মতামত

রাজনৈতিক আলাপ ‘নিষিদ্ধ’ কেন

চায়ের দোকান
চায়ের দোকান

‘পাউডার দুধের চা ১০ টাকা, রং চা ৬ টাকা, দুধ চা ৬ টাকা, প্রতি গ্লাস পানি ১ টাকা/ রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ’—এই নোটিশ টাঙানো আছে রাজধানীর সবুজবাগের সবুজ কাননের খলিল মিয়ার চায়ের দোকানে। খালি খলিল ভাইয়ের দোকানে নয়, সারা দেশে হাজার হাজার চা-দোকানে ‘রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ’ লেখা স্টিকার সাঁটা আছে। এটি চালু করেছে কে, কবে থেকে; কোন কারণে? এসব প্রশ্নের জবাব এককথায় হয় না। কিন্তু অবলা চা-খোর হিসেবে আন্দাজ করি, রাজনীতির ‘আজাইরা’ প্যাঁচালে টি স্টলে ক্যাচাল হয়। সেই ক্যাচালে কারও চার পয়সার উপকার হয় না, মাঝখান থেকে দোকানদারের কেনাবেচায় প্যাঁচ লাগে। তাই ‘কেওয়াজ’ এড়াতে এই ‘লোটিশ’ লটকানোর রেওয়াজ চালু হয়েছে।

সাধারণ ধারণা হলো, চায়ের দোকানের মতো প্রান্তিক জনপরিসরে ‘রাজনীতির আলাপ’ কোনো দামি আলাপ নয়। এই আলাপ হলো যাচ্ছেতাই আনপ্রোডাক্টিভ ফালতু প্যাঁচাল। কিন্তু রাজনীতির আলাপের মতো জীবনঘনিষ্ঠ আলাপ কী করে ফালতু প্রলাপ হয়? এই গণতান্ত্রিক ভূখণ্ডে আমাদের রুটি-রুজি, শিক্ষা-দীক্ষা, বাঁচা-মরার প্রশ্ন যে বিষয়টির সঙ্গে প্রতিমুহূর্তে জড়িয়ে রয়েছে, সেই রাজনীতির আলাপকে ‘নিষিদ্ধ’ সাব্যস্ত করার মতো অবস্থায় আমরা এলাম কী করে?

খলিল ভাইকে যদি বলি, ‘আপনার কাছে রাজনৈতিক আলাপ আসলে কোন আলাপ? মানে, কোন আলাপ করার পর আপনি বুঝতে পারবেন এটা রাজনৈতিক আলাপ এবং এই আলাপ আপনার দোকানে চলবে না?’ খলিল ভাইয়ের দোকানে দীর্ঘদিন নিয়মিত বসার সুবাদে অর্জিত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে আন্দাজ করি, তিনি বলবেন, ‘আওয়ামী লীগ-বিএনপির ঝগড়া ফ্যাসাদের আলাপ, সরকারি-বিরোধীদের কামড়াকামড়ির আলাপ—এই সবই আসলে রাজনৈতিক আলাপ।’

যদি মোটাদাগের এই সংজ্ঞা মেনে নেওয়া হয় এবং আওয়ামী লীগ-বিএনপির আলাপকেই ‘রাজনীতির আলাপ’ বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলেও দেখা যাবে চায়ের দোকানে এই আলাপ না করে থাকা কঠিন। কারণ, মানুষের আলাপ এক জায়গায় আটকে রাখার জিনিস নয়। এই যে ধরুন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মতো এত বড় একটা ঘটনা ঘটল, চা-খোরদের আড্ডায় সেই আলাপ তো আসবেই। সেই আলাপে অনিবার্যভাবে সেতুটি কে বানাল, কী করে বানাল, কোত্থেকে এত টাকা এল, বছরে কত টাকা টোল উঠবে, সেই টোল সরকারের কোষাগারে ঠিকমতো যাবে কি না—এই সব কথা উঠবে। এর সূত্র ধরে পদ্মা সেতুর ‘উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ’ নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। তখন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, বিশ্বব্যাংক, সরকার, সাফল্য, দুর্নীতি, মেগা প্রজেক্ট—এসব প্রসঙ্গ অবধারিতভাবে চলে আসবে।

আমাদের মধ্যে নিরন্তর চলছে থিসিস আর অ্যান্টি-থিসিসের লড়াই। আমরা হয় সাদা, না হয় কালো। হয় এদিকে, না হয় ওদিকে। হয় সরকারে, না হয় বিরোধীতে। হয় স্বাধীনতার পক্ষের, নয় বিপক্ষের। হয় ইলিশ, না হয় চিংড়ি। হয় ভাতে, না হয় রুটিতে। আমরা ধরেই নিয়েছি, ভাত আর রুটিতে ঝগড়া লাগতেই হবে। ‘ভাত বনাম রুটি’ থেকে আমরা ‘ভাত এবং রুটি’তে পৌঁছাতে পারি না। ‘বনাম’ এর পথ ছেড়ে আলোচনার পথে যে আসা যায়, সে ধারণা কে বা কারা আমাদের মন থেকে সরিয়ে দিয়েছে।
খলিল মিয়ার চায়ের দোকানে লেখা ‘রাজনৈতিক আলাপ নিষেধ।’

মিনিট কয়েক এই আলাপ চললেই দেখা যাবে আলাপ পদ্মা সেতু থেকে হার্ড পলিটিকসে মোড় নিয়েছে। ফলে খলিল ভাইয়ের দোকানে যদি রাজনৈতিক আলাপ বন্ধ করতে হয়, তাহলে কোনোভাবেই সেখানে পদ্মা সেতু, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, রিজার্ভ চুরি, সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি, কোরবানির হাটের ইজারা—ইত্যাকার বিষয়ে আলাপ চলতে দেওয়া যাবে না। কারণ, এসব বিষয়ের সঙ্গে রাজনীতির বিষয় জড়িত। আর রাজনীতি মানেই বিভাজন। এসব নিয়ে দশজনের মধ্যে আলাপ উঠলে কোনো না কোনো পয়েন্ট ধরে সেই দশজন দুটি পক্ষে ভাগ হয়ে যাবেন। তাঁরা তর্কাতর্কিতে জড়াবেন। সেই তর্ক আরও কিছুতেও গড়াতে পারে।

আমাদের মধ্যে নিরন্তর চলছে থিসিস আর অ্যান্টি-থিসিসের লড়াই। আমরা হয় সাদা, না হয় কালো। হয় এদিকে, না হয় ওদিকে। হয় সরকারে, না হয় বিরোধীতে। হয় স্বাধীনতার পক্ষের, নয় বিপক্ষের। হয় ইলিশ, না হয় চিংড়ি। হয় ভাতে, না হয় রুটিতে। আমরা ধরেই নিয়েছি, ভাত আর রুটিতে ঝগড়া লাগতেই হবে। ‘ভাত বনাম রুটি’ থেকে আমরা ‘ভাত এবং রুটি’তে পৌঁছাতে পারি না। ‘বনাম’ এর পথ ছেড়ে আলোচনার পথে যে আসা যায়, সে ধারণা কে বা কারা আমাদের মন থেকে সরিয়ে দিয়েছে। ইতি আর নেতির দ্বন্দ্বকে চিরায়ত সত্য বলে মেনে নিয়েই যে ‘বনাম’–এর বিভাজন ভুলে সংহতিতে পৌঁছানো যায়; এবং এর মধ্যেই যে ক্ষুদ্র থেকে বিশালত্বের জয়যাত্রা নিহিত, সে বোধ আমাদের নেই।

বুশও ‘বনাম’–এর দর্শনের ওপর ভর করে সাদ্দামকে আক্রমণ করেছিলেন। শীতল যুদ্ধ থেকে আজকের বহুমাত্রিক পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ে এই বনামের দর্শন ছিল। রাজনীতির আলাপ উঠলেই যেহেতু তা মানুষকে ‘বনাম’ তথা বিভাজনের অশান্তিতে ভাসিয়ে নেয়, সেহেতু নিত্যকার জীবনে রাজনীতি এক নিষিদ্ধ অধ্যায় হিসেবে আমাদের সামনে ধরা দিচ্ছে। সেই কারণে ‘শুধুমাত্র রাজার জন্য সংরক্ষিত নীতি’ মনে করে যাপিত জীবনের রাজনীতিঘনিষ্ঠ সব আলাপকে আমরা টক শো, পার্টি অফিস, রাজপথ, জনসভা, সংবাদ সম্মেলন, বক্তৃতা-বিবৃতি নামক শিকেয় তুলে রেখেছি। অথচ প্রজার প্রাত্যহিক জীবনের দৈনন্দিন আলাপে সবচেয়ে জরুরি অনুষঙ্গ হওয়ার কথা ছিল এই রাজার নীতি তথা রাজনীতি।

আতঙ্কের কথা, দিন দিন অন্য সব জনপরিসরও ‘খলিল মিয়ার চায়ের দোকান’ হয়ে যাচ্ছে। পাবলিক বাসে যাত্রীদের আগের মতো নিঃশঙ্কভাবে সরকারি দল, বিরোধী দল, নির্বাচন, ভোট, ইসি, দুদক নিয়ে আলাপ করতে দেখা যায় না। আলোচনায় সরকারের সমালোচনা থাকলে তাতে পাশের যাত্রী উত্তেজিত হবেন কি না; তিনি মোবাইলে সরকারের সমালোচনা করা বক্তব্যটি ভিডিও করে ফেসবুকে ছেড়ে দেবেন কি না, তার গ্যারান্টি কেউ দিতে পারছে না। নাগরিকের রাজনৈতিক মন্তব্য ও সমালোচনাকে সরকার যখন অলিখিত ও অঘোষিতভাবে ‘নিষিদ্ধ’ করে, তখন চায়ের দোকানে সাঁটানো নোটিশকেও লোকে ‘সরকারি আদেশ’ বলে গণ্য করতে থাকে। যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কারও কোনো সরকারবিরোধী মন্তব্যে ‘লাইক’ দেওয়ার কারণেও যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা খাওয়ার নজির দেখা যায়, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অবারিত পরিসরও নিয়ন্ত্রিত পরিসরের ‘খলিল মিয়ার চায়ের দোকান’ হয়ে ওঠে।

­­অথচ শিষ্টতার পাঠ বলছে, গণতন্ত্রের একটি স্তম্ভ যদি অপর স্তম্ভ সম্বন্ধে ন্যূনতম সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তা গণতন্ত্রেরই অপমান।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

    sarfuddin2003@gmail.com