রাষ্ট্র ও রাজনীতি

রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি

.

বাংলাদেশে উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারেনি রাজনীতি। অগ্রগতির সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনীতি। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট পরিচালিত ‘বাংলাদেশের শাসন পরিস্থিতি ২০১৩: গণতন্ত্র ও দল রাজনীতি’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশনা অনুষ্ঠান সেদিন হলো। বিষয়টি নিয়ে সুধীমহলে অনেক কথা হচ্ছে। যঁারা দেশ নিয়ে ভাবেন, সমাজ নিয়ে চিন্তা করেন, তাঁরা উদ্বিগ্ন।
দীর্ঘদিন ধরে অনেককেই বলতে শুনছি, বাংলাদেশে এ কী হচ্ছে? রাজনীতিকেরা এ কী করছেন? আমরা কোথায় চলেছি?
জাতীয় জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে দুর্বৃত্তায়ন চলছে। যে যত বড় মাপের দুর্বৃত্ত, সে তত বড় ক্ষমতাবান। সমাজে সে তত উঁচু আসনে অধিষ্ঠিত, তত বেশি সালামপ্রাপ্ত। তারা স্তাবক, পারিষদ, অস্ত্রধারী, বন্দুকধারী, লাঠিয়াল বাহিনী দ্বারা পরিবৃত্ত। তারা সমাজে ত্রাস সৃষ্টি করে, মানুষকে ভয় দেখায়, অঙ্গচ্ছেদ করে, রগ কাটে, কবজি বিচ্ছিন্ন করে দেয়, মানুষকে গলা কেটে জবাই করে, হত্যা করে, গুম করে। কিন্তু মানুষ শা‌িন্ত খঁুজছে, একটি নিভৃত কোনো নিরাপদ স্থান, একটু স্বস্তি, হাঁফ ছেড়ে বাঁচার জায়গা।
দুর্বৃত্তরা আজ বাংলাদেশের নদী, নদীতে পড়া চর, নদীর বালুতট, তার তলদেশ, পাহাড়, বন, শ্মশানঘাট, কবরস্থান—সর্বস্ব খেয়ে চলেছে। এরাই আদিবাসীদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করে ভিটেছাড়া করে। বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানদের উপাসনালয়ে দেব-দেবীর প্রতিমা, যিশু-মেরির মূর্তি তারা ভেঙে চূর্ণ করে। আমি রামু, কক্সবাজার, নীলায় তাদের বীভৎস ত্রাস দেখেছি। বৌদ্ধমন্দির তছনছ করতে দেখেছি। গেরুয়া বসন পরা বৌদ্ধভিক্ষুদের লাঞ্ছিত হতে দেখেছি। অগ্নিদগ্ধ হয়ে লাশ হতে দেখেছি। আমি সাতক্ষীরা, দিনাজপুর, যশোর, পাবনা, খুলনায় দুর্বৃত্তদের পৈশাচিক তাণ্ডবনৃত্য দেখেছি। দেখেছি অসহায় গরিব খেটেখাওয়া মানুষের ওপর ধর্মের নামে চড়াও হওয়া, আগুন জ্বালা, সবকিছু লুটপাট হওয়া।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ছিলেন পরম শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। এক রাজনৈতিক ও অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নান্দনিক নির্বাচন তিনি উপহার দিয়েছিলেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে তাঁর সঙ্গে কাজ করার। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাঁকে সাহায্য করার। জীবনের শেষ বছরগুলোতে তিনি একজন দার্শনিক, চিন্তক ও অভিভাবক হিসেবে বাংলাদেশকে দিশা দিতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি জাতির বিবেককে বিভিন্ন সংকটে নাড়া দিয়েছিলেন। তিনি জাতির অবক্ষয় ও নীতিহীনতা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন মানুষের সুবৃত্তিগুলো কীভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে। সমাজে মূল্যবানরা কীভাবে মূল্যহীন হচ্ছে আর মূল্যহীনরা কীভাবে মহামূল্যবান হচ্ছে। বিচারপতি হাবিবুর রহমান তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলোতে জাতিকে নিয়ে বেশি আশাবাদী হতে পারেননি। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখায়, বক্তৃতায়, কথায় ও কবিতায় তা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্র আজ বাজিকরদের হাতে চলে গেছে।
সেদিন কাগজে দেখলাম, এক নব্য রাজপুত্র (প্রিন্স নামধারী) হিরের জুতো, সোনার জামা, কোটি টাকার ঘড়ি পরিহিত বিশাল এক মহিলা দেহরক্ষী বাহিনী নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আহূত হয়ে আসেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে তাঁর সাত বিলিয়ন ডলার (৫৬ হাজার কোটি টাকা) গচ্ছিত আছে। কোথায় এ অর্থের উৎস, কোথা থেকে আহরিত তাঁর আলি বাবার এ সম্পদ? বৈদেশিক ব্যাংকে এই হৃতদরিদ্র বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া বিশাল বিশাল অঙ্কের টাকা দিনে দিনে গচ্ছিত হয়েছে। দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে গেছে লাখÿ লাখ কোটি কোটি। বিত্তবানেরা সেকেন্ড হোম তৈরি করেছেন বিত্তবান ধনাঢ্য সব দেশে, কানাডা, মালয়েশিয়া, দুবাই, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, মরিশাস, সাইপ্রাসে। শেয়ারবাজারে, ডেসটিনি, হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপে, বেসিক ব্যাংকে দুর্নীতির একেকটি মহা উপাখ্যান রচিত হয়েছে। হয়েছে হরিলুট আর লুটের টাকা সব বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। ব্যাংকের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা গোটা জাতীয় আর্থিক ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়েছে। অথচ অর্থ মন্ত্রণালয়, তার ব্যাংকিং ডিভিশন এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নির্বাক, মূক ও বধির।
সম্প্রতি টিআইবির রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশ এ বছর দুর্নীতির সূচকে আরও নিম্নগামী হয়েছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, গত দশকে বাংলাদেশ পৌনঃপুনিকভাবে পাঁচবার পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল (২০০১–২০০৫)। এত দিনেও অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়নি।
মনে আছে, এই তো গত বছর (১৯ মে ২০১৩) অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় অর্থনৈতিক বিষয়ের ওপরে এক সেমিনারে বক্তব্য দিতে গিয়ে এভাবে বলেছিলেন, ‘আজ বাংলাদেশের গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র, গোটা প্রশাসন, পুলিশ, সিভিল প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমি, কর আদায়কারী সংস্থা, মন্ত্রণালয়, সংসদ সবাই দুর্নীতির মহাপঙ্কিলে আকণ্ঠ নিমজ্জিত।’
অর্থমন্ত্রীকে একজন সৎ-নীতিমান ব্যক্তি বলেই আমরা সবাই জানি। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ বক্তব্য গোটা দেশকে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন করে। দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র সবাইকে আতঙ্কিত করে। বিস্ময়করভাবে সরকার সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত ও উদাসীন। হয়তো সেই জন্যই দুর্নীতিবাজেরা বুক উঁচিয়ে দ্বিগুণ উদ্যমে দুর্নীতি করে যায়। কোনো প্রতিরোধ হয় না, জবাবদিহি করতে হয় না। পবিত্র জাতীয় সংসদেও কালোটাকাকে সাদা করার বৈধতা দেওয়া হয়।
মনে পড়ছে, ২০০৫ সালে একটি পার্লামেন্টারি ডেলিগেশনে কানাডা সফরে সুযোগ হয়েছিল কানাডার পার্লামেন্ট অধিবেশন দেখার। তখন লিবারেল পার্টির পল মার্টিন প্রধানমন্ত্রী। সংসদে সরকারের অর্থ কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কনজারভেটিভ পার্টির দলনেতা স্টিফেন হারপার অত্যন্ত জোরালো দীর্ঘ বক্তব্য আমি শুনেছিলাম। রাজধানী অটোয়ায় তখনই গুঞ্জন উঠেছিল সরকার টিকবে না। আমার ঢাকা প্রত্যাবর্তনের আগেই মার্টিন সরকারের পতন ঘটে। পরবর্তী নির্বাচনে স্টিফেন হারপার সরকার গঠন করেন ও প্রধানমন্ত্রী হন। এখনো তিনি কানাডার প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশের পরিপ্রে‌িক্ষতে দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি ও রাজনীতি সমার্থক শব্দ হয়ে পড়েছে। সাংসদ নির্বাচিত হয়ে মহান সংসদের প্রবেশদ্বার পেরোনোর পূর্বমুহূর্তে তিনি নাম স্বাক্ষর করে যে প্রতিবেদনটি নির্বাচন কমিশনে প্রেরণ করেন, তা তাঁর নির্বাচনী খরচের হিসাব। তিনি মিথ্যা হলফনামায় স্বাক্ষর করেন। শত শত কোটি টাকা নির্বাচনে ব্যয় করে তিনি ডাহা মিথ্যা প্রতিবেদন দেন। আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি দশম জাতীয় সংসদের সাংসদেরা একেকজন হয়েছেন তাঁর পূর্বঘোষিত নির্বাচনী হলফনামার শতগুণ এমনকি হাজার গুণের বর্ধিত অঙ্কের টাকার মালিক, সম্পদের মালিক, হাজার হাজার একর জমির মালিক। সাংসদেরা, মন্ত্রীরা, উপদেষ্টারা তো কোনো ব্যবসায় জড়িত থাকতে পারেন না। নামে-বেনামে কোনো ব্যবসা করতে পারেন না। তাহলে এ বিপুল সম্পদ কোথা থেকে এল?
৪৩ বছরেও স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি আসেনি। মানুষের শোষণ-বঞ্চনার শেষ হয়নি। গণতন্ত্র আসেনি। ক্ষুধা-দারিদ্র্যের বিস্তার থেমে থাকেনি। আশাহত মানুষ বারবার নতুন করে আশায় বাসা বাঁধে কিন্তু বারবার তার ক্ষুদ্র নীড় ভেঙে ভেঙে যায়। মনে হয়, আশা যেন মিছে শুধু ছলনা।
িগ্রক পুরাণের ট্রোজান যুদ্ধের অপ্রতিরোধ্য অজয় চির অক্ষত বীর একিলি। কিন্তু তিনিও পরাজিত হন, যুদ্ধে নিহত হন। বীর একিলির পায়ের গোড়ালি ছিল দেহের সবচেয়ে দুর্বল, সবচেয়ে ভঙ্গুর অংশ। অমরত্ব লাভের বাসনায় সদ্যপ্রসূত শিশু একিলির দুই পায়ের গোড়ালি ধরে পিতা স্বর্গলোকের অমৃত সাগরে ডুবিয়ে নেন। কিন্তু একিলির পায়ের গোড়ালিতে তঁার হাত থাকায় অমৃত সেখানে স্পর্শিত করেনি। আজ বাংলাদেশ নামক একিলির দুই পায়ের গোড়ালি, একটি হচ্ছে দুর্বৃত্তায়ন আরেকটি দুর্নীতি। ট্রয় নগর ধ্বংস হয়েছে। একিলিও বাঁচেনি। পায়ের গোড়ালিতে তিরবিদ্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়।
২০১৪ সাল বিদায় নিচ্ছে। ২০১৫ সাল সমাগত। নতুন বছরকে স্বাগত জানাই। এ দুর্ভাগা দেশ থেকে সব অপমানের গ্লানি অপসৃত হোক। সব মানুষ দল-মত-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে একত্রে মিলিত হোক। সব আত্মা, সব প্রাণ এক হোক।
দুর্ভাগা দেশ থেকে অপসারিত হোক দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তের দুই জগদ্দল পাথর।
লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান: সাবেক সেনাপ্রধান।