনের পুরো দৃশ্য মুঠোফোনে ভিডিও করলেন।
সংসারের বাজারখরচ চালাতে ভোরে আড়ত থেকে সবজি নিয়ে বেচতে বেরিয়েছিল রাজন। ছোট্ট শরীরটাতে মায়ের আদরের স্পর্শ তখনো নিশ্চয় লেগে ছিল। সেই শরীরে ময়নাতদন্ত ৬৪টি আঘাতের চিহ্ন পেয়েছে। টানা মারের চোটে মাথার ভেতরে রক্ত ঝরে সকালের মধ্যেই ছেলেটা মরে যায়। তার লাশ গুম করতে গিয়ে নির্যাতনকারীদের একজন স্থানীয় মানুষজনের হাতে আটক হন।
প্রায় আধা ঘণ্টার ভিডিও চিত্রটি তুলেছিলেন ২৪ বছর বয়সী এক তরুণ। সিলেটে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক উজ্জ্বল মেহেদী সেই ফুটেজ জোগাড় করেন ১০ জুলাই রাতে। ১২ জুলাই সকালে প্রথম আলোর শেষের পাতায় চারটি খবরের নিচে, দুই বিজ্ঞাপনের মধ্যকার ফোকরে ‘নির্মম পৈশাচিক’ শিরোনামে মো. সামিউল আলম ওরফে রাজনকে হত্যার খবরটা পড়ি। সেদিন টিভি চ্যানেলগুলোতেও খবরটা আসে, নির্যাতনের টুকরো টুকরো ছবিসহ। আগের রাতে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে ভিডিওচিত্রটি প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ঝড় শুরু হয়ে যায়।
আমার সাহস কম। উজ্জ্বলের লেখা প্রতিবেদনে ভিডিও চিত্রের বিবরণ বুকটা খামচে ধরেছিল। সেই নির্যাতনের ছবি কিছুতেই আমি দেখতে চাইনি। কিন্তু পত্রিকাগুলোর ছবিতে বড় মানুষদের হাতে মার খেতে থাকা ছোট্ট রাজনের কান্নাভরা অসহায় মুখ, পিছমোড়া করে খুঁটিতে হাত-বাঁধা বেঁকেচুরে এলিয়ে পড়া শরীরটা তো দেখতে হয়েছে। তারপর অনলাইনে এক টিভির খবরে ওই ভিডিওর শুরুটা দেখে আর দেখতে পারলাম না। ওরে রাজন রে! কানে গেঁথে গেল তোর থেকে থেকে নিরুপায় আর্তনাদ—‘ও মাই গো।’ চোখ-কান বন্ধ করে বাঁচতে চাই না। চোখ-কান খুলে রাখলে বাঁচা দুঃসহ। এই লেখাটা গুছিয়ে লেখা কঠিন।
বড়দের নিষ্ঠুরতার কাছে শিশুরা সবচেয়ে অসহায়। অসহায়ের মধ্যে অসহায় হচ্ছে গরিবের বাচ্চা, রাস্তা-বাজারে কাজ করা বাচ্চা, পথশিশু। অনেক বছর আগে খবর করার সুবাদে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার বহু পথশিশুর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। রাজনের মুখ, রাজনের কণ্ঠস্বর সে সময় শোনা নিষ্ঠুরতার টুকরো টুকরো অনেক বয়ান মনে করিয়ে দিচ্ছে।
ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ার পর রাজনের পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে যে স্কুলে পড়ত, সেখানকার এক শিক্ষক উজ্জ্বল মেহেদীকে বলেছেন, ছেলেটি একটু আলাভোলা, বোকাসোকা ধরনের ছিল। ১৩ জুলাই সকালে যশোর থেকে ছোট বোন-স্থানীয় স্বপ্নার কান্নাজড়ানো ফোন পেলাম। সে রাজনকে মারার এক টুকরো দৃশ্য টিভিতে দেখে ফেলেছে। তার নিজের ছেলের অটিজম আছে। রাজনের হতবিহ্বল কান্না আর অসহায়, নিষ্পাপ চেহারায় স্বপ্না নিজের ছেলের মুখ দেখতে পেয়েছে।
৮ জুলাই সারা দিন রাজনের মা লুবনা আক্তার ছেলের ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন। নিখোঁজ ছেলের সন্ধানে রাতে থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে গিয়ে বাবা শেখ মো. আজিজুর রহমানকে ছেলের লাশ শনাক্ত করতে হলো। বাবার অভিযোগ, তিনি মামলা করতে চাইলে পুলিশ তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে; তারা প্রধান একজন আসামিকে সৌদি আরবে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
এখন ফেসবুকে, সংবাদমাধ্যমে এবং সমাজের নানা স্তরে তীব্র প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়ার মুখে পুলিশ-প্রশাসন জেগে উঠেছে। সাধারণ মানুষ আসামিদের ধরিয়ে দিচ্ছে। সেই সঙ্গে পুলিশেরও তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। জনমানুষের সংবেদনশীলতার এই চাপ না থাকলে সামান্য ভাড়াগাড়ির চালকের ছেলেকে পিটিয়ে মারা কতটা মনোযোগ পেত, তা নিয়ে সন্দেহ জাগে। এ দেশে এমন ঘটনার তো আকাল নেই।
দুর্বলের ওপর সবল-প্রবলের পীড়ন এ সমাজে দিনে দিনে সহজ, স্বাভাবিক ও ব্যাপক হচ্ছে। সবল-প্রবলেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে, এটা মানুষ মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। নানা মাত্রায় বৈষম্যের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে রাগ-ক্ষোভ-অসহিষ্ণুতা নিরাপত্তাহীনতা। অসুস্থ সমাজে অসুস্থ মানুষ বাড়ছে। বাড়ছে নিষ্ঠুরতা।

২.
প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রথম ও দ্বিতীয় দিনের খবরের সঙ্গে কোনো ছবি ছিল না। সেটা একটা ঘাটতি। তবে এ ধরনের ঘটনার ছবি ছাপা বা না ছাপার প্রশ্নটি সাংবাদিকতার বড় উভয় সংকটগুলোর একটি। সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা বলে, নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা বা সহিংসতার প্রকট ছবি, অনুপুঙ্খ বিবরণ সব বয়সী পাঠক-দর্শকের গণসংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা যায় না। কোন পাঠক কতটা নিতে পারবেন, সেটা একটা গুরুতর প্রশ্ন। ক্ষতিগ্রস্তজনকে আহত করার বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। আবার, এমন প্রকাশ নিষ্ঠুরতার জয়গান (সেলিব্রেশান) হয়ে যেতে পারে। এতে কেউ বিকৃত বিনোদন পেতে পারেন অথবা এর অনুকরণে উৎসাহী হতে পারেন। ঘটনায় শিশু জড়িত থাকলে দায়িত্ব ও স্পর্শকাতরতা বাড়ে।
অন্যদিকে, সমাজের নির্মমতা, অসহিষ্ণুতা ও অসুস্থতার মাত্রা পাঠককে বোঝানো সাংবাদিকের নীতি-নৈতিক দায়িত্ব। তবে সে কাজটি করতে হয় খুব সতর্ক ও সংবেদনশীল থেকে। আমরা চাইব, পাঠক-দর্শক যেন ঘটনাটি জেনে-বুঝে মনে গেঁথে নিয়ে প্রতিকারের জন্য সঠিক কাজটি করেন। যেন ভুলে না যান। রাজনের কান্নায় বিকৃত অসহায় চেহারা, তার নিরুপায় ‘ও মাই গো’ আর্তচিৎকার আমি ভুলতে দিতে চাই না। নিজে ভুলতে চাই না। সে ছবি দেখাব, সে কথা শোনাব বা লিখব। কিন্তু অসুস্থ নিষ্ঠুর প্রহারের ছবি দেখালে কার কী লাভ হবে?
খোপে ঢুকে বাস করতে করতে আমাদের নির্লিপ্ততার চামড়া মোটা হয়ে গেছে। আমরা ভুলে গেছি, সবাই ভালো না থাকলে প্রত্যেকে ভালো থাকা যায় না। রাজনের জন্য জাগ্রত সংবেদনশীলতা তাই আশা যেমন জাগায়, তেমনি অভ্যস্ত নির্লিপ্ততার ভয়টাও জেগে থাকে।

৩.
কাল বা পরশু ঈদ। ঘটনা-দুর্ঘটনা, আনন্দ-বেদনা, জীবনের নানা আয়োজনে দিনের পর দিন আসতে থাকবে। রাজন আর তার মায়ের মুখ মনে থাকবে তো?
কুররাতুল-আইন-তাহমিনা : সাংবাদিক।

আরও পড়ুন