বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী নিজের ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে যে সহিংসতার শিকার হয়েছেন বলে সংবাদমাধ্যমে অভিযোগ করেছেন, তা খুবই দুঃখজনক। তাঁর ওপর হামলাকারীরা আইনের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ করেছেন, তাঁদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো অত্যাবশ্যক। কিন্তু শুধু এই কারণে এটাকে দুঃখজনক ঘটনা বলা হচ্ছে, তা নয়। এই অপরাধমূলক ঘটনার তাৎপর্য শুধু বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রশাসনিক ও দেশের ফৌজদারি কার্যবিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর তাৎপর্য আরও বড় ও গভীর। প্রকৃতপক্ষে, ওই ছাত্রী রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কবলে পড়েছেন এবং সেই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা শুধু তাঁর ওপর হামলাকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক তথা প্রশাসনের মধ্যেও বিস্তৃত। আমাদের দুঃখটা এখানেই।
যাঁরা প্রথম আলো নিয়মিত পড়েন, তাঁদের অনেকেই হয়তো ওই ছাত্রীর ওপর হামলার খবরটি পড়ে থাকবেন। খবরটি যাঁদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে, তাঁদের জন্য ঘটনাটির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এ রকম। আক্রমণের শিকার ছাত্রীটি নিজেই এই বিবরণ দিয়েছেন এবং ৮ মার্চ প্রথম আলোর মুদ্রিত সংস্করণে তা ছাপা হয়েছে। সেদিন ছিল ১ মার্চ। ছাত্রীটির পরীক্ষা ছিল। তিনি পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে কলাপসিবল গেটের কাছে যেতেই কয়েকজন মুখোশপরা তরুণের মধ্য থেকে কেউ একজন তাঁর মাথায় বাড়ি মারে; কেউ তাঁর চোখের কোণে ঘুষি মারে। ছাত্রীটি চিৎকার করে উঠলে তাঁর মুখে কাপড় গুঁজে দেয়। ছাত্রীর হাত থেকে জ্যামিতি বাক্স পড়ে গিয়েছিল। তরুণদের একজন সেখান থেকে কাঁটাকম্পাস তুলে নিয়ে সেটা দিয়ে তাঁর শরীরে খোঁচাতে থাকে। তাঁকে ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে বাড়ি দিতে থাকে। শরীরের বিভিন্ন অংশে নির্যাতন চালায়।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেদিন যে মুখোশধারী ব্যক্তিরা ওই ছাত্রীর ওপর এভাবে নির্যাতন চালিয়েছেন, তাঁরা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর ছাত্রীটি বিএনপি-সমর্থিত ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের একজন সক্রিয় ও উদীয়মান সদস্য। দুই বছর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ওই ছাত্রী আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠনে তৎপর ছিলেন, তা নিয়ে ফেসবুকে লেখালেখি করেছেন। এসব করতে গিয়ে তিনি শারীরিকভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন, এমনকি প্রাণনাশের হুমকিও পেয়েছিলেন। এসব অভিযোগে তাঁর বাবা থানায় জিডি করেছিলেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ওই ছাত্রীর ভাবমূর্তি ইতিবাচক এবং তিনি তাঁদের স্বার্থে বিভিন্ন দাবিদাওয়া পেশ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের নামাজ পড়ার জায়গার দাবি জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট লেখার পর তিনি ‘শিবিরকর্মী’র তকমা পান। অবশ্য তারও আগে, থানায় জিডি করার পর তাঁর বিভাগের সেই সময়ের চেয়ারম্যান তাঁকে ডেকে জিডি প্রত্যাহার করার জন্য চাপ দিতে গিয়ে তাঁকে সাদা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এখানে লেখো, তোমার শিবির-সম্পৃক্ততা আছে।’
ছাত্রীটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, তাঁর পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি নিজে বিএনপি-সমর্থিত ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কর্মী, এই কথাও বলেছেন। প্রশ্ন হলো বিএনপি কিংবা ছাত্রদল কি আইনগতভাবে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠন? না। তারা বৈধ সংগঠন হিসেবেই তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অবশ্য সেটা তাদের ঠিকমতো করতে দেওয়া হচ্ছে না, এ রকম অভিযোগ তারা নিজেরা যেমন করছে, তেমনি দেশের জনগণও দেখতে পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আরও যে প্রশ্ন উঠে আসে তা হলো বিএনপি বা ছাত্রদল যদি আইনগতভাবে নিষিদ্ধও হতো, তাহলেও কি তাদের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো শিক্ষার্থীর ওপর এমন নির্যাতন চালানোর অধিকার কারও আছে? সে ক্ষেত্রে যা করার, তা করতে পারে শুধু আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, অন্য কেউই নয়।
আর রাজনীতির প্রসঙ্গ তুললে এই প্রশ্নও তুলতে হয়: জনগণের করের অর্থে পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনের দায়িত্ব কি তাদের ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক স্বার্থে বিরোধীপক্ষের সঙ্গে জবরদস্তিমূলক ও সহিংস আচরণকে সমর্থন জোগানো কিংবা প্রশ্রয় দেওয়া? বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগের চেয়ারম্যান বা কোনো শিক্ষক কি ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসীদের সহিংস অপরাধের শিকার কোনো শিক্ষার্থীকে থানা থেকে জিডি প্রত্যাহার করার জন্য চাপ দেওয়ার অধিকার রাখেন? না এটা কোনো শিক্ষকসুলভ আচরণ? ‘শিবির-সম্পৃক্ততা’র গৎবাঁধা অজুহাতকে শিক্ষার্থীদের ‘উইচ হান্টিং’-এর হাতিয়ারে পরিণত করার মন্দ চর্চায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও খোদ প্রশাসনের অংশগ্রহণ বা ইন্ধন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটা শুধু বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়েই সীমাবদ্ধ নেই, দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ই এই অশুভ চর্চার ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
এভাবে জনগণের অর্থে পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সংকীর্ণ দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের অঙ্গনে পরিণত করার সর্বনাশা পথ থেকে অবিলম্বে সরে আসা উচিত। কারণ, এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে; জাতির বিরাট ক্ষতি হচ্ছে।
মশিউল আলম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক।