মতামত

রাজনীতিক-আমলা বিরোধের ভিন্ন পাঠ

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাংসদ ও সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এবং সংসদে সরকারনির্ধারিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টির নেতা ও সাবেক মন্ত্রী ফিরোজ রশীদ সম্প্রতি বর্তমান সরকারের ‘আমলানির্ভরতা’ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ২৮ জুন সংসদে তাঁদের দেওয়া বক্তব্যের ভাষ্য অনুযায়ী রাজনীতিবিদেরা এখন আর গুরুত্বপূর্ণ নেই, তার পরিবর্তে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে প্রশাসনের কর্মকর্তারাই প্রাধান্য বিস্তার করেছেন। তাঁদের বক্তব্যে যেহেতু সচিব এবং জেলা প্রশাসকদের কথা বলা হয়েছে, সেহেতু গণমাধ্যমে এ বিষয়ে আলোচনাটিকে দেখা হচ্ছে ‘আমলানির্ভরতা’র বিরুদ্ধে কথাবার্তা হিসেবে। এর আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় পার্টির প্রধান জি এম কাদের বলেছিলেন, ‘মাঠে খেলছেন আমলারা। রাজনীতিবিদেরা সাইডলাইনে বসে খেলা দেখছেন।’ এ প্রক্রিয়া বিরাজনীতিকরণের একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ এবং সে কারণে এ বিষয়ের দিকে অনেকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রশাসনের ‘সাহায্য’ নিয়ে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের দিকে এখন সবাই আঙুল তুলছেন, যদিও বিষয়টি তখনো সবার জানা ছিল। ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বরিশালে তাঁর দলের এক সভায় বলেছিলেন, ‘আমি ও প্রধানমন্ত্রীসহ যারা নির্বাচিত হয়েছি, আমাদের দেশের কোনো জনগণ ভোট দেয় নাই। কারণ ভোটাররা কেউ ভোটকেন্দ্রে আসতে পারে নাই।’ (যুগান্তর, ২০ অক্টোবর ২০১৯)। রাশেদ খান মেনন পরে সেই কথা ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে ঘটে যাওয়া বাস্তবতার বদল হয়নি। এর পরিণতি নিয়ে তখন ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদেরা কতটা ভেবেছিলেন?

জাতীয় সংসদে এ আলোচনাকে কেবল ‘আমলাদের’ সঙ্গে ‘রাজনীতিবিদদের’ দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখলে এর কারণ ও উৎস বোঝা যাবে না। করোনা মোকাবিলায় কিংবা জেলায় উন্নয়নকাজের জন্য সচিব নিয়োগের কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা-ও নয়। এমন টানাপোড়েন অনেক দিন ধরেই স্থানীয়ভাবে চলে আসছে। ২০১৮ সালে সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে সরকারি দলের নেতারা স্থানীয় পর্যায়ে প্রশাসনের ওপরে অনৈতিক চাপ প্রয়োগ করেন (আমাদের সময় ডটকম, ‘ক্ষমতার দাপটে স্থবির প্রশাসন’, ১৪ জানুয়ারি ২০১৮) ; ২০২০ সালে স্থানীয় ‘জনপ্রতিনিধি’দের সঙ্গে ‘কর্মকর্তাদের’ টানাপোড়েনকে সংবাদপত্রে ‘মাঠ প্রশাসনে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব’ বলে বর্ণনা করা হয়েছিল (ভোরের কাগজ, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০)। এ বছরের গোড়ায় একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘রাজনীতিতে বেড়েছে প্রশাসননির্ভরতা’ (খোলা কাগজ, ১ জানুয়ারি ২০২১)।

এ ধরনের দ্বন্দ্বের জন্য প্রশাসনের কর্মকর্তারা রাজনীতিবিদদের দোষারোপ করে থাকেন। একজন সাবেক সচিবকে উদ্ধৃত করে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘দেশে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন শুরু হয়েছে। এরা প্রশাসনকে চাপ দিয়ে কাজ করাতে চায়। এ ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা কথা না শুনলেই সমস্যা তৈরি করা হয়।’ আরেকজন সাবেক ডিসির ভাষ্য ছিল, ‘একজন সংসদ সদস্য চান জেলায় প্রধানমন্ত্রীর মতো ক্ষমতা। সংসদ সদস্যদের কথা না শুনলেই দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আর এর জেরে কাজেরও ব্যাঘাত ঘটে।’ (ভোরের কাগজ, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০)।

রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ধরন একটি রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ধারণ করে। যেমন প্রত্যক্ষ সেনাশাসনের সময় সেনাবাহিনী ক্ষমতাবলয়ের কেন্দ্রে থাকে। যখন সেনাশাসন বেসামরিক রূপ নিতে চায়, তখন রাজনৈতিক এলিটদের ক্ষমতাবলয়ের কেন্দ্রে বা বাইরের বলয়ে রাখে।

এ পরিস্থিতিকে আমলা-রাজনীতিবিদের দ্বন্দ্ব বলে বিবেচনা না করে বিবেচনা করা দরকার গত এক দশকে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থায় যে ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে, তার পরোক্ষ স্বীকৃতি হিসেবে। শাসনব্যবস্থার এ পরিবর্তনের দুটি পরস্পর সংশ্লিষ্ট দিক আছে। প্রথমত, নির্বাহী বিভাগের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ, দ্বিতীয়ত, সমাজ ও রাজনীতির বিভিন্ন শক্তির মধ্যে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের উদ্ভব। নির্বাহী বিভাগের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এখন প্রধানমন্ত্রীনির্ভর হয়ে পড়েছে। সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী যদিও সংসদের সদস্য এবং সেখানেই তিনি জবাবদিহি করতে বাধ্য, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাও। ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য অবশ্যই তাঁকে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে তাঁর সাংবিধানিক, রাজনৈতিক এবং নৈতিক ভিত্তি এবং তাঁর স্থায়িত্ব নির্ভর করার কথা আইনসভার ওপরে। বাংলাদেশের সংবিধানে এমন ব্যবস্থা রয়েছে যে এ ধরনের এককেন্দ্রীকরণ সম্ভব; তদুপরি সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ জবাবদিহির ব্যবস্থাকে প্রায় অনুপস্থিত করে ফেলেছে।

গত এক দশকে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কর্মরতদের দেওয়া বেতন-ভাতা বৃদ্ধির হার এবং পরিমাণ দেখলে ধারণা করা যায় যে সরকার দেশের প্রায় ১৩ লাখ সরকারি কর্মচারীকে সন্তুষ্ট করার বিষয়কে কতটা গুরুত্ব দেয়। ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বেড়েছে ২২১ ভাগ (ফখরুল ইসলাম, ‘১০ বছরে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা ৩ গুণ ছাড়িয়েছে’, প্রথম আলো, ২৫ জুন ২০২০)।

নির্বাহী বিভাগ কেবল বেসামরিক প্রশাসন নয়, আইনশৃঙ্খলা এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীও নির্বাহী বিভাগেরই অংশ। অনেক ক্ষেত্রে তাদের হাতে আইনিভাবেই বাড়তি ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে। গত কয়েক বছরে এসব খাতে ব্যয়ের হার দেখলেই বোঝা যায় এ প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তি এবং প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বছরের বাজেটে জননিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা খাতে বরাদ্দ বাজেটের ৬ দশমিক ৮ শতাংশ, প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। অথচ অতিমারির কারণে গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার পরও এ খাতে বরাদ্দ মাত্র ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। সরকার কোনটিকে প্রাধান্য দেয়, সেটা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। নির্বাহী বিভাগের অনেক কর্মকর্তার আচরণ বা তাঁরা যে ভাষায় কথা বলেন, তা ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের চেয়ে ভিন্ন বলে মনে হয় না। রাষ্ট্র, সরকার এবং দলের ভেতরে এখন আর কোনো ধরনের পার্থক্য টানা সম্ভব হচ্ছে না।

নির্বাহী বিভাগের এ ক্ষমতা সঞ্চয়ের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতার অভিযোগ থাকলেও দলের ভেতরে এ নিয়ে খুব অসন্তোষ আছে বলে মনে হয় না। এ ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে নির্বাহী বিভাগের ওপরে যে প্রতিষ্ঠানগুলো নজরদারি করার কথা, সেগুলোকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীদের আটক করতে অনুমোদন লাগবে—এমন আইন সংসদেই পাস হয়েছে। তা ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের সাংসদেরা অতীতে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে তাঁদের যেভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, বিচার বিভাগের বিষয়ে ষোড়শ সংশোধনী পাসে এবং সে বিষয়ে আদালতের রায়ের পরে সংসদে ও সংসদের বাইরে যেভাবে কঠোর ভাষায় কথা বলেছেন বা প্রধান বিচারপতিকে যেভাবে দেশত্যাগ করতে হয়েছে—তা কোনোভাবেই আইনসভাকে শক্তিশালী করেনি। বরং নির্বাহী বিভাগের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকেই জবাবদিহির ঊর্ধ্বে তুলে দিয়েছে।

রাজনৈতিক বন্দোবস্তে একটা বড় ধরনের পরিবর্তনের কারণেই ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এ রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হচ্ছে সমাজে বিরাজমান রাজনৈতিক এবং সামাজিক শক্তিগুলোর মধ্যে একধরনের অলিখিত চুক্তি। সেখানে কার কতটা ক্ষমতা থাকবে, কে কতটা ক্ষমতা প্রয়োগ করবে এবং এ ধরনের ব্যবস্থার ফলে যে সুযোগ-সুবিধা-আর্থিক লাভ তা কীভাবে বণ্টিত হবে, সে ব্যাপারে একটি সমঝোতা থাকে। এর লক্ষ্য সমাজে স্থিতিশীলতা রক্ষা, সহিংসতা এড়ানো এবং অর্থনীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করে আরও বেশি সম্পদ তৈরি করা, যাতে সবার ভাগেই তা বৃদ্ধি পায়। এ ধরনের ব্যবস্থায় ক্ষমতাবলয়ের কেন্দ্রে এক বা একাধিক শক্তি থাকতে পারে। পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকেন রাজনীতিবিদেরা, কিন্তু ঠিক বলয়ের বাইরে অথবা অংশীদার হিসেবে থাকে পুঁজিপতি শ্রেণি।

রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ধরন একটি রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ধারণ করে। যেমন প্রত্যক্ষ সেনাশাসনের সময় সেনাবাহিনী ক্ষমতাবলয়ের কেন্দ্রে থাকে। যখন সেনাশাসন বেসামরিক রূপ নিতে চায়, তখন রাজনৈতিক এলিটদের ক্ষমতাবলয়ের কেন্দ্রে বা বাইরের বলয়ে রাখে। বাংলাদেশে ১৯৯০ সালের পরে ক্ষমতাবলয়ের একেবারে কেন্দ্রে ছিলেন রাজনীতিবিদ এবং বিকাশমান পুঁজিপতিরা; বলয়ের বাইরে সহযোগী ছিল আমলাতন্ত্র এবং রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও সেনাবাহিনী। কিন্তু ২০০৯ সালের পরে এ বলয়ে বদল ঘটে এবং আমলাতন্ত্র বা সিভিল ব্যুরোক্রেসি বলয়ের কেন্দ্রে জায়গা করে নেয়। ২০১১ সালের পর থেকে সেখানে নির্বাহী বিভাগের সেসব প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, যারা যেকোনো মূল্যে ‘স্থিতিশীলতা’ বজায় রাখতে পারে এবং যাদের শক্তি প্রয়োগের আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করা দুরূহ। (বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন, আলী রীয়াজ, নিখোঁজ গণতন্ত্র, পৃষ্ঠা-১৫৫-১৭৮, প্রথমা)।

বাংলাদেশের নতুন ধনিক শ্রেণি ও ব্যবসায়ীরা এ ধরনের ব্যবস্থার সমর্থক, কেননা জবাবদিহিহীন ব্যবস্থার কারণে তাঁরা তাঁদের স্বার্থসিদ্ধি করতে পারছেন। কিন্তু জাতীয় সংসদের আলোচনায় জাতীয় পার্টির নেতা ফিরোজ রশীদ যখন তাঁদের ‘জগৎ শেঠ’ বলে অভিহিত করে দাবি করেন যে তাঁরাই দেশ চালাচ্ছেন, তাতে এই ব্যবসায়ী শ্রেণিকে তাঁদের প্রাপ্যের চেয়ে বেশি কৃতিত্ব দেওয়া হয়। টিআইবির হিসাব অনুযায়ী বর্তমান সংসদের ৬১ শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ী। মনে রাখা দরকার যে তাঁদের মনোনয়ন দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোই। অর্থ এবং বিত্ত তাঁদের ক্ষমতা প্রয়োগে সাহায্য করে, কিন্তু তাঁদের ক্ষমতার সূত্র হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, বিরাজমান রাজনৈতিক বন্দোবস্তকে মেনে নেওয়া এবং শাসনের এ ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখা। সেই কারণেই সংসদে ও সংসদের বাইরে আমলাদের বিরুদ্ধে রাজনীতিবিদদের ক্ষোভ বা কথোপকথনে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সমালোচনাকে সীমিত আকারে বিবেচনা না করে দেশের শাসনব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে এগুলো বোঝা জরুরি।

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট