রাজনীতি নাই, রাজনৈতিক সংঘাত আছে

মেলা দিন দেশে পাল্টাপাল্টি মিছিল-সমাবেশ নাই। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া নাই। সরকারি ও বিরোধীদের চিরায়ত কামড়াকামড়ি নাই। টক শোতে দুই পক্ষের নেতাদের দিগ্‌বিদিক অঙ্গসঞ্চালনজাত মৃদু হাতাহাতি কিংবা চক্ষু উৎপাটনের হুমকিসংবলিত তির্যক বাণী বিনিময় নাই। দুই পক্ষের ‘একান্ত নিরপেক্ষ’ (‘অনুগত’ বললে পাছে তাঁরা কষ্ট পান) কথাযোদ্ধারাও টেলিভিশনে এখন কদাচিৎ এ ওর দিকে ফিরে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ‘ডিবেট’ করেন।

পার্লামেন্টে অধিবেশন বসে, কিন্তু জমে না। ‘দুধভাত’ মার্কা বিরোধী দলের নেতারা খালি ‘পঠিত বলিয়া গণ্য হইল’ ধরনের ‘তারকা চিহ্নিত জরুরি জনগুরুত্বসম্পন্ন’ আলোচনা করেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে রাজপথ, রাজপথ থেকে চিকা মারা দেয়াল—কোথাও বিরোধী নেতা-কর্মী বা তাঁদের বিপ্লবী স্লোগানের উপস্থিতি নাই। তাঁদের খোঁজে বাটি চালান দিলে নিশ্চিতভাবেই জায়গার বাটি জায়গায় চলে আসবে; ফি ‘ঈদের পরই তুমুল বিক্ষোভ’ করা নেতা-কর্মীদের পাওয়া যাবে না।

সব মিলিয়ে মধ্যবিত্ত এনজিওপুষ্ট নিরীহ বাঙালির পানসে জীবনে যা-ও একটু রাজনৈতিক বিনোদন অবশিষ্ট ছিল, তা-ও মাঠে মারা গেছে।

আমরা যারা সরলসোজা জনগণ, তারা পলিটিক্যাল অ্যাকটিভিটিস বলতে কী বুঝি? আমরা বুঝি, আমাদের মতো গণতান্ত্রিক দেশে সরকারি দল বলবে, ‘সি এ টি ক্যাট—ক্যাট মানে গরু!’ , বিরোধী দল ফাল দিয়ে এসে বলবে, ‘মানি না, সি এ টি কাউ,—কাউ মানে বিড়াল!’ এরপর দুই পক্ষ গরু ও বিড়ালের যথার্থ মর্মার্থ দেশবাসীকে শেখানোর জন্য অক্সফোর্ড ডিকশনারি থেকে শুরু করে উইকিপিডিয়া হাজির করবে। পাবলিক তাদের সেই চুলোচুলি দেখে নির্মল আনন্দ পাবে। মহল্লার চায়ের দোকানে দুই কাপ চা বেশি বিক্রি হবে।

 কিন্তু এসবের কিছুই এখন দেখা যাচ্ছে না। তার মানে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বলতে স্বাভাবিকভাবে আমরা যে জিনিস বুঝি, আদতে সে জিনিস আর নাই। বিশেষ করে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর থেকে ‘পলিটিক্যাল অ্যাকটিভিটিস’-এর ভিটেয় ঘুঘু চরছে। সেই ভিটেয় সরকারপন্থী দলগুলোকে মাঝেমধ্যে পা ছড়িয়ে বসতে দেখা যায় বটে, কিন্তু বিরোধীদের ধারেকাছে পাওয়া যায় না।

এই অবস্থার মধ্যে একটি মর্মান্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, গত তিন মাসে দেশে দৃশ্যত রাজনীতি না থাকলেও রাজনৈতিক গন্ডগোল থেমে নেই। এই তিন মাসে রাজনৈতিক মারামারিতে মারা গেছেন ২৩ জন। হাত-পা ভেঙে কিংবা গুলি খেয়ে হাসপাতালে গেছেন ১ হাজার ২৪ জন। এই সব ‘অংশগ্রহণমূলক কাইজ্যা’ হয়েছে মূলত সরকারপন্থী দলের নেতা-কর্মীদের নিজেদের ভেতর।

নির্বাচনের পরের তিন মাসে কমপক্ষে ৯২টি রাজনৈতিক সংঘাত হয়েছে। আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যে ১৪টি সংঘাত হয়েছে। এতে ১৯০ জন আহত ও ৪ জন নিহত হয়েছেন। যুবলীগের নিজেদের মধ্যে সংঘাত হয়েছে চারটি। এতে ২৭ জন আহত ও ১ জন নিহত হয়েছেন। ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যেও চারটি সংঘাতে ১ জন নিহত ও ২২ জন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যুবলীগের সঙ্গে পুলিশের সংঘাতে ১ জন নিহত ও ১০ জন আহত হয়েছেন।

তার মানে, ‘আমরা বনাম ওরা’ অপস্রিয়মাণ এবং ‘আমরা বনাম আমরা’ দৃশ্যমান হচ্ছে। প্রতিপক্ষের অভাবে এখন ‘পক্ষ’ বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। পক্ষ এখন স্বরচিত প্রতিপক্ষের সঙ্গে ‘রাজনৈতিক’ হানাহানি শুরু করেছে।

যাঁরা মাথা ফাটাফাটি করেছেন, করছেন এবং ভবিষ্যতে না করে ছাড়বেন না, তাঁরা একই দলের আদর্শ মাথায় নিয়ে আছেন। আদর্শিক জায়গা থেকে চিন্তার মিল না থাকলে তাঁরা এক পতাকার নিচে আসতে পারতেন না। তাঁরা একই দল করেন। এক আদর্শে বিশ্বাস করেন। সবাই মিলে তাঁরা দেশকে উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাওয়ার শপথ নিচ্ছেন।

তারপরও নিজেদের মধ্যে এই ধাক্কাধাক্কি কেন? এই ধাওয়াধাওয়ি কী নিয়ে?

আমার মতো কম বুঝদার লোক চোখ বন্ধ করে বলে ফেলবেন, ঘটনা সোজা। আদর্শ-টাদর্শ কিছু না। ঠিকাদারি, লিজ নেওয়া, ইজারা পাওয়া—এসব নিয়ে তাঁরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করছেন। নিজের ভাগে কম পড়লে মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। আইস ব্যাগ চেপে ধরেও মাথার গরম কমানো যাচ্ছে না। সতীর্থ বা সহযোদ্ধার মাথা না ফাটানো পর্যন্ত সেই গরম মাথা ঠান্ডা হচ্ছে না।

বিরোধী দলের কেউ যেহেতু মাঠে নাই, সেহেতু তাঁরা নিজেরাই লাঠালাঠিতে নেমে গেছেন। রাতারাতি এই দাবড়াদাবড়ির অবসান হবে, তা আশা করা আর মাঘ মাসের রাতে খালি গায়ে খেতের আইলে শুয়ে থাকা একই কথা।

আমাদের কলহপ্রিয় রাজনীতিতে এত দিন ‘পক্ষ’-এর সামনে মাথা ফাটানোর মতো একটা জুতসই ‘প্রতিপক্ষ’ থাকার চল ছিল। সেই প্রতিপক্ষ ‘যা, আর খেলব না’ বলে মাঠ ছেড়ে পালিয়েছে। এ অবস্থায় বেচারা ‘পক্ষ’ করবেটা কী? নিজেদের মধ্য থেকে ‘প্রতিপক্ষ’ রচনা করা এবং সেই স্বরচিত প্রতিপক্ষের সঙ্গে কুস্তাকুস্তির জন্য হাত মকশো করা ছাড়া তার সামনে আর কি কোনো উপায় আছে?

নিজেরা নিজেরা মারামারি করায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের ভাবমূর্তি যে ছোট হচ্ছে, তা নিয়ে এই যুদ্ধংদেহী নেতা-কর্মীদের মাথায় ব্যথা-বেদনা আছে বলে মনে হচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে, এই অতি উদ্দীপ্ত, (কু) কর্মচঞ্চল নেতা-কর্মীদের লাগাম এখনই না ধরতে পারলে তাঁরা ভারি ঝামেলা বাধাবেন। এসব দেখে প্রতি ‘ঈদের পর তুমুল বিক্ষোভে’ নামা প্রতিপক্ষ আন্ডারগ্রাউন্ডে বসে মুচকি মুচকি হাসছে।

সবাই খালি ‘খাব! খাব!’ করলে ঘটনাপ্রবাহ হাতাহাতি দিয়ে শুরু হয়ে খুনোখুনি দিয়ে শেষ হবে। এই অবস্থা থেকে বের হতে গেলে ভিন্ন দলের লোকজনের কথা না হয় বাদই দিলাম, অন্তত নিজ দলের আদর্শিক ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা দরকার। কিন্তু কথা হলো, সেই শ্রদ্ধা তো আসমান থেকে পড়বে না, তাকে অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আত্মস্থ করতে হবে। আর এই ‘ফালতু জিনিস’ আত্মস্থ করে সময় নষ্ট করার মতো সময় কি কারও আছে?

সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহ–সম্পাদক
sarfuddin.ahmed@prothomalo.com