বাংলাদেশের সমাজজীবন এখনো নানা অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব, সহিংসতা, সন্ত্রাস ও সংঘাতে ভরা। একদিকে রয়েছে শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ, অন্যদিকে রয়েছে আদর্শবিচ্যুত দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনীতিতে প্রধান যে সংকটটি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, তা হচ্ছে গণতন্ত্রের সংকট। এই রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণের প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, এমন একটি উত্তরণকালীন সমাধান খুঁজে বের করা, যাতে একই সঙ্গে গণতন্ত্র ও সুশাসন ফিরিয়ে আনা যায় এবং রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জঙ্গি-সন্ত্রাসী, মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর সাময়িক নেতিবাচক উত্থান রহিত ও পরাজিত হয়। সেটা সম্ভব হলে আমরা মহাবিপদের হাত থেকে মুক্ত হতে পারব। এই বিশেষ সন্ধিক্ষণে গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে কমরেড মণি সিংহের কাছ থেকে সাধারণভাবে জাতি এবং বিশেষভাবে তাঁর অনুসারী বামপন্থীরা কী শিক্ষা পেতে পারে—তা নিয়েই আলোচনা করব।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কমরেড মণি সিংহ জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন সম্পর্কে কী বলেছিলেন, তার বিবরণ পাওয়া যায় স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রে দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারে। তিনি বলেছিলেন ‘নির্বাচনের ফলাফল মূল্যায়ন করে আমরা (কেন্দ্রীয় কমিটি) আরও দেখেছিলাম যে, আওয়ামী লীগ কেবল “পূর্ব-পাকিস্তানের” জনগণেরই সর্বাত্মক সমর্থন পায়নি, তৎকালীন পাকিস্তানের সরকার গঠনের অধিকার লাভ করেছে।...পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো এবং এই শাসকদের মদদদাতা সাম্রাজ্যবাদ কিছুতেই নির্বাচনের এই ফলাফল মেনে নেবে না এবং তা বানচাল করার ষড়যন্ত্র করবে।...এমতাবস্থায় বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকেই অগ্রসর হবে এবং সে সংগ্রামের জন্য জনগণকে প্রস্তুত করা দরকার।’
পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সেদিকে এগিয়ে গেলে, পাকিস্তানের দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মভিত্তিক দল ও শক্তিগুলো পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। এই মুষ্টিমেয় অংশকে বাদ দিয়ে স্বাধীনতার প্রশ্নে ব্যাপক জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার প্রশ্ন ১৯৭১ সালে সামনে চলে আসে। তখন বামপন্থীদের মধ্যে দুটি মত বিরাজ করছিল। একটি মত ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণ করা। অপর মতটি মুক্তিযুদ্ধকে দেখছিল ‘দুই কুকুরের লড়াই’ হিসেবে। এই দ্বিতীয় মতটি ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী’ এবং ‘মুক্তিযোদ্ধাদের বাহিনী’ উভয়কেই সমশত্রু জ্ঞান করে সমদূরত্বের নীতির পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। বিভ্রান্ত চীনাপন্থীদের বৃহৎ একটি অংশ তখন এই অবস্থান গ্রহণ করে।
এই উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায়, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ‘জাতীয় ইস্যুতে’ জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে এগোনোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন কমরেড মণি সিংহ। ‘জাতীয় ইস্যু’র বিপরীতে সংকীর্ণ বামপন্থী অবস্থানকে তিনি ‘বিভেদ সৃষ্টিকারী’ এবং ‘ভ্রান্ত’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন এবার ‘গণতন্ত্র ও সুশাসনের’ সংকটকে কেন্দ্র করে সে রকম কোনো জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব ছিল কি?
আমরা জানি সাধারণত ‘জাতীয় ঐক্যের’ মধ্যে বাম ও ডানপন্থী উভয় প্রকার শক্তি বিদ্যমান থাকে। সেই জাতীয় ঐক্য জনগণের স্থায়ী কল্যাণে কতটুকু কাজে আসবে, তা নির্ভর করে ঐক্যের ভেতরে শক্তির ভারসাম্য ও নেতৃত্বের শ্রেণিচরিত্রের ওপর। এ বিষয়টি সম্পর্কে কমরেড মণি সিংহ কি সজাগ ছিলেন? তিনি কি ‘জাতীয় ঐক্যের’ অবস্থান নিতে গিয়ে জাতীয় ঐক্যের অভ্যন্তরে ‘বিভিন্ন শ্রেণিগুলোর অভ্যন্তরীণ সংগ্রামের’ দিকটিকে ভুলে গিয়েছিলেন বা তার ওপর জোর কম দিয়েছিলেন? এই প্রশ্নটিও বিচার করা প্রয়োজন। মণি সিংহের সাক্ষাৎকারের আরেক অংশে আছে—
‘আমরা আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতার পক্ষের সকল শক্তির বৃহত্তম জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলাম। এই প্রচেষ্টা তেমন সফল হয়নি। শেষের দিকে বাংলাদেশ সরকারের “পরামর্শদাতা কমিটি” গঠিত হয় এবং তাতে আমাদের পার্টির প্রতিনিধিরূপে আমি ছিলাম। সশস্ত্র সংগ্রামের অগ্রগতির পর্যায়ে আমাদের উভয় দলের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য ছিল। আমরা মুক্ত এলাকা গড়ে তুলে সেখানে প্রগতিশীল অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক নীতি গ্রহণ ও কার্যকর করার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের মডেল জনগণের কাছে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতাম এবং ওই রকম রণকৌশল গ্রহণের কথা বলতাম। আমরা স্বাধীনতাসংগ্রামকে কেবল সাধারণ জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতাম না।’
এই উদ্ধৃতি থেকে এটা স্পষ্ট যে কমিউনিস্টদের জাতীয় ঐক্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অর্থ নিছক জাতীয়তাবাদী বা নিছক বুর্জোয়া গণতন্ত্রী হয়ে যাওয়া নয় বা আত্মসত্তা বিসর্জন দেওয়া নয়। নিজস্ব পৃথক বৈশিষ্ট্য ও পৃথক রণকৌশল বজায় রাখার শর্ত মেনে নিয়েই জাতীয় ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হবে। উপরিউক্ত আলোচনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের নানা পর্বে ন্যূনতম সুনির্দিষ্ট জাতীয় ইস্যুতে বামপন্থীদের সঙ্গে অন্যান্য অ-বাম শক্তির ব্যাপক ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু সেই প্রয়োজনীয় ঐক্যের সুনির্দিষ্ট রূপ এমন হতে হবে, যাতে জাতীয় ন্যূনতম ইস্যুর সমর্থক বামপন্থীদের অন্যান্য উচ্চতর সংগ্রামগুলো চালানোর স্বাধীন সুযোগ ও অধিকার বজায় থাকে এবং ক্রমান্বয়ে তাদের শক্তির ভারসাম্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। চূড়ান্ত লক্ষ্য ও আশু লক্ষ্যের মধ্যে যাতে সংযোগ বজায় থাকে।
তবে উপরিউক্ত রাজনৈতিক দিকটি ছাড়াও অন্য আরও অনেক প্রসঙ্গে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় মণি সিংহের পুরো জীবনের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। তাঁর সততা, নিষ্ঠা, আত্মত্যাগ, সময়ানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, বিপ্লবী মানবতাবাদ, শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, অঙ্গীকার ও অকৃত্রিম ভালোবাসা; সংগঠনে অধস্তনদের প্রতি শ্রদ্ধা ও দরদ ইত্যাদি প্রতিটি বিষয়ই আমাদের নানা জনের নানা স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে আছে। গতকাল ৩১ ডিসেম্বর ছিল এই মহান নেতার ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁকে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা।
এম এম আকাশ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক
akash92@hotmail.com