১৯৬০ দশকজুড়ে বিশ্বের অনেক জায়গায় নাগরিক আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থান দেখা গেছে। সমাজে, রাজনীতিতে, সাহিত্যে, দর্শনে, সংগীতে, চিত্রকলায় ও মানুষের মনোজগতে বাঁক পরিবর্তন হয়েছে। ওই সময় চীনের একটি বড় ঘটনা হলো ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯—এই তিন বছর চীন ছিল উথালপাতাল। চীন নিয়ে পশ্চিমা দুনিয়ায় অনেকেই আগ্রহী হয়ে ওঠেন। আমাদের মতো গরিব দেশগুলোতে চীনপন্থী রাজনীতি নিয়ে অনেক মাতামাতি থাকলেও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কোনো নেতার সঙ্গে এ দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর কোনো নেতার কখনো কোনো রকম দেখা-সাক্ষাৎ বা কথাবার্তা হয়নি। তারপরও অনেকেই আবেগের কাছে সমর্পিত হয়েছিলেন।
ওই সময় পশ্চিমের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে কমিউনিজম নিয়ে, বিশেষ করে চীনের ঘটনাপ্রবাহ ও ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ নিয়ে বেশ কিছু একাডেমিক কাজ হয়েছিল। বিদ্বৎ সমাজের তিন দিকপাল—পল সুয়িজি, জর্জ টমসন আর জোয়ান রবিনসন গঠন করলেন ‘চায়না পলিসি স্টাডি গ্রুপ’। তাঁরা ব্রডশিট নামে এক পাতার একটা মাসিক পত্রিকা বের করতেন। ওটা আমাদের দেশেও পাওয়া যেত। ওই পত্রিকায় কমিউনিজম, বামপন্থা কিংবা চীন সম্পর্কে অনেক গভীর আলোচনা থাকত, যা ছিল আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর বাগাড়ম্বরে ঠাসা রাজনৈতিক সাহিত্যের একেবারেই বিপরীত।
১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ে নতুন একটা বিষয় চালু করা হয়েছিল—থিয়োরি অ্যান্ড প্র্যাকটিস অব সোশ্যালিজম। পড়াতেন অধ্যাপক মো. আনিসুর রহমান। তাঁর কোর্সে ছাত্র ছিলেন সাকল্যে সাতজন। আমি ছিলাম তাঁদের একজন। কমিউনিজম ও মার্ক্স-অ্যাঙ্গেলস-লেনিন-মাওয়ের দর্শন ও রাজনীতি নিয়ে পদ্ধতিগতভাবে পড়াশোনা, অনুসন্ধান ও আলোচনার একটা অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তখন।
১৯৭৫ সালে অভ্যুত্থান ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর অধ্যাপক আনিসুর রহমান দেশত্যাগ করেন। কোর্সটিও বন্ধ হয়ে যায়।
ওই সময় একটি বই বেশ আগ্রহ তৈরি করেছিল। এটা ছিল জোয়ান রবিনসনের লেখা অ্যান এসে অন মার্ক্সিয়ান ইকোনমিকস। তিনি মার্ক্সীয় সাহিত্যে কিছু স্ববিরোধিতা লক্ষ করেছিলেন। বইটিতে ওই প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা ছিল। এর সূত্র ধরে আমি একদিন কয়েকজন সতীর্থের সঙ্গে কথা বললাম, যাঁরা ওই পেপারটি নেননি। তাঁরা তখন মার্ক্সবাদ বলতে অজ্ঞান, বিপ্লবের জন্য জান কোরবান করতে প্রস্তুত। তো, আমাকে শুনতে হলো, ‘ব্যাটা কত বড় বেয়াদব, মার্ক্সের ভুল ধরে?’
আমাদের দেশে কমিউনিজমের গুরু বা গুরুবর্গের সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে খোলামেলা একাডেমিক আলোচন ছিল না। এখনো নেই। বুর্জোয়া, প্রলেতারিয়েত, শ্রেণিসংগ্রাম, সাম্যবাদ, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ—এ রকম ১০-২০টি শব্দ তুলে এনে আমরা বছরের পর বছর পার করে দিয়েছি। আমরা কী বলি, সাধারণ মানুষ তা বোঝে না। এমনকি আমরাও যে বুঝি, বুকে হাত দিয়ে তা বলতে পারব কি?
রেনেসাঁ-পরবর্তী যুগে তিন ব্যক্তি দুনিয়াটা ভীষণ জোরে ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন, পাল্টে দিয়েছিলেন কোটি কোটি মানুষের মনোজগৎ। তাঁরা হলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি (১৫৬৪-১৬৪২), চার্লস ডারউইন (১৮০৯-৮২) ও কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-৮৩)। মার্ক্সের ‘শোষণতত্ত্ব’ এবং এর ভিত্তিতে তাঁর আজন্মের সাথি ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলসকে সঙ্গে নিয়ে লেখা কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার (ম্যানিফেস্টো অব দ্য কমিউনিস্ট পার্টি, ১৮৪৮) দুনিয়াজুড়ে রাজনীতির ব্যাকরণ পাল্টে দিয়েছিল। তবে মার্ক্সের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দর্শনের একটা স্পষ্ট ও চূড়ান্ত রূপ আমরা পাই তাঁর পুঁজি গ্রন্থে।
আজ ৫ মে, কার্ল মার্ক্সের জন্মদ্বিশতবার্ষিকী। এই ২০০ বছরে পৃথিবী অনেক পাল্টে গেছে। মার্ক্সের পৃথিবী এখন আর নেই। তারপরও তিনি এখনো প্রাসঙ্গিক। এ দেশে যাঁরা বাম রাজনীতি করেন, তাঁদের একটা বড় অংশই মার্ক্সীয় সাহিত্য পড়েননি। পড়লে রাজনীতির চালচিত্র অন্য রকম হতো। মস্কো-পিকিংয়ে ছাপা হওয়া অনেক চটি বই খুব সস্তায় বা নিখরচায় এ দেশে পাওয়া যেত। এগুলো পড়ে কিংবা মুখস্থ করে আমাদের অনেকেরই বদহজম হয়েছে। আমরা অনেকেই তাঁর লেখা ধর্মগ্রন্থের শ্লোকের মতো আওড়াই এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে পান থেকে চুন খসলেই পার্টি ভাগ করে ফেলি। আমরা কজন মার্ক্সের নাগাল পেয়েছি?
মার্ক্স স্কুলের শেষ পরীক্ষায় একটি রচনা লিখেছিলেন। এটা ১৮৩৫ সালের আগস্ট মাসের কথা। রচনার শিরোনাম ছিল ‘রিফ্লেকশনস অব আ ইয়াং ম্যান অন দ্য চয়েস অব আ প্রফেশন’। অর্থাৎ একজন তরুণ পেশা নির্বাচন করবে কীভাবে। তিনি লিখলেন, ‘জীবের যাবতীয় কর্মকাণ্ড প্রকৃতি দ্বারা নির্ধারিত, একটি পশু এই গণ্ডির ভেতরে থেকেই নড়াচড়া করে। বেরোনোর চেষ্টা করে না। মানুষও তেমনি ঈশ্বরের দেওয়া একটা লক্ষ্য সামনে রেখে নিজেকে পরিচালনা করে। মানুষ কীভাবে এই লক্ষ্যে পৌঁছাবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং কার্যক্রম চালানোর এখতিয়ার মানুষেরই। এ ক্ষমতা ঈশ্বর মানুষের হাতেই তুলে দিয়েছেন। সমাজে কোন স্থানটি তার জন্য যথাযথ, কীভাবে সে নিজেকে এবং গোটা সমাজকে উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবে, তা ঠিক করার দায়িত্ব ঈশ্বর মানুষকেই দিয়েছেন। পথ বেছে নেওয়ার ক্ষমতা মানুষকে জীবজগতের অন্যান্য প্রজাতি থেকে আলাদা করেছে। এটা এমন একটা সুবিধা বা ক্ষমতা, যা কিনা মানুষের জীবন ধ্বংস করে দিতে পারে, তার সব পরিকল্পনা নষ্ট করে দিতে পারে, নির্বাসিত করে দিতে পারে তার সব সুখ। এই পথ ও পদ্ধতি নির্বাচন করার ক্ষমতা মানুষ তার পেশাগত জীবনের শুরুতেই দৈবের ওপর ছেড়ে দিতে পারে না।...শুধু নিজের জন্য যে বাঁচে, সে হয়তো ব্যক্তিগত খ্যাতি অর্জন করতে পারে। একজন পণ্ডিত হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। হতে পারে একজন চমৎকার কবি। কিন্তু কখনোই সে একজন মহৎ মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। সাধারণের কল্যাণের জন্য যিনি নিবেদিতপ্রাণ, তিনিই মহাত্মা। তিনিই সবচেয়ে সুখী, যিনি সবচেয়ে বেশি মানুষকে সুখী করতে পেরেছেন। ধর্ম আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে মানবজাতির জন্য যার ত্যাগ বেশি, তিনিই আদর্শ, অনুসরণযোগ্য।’
মার্ক্স প্রচুর পড়াশোনা করতেন। তিনি প্রায় সব কটি ইউরোপীয় ভাষা পড়তে পারতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি কবিতা মুখস্থ আউরে যেতে পারতেন। ইস্কাইলাস, শেক্সপিয়ার, গ্যেটে, পুশকিন, হাইনে, দান্তে এবং রবার্ট বার্নসের কবিতা ছিল তাঁর প্রিয়। ছাত্রজীবনে তিনি নিজেও অনেক কবিতা লিখেছেন।
অশিক্ষা, রুচিহীনতা আর মূর্খতা মার্ক্স খুব অপছন্দ করতেন। সুযোগ পেলেই তিনি পাণ্ডিত্য জাহিরকারী আর বাগাড়ম্বরকারীদের উদোম করে ছেড়ে দিতেন। সস্তা জনপ্রিয়তা এবং হাততালি-শিকারিদের প্রতি ছিল তাঁর তীব্র ঘৃণা। সব ছাপিয়ে তাঁর মধ্যে তৈরি হয়েছিল পরিশীলিত মন। চিরায়ত সাহিত্য ঘেঁটে শব্দচয়ন করতেন এবং উদ্ধৃতি দিতেন তাঁর লেখায়। অনেকেই তাঁকে খণ্ডিতভাবে ব্যাখ্যা করে বলে থাকেন, অর্থনীতিই নাকি সবকিছুর নিয়ন্ত্রক, এর ওপর তৈরি হয় উপরিকাঠামো। অথচ পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে কী কাব্যিক ব্যঞ্জনায় তিনি লিখেছেন: শ্রেষ্ঠ মৌমাছির চেয়ে নিকৃষ্টতম স্থপতিও শ্রেয়, কারণ স্থপতি কাঠামো তৈরি করার আগে তার মনোজগতে তা নির্মাণ করে।
কার্ল মার্ক্সের মধ্যে পাণ্ডিত্য ও দ্রোহের যে অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছিল, তার তুলনা তিনি নিজেই। ‘অনুভব’ কবিতায় তিনি লিখেছেন:
লুকানো অমৃতভাণ্ড জ্ঞানের আধার
সুকুমার শিল্পকলা আনন্দসংগীত
নিসর্গের আশীর্বাদ যত আছে সব
ছেঁকে নেব ঈশ্বরের কৃপণ সঞ্চয়।
এ জগৎ কাঙ্ক্ষিত নয়, নয় কিছু
ইচ্ছার অধীন। জেনে রাখো একদিন
ধ্বংসযজ্ঞের আমি হব নটবর,
প্রচণ্ড ঘূর্ণিতে তুলে দারুণ প্রলয়...
এই পঙ্ক্তিগুলোর মধ্যেই মার্ক্সকে অনেকটা বোঝা যায়। দুনিয়া বদলের তাত্ত্বিক ধারণা ও প্রায়োগিক কৌশল আমরা যাঁদের কাছ থেকে পেয়েছি, তিনি তাঁদের অন্যতম একজন পথিকৃৎ। জন্মদিনে তাঁর জন্য আমার সশ্রদ্ধ সালাম।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
mohi2005@gmail.com