শহীদ বুদ্ধিজীবী, ভাষা সৈনিক, শিক্ষক, পটুয়াখালী, বরিশাল
চুয়াডাঙ্গার দর্শনা কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন রফিকুল ইসলাম। দর্শনা কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সদালাপী ও উদার মনের মানুষ হিসেবে শিক্ষার্থীদের প্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি।
সাহিত্যানুরাগী হওয়ায় স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন স্থানীয় প্রগতিশীল বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকায় টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ছিলেন রফিকুল ইসলাম। তখন ছাত্রকর্মী হিসেবে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকার রাজপথে যে মিছিল বের হয়, তাতে তিনি যোগ দেন।
পুলিশের গুলিতে রফিক শহীদ হলে দুঃখভরে সহপাঠীসহ আরও কয়েকজনকে বলেছিলেন, তাঁর নামও রফিক।
শহীদ হওয়ার বাসনা নিয়েই তিনিও মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। শহীদ হলে ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম লেখা থাকত।
বায়ান্নতে রফিকুল ইসলামের মনোবাসনা পূর্ণ হয়নি। একাত্তরে সেই সুপ্ত মনোবাসনা নিয়ে জড়িয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। জানতেন, ধরা পড়লে মৃত্যু নিশ্চিত। তার পরও ভয় পেয়ে দমে যাননি বা চুপচাপ বসে থাকেননি।
সন্তানসহ স্ত্রীকে বরিশালে পাঠিয়ে গোপনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নানা কাজ করতে থাকেন। কিন্তু একসময় স্বাধীনতাবিরোধীদের সহায়তায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁর কর্মকাণ্ডের খবর পেয়ে যায়।
২৯ (মতান্তরে ৩১) জুলাই দর্শনায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা রফিকুল ইসলামকে তাঁর বড় ভাই দর্শনার কেরু কোম্পানির কর্মকর্তা আমিনুল ইসলামের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়।
ওই বাসায় তখন ছিলেন দর্শনা কলেজের অধ্যক্ষ লতাফত হোসেন জোয়ার্দার ও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ফজলুর রহমান। সেনারা তাঁদেরও ধরে নিয়ে যায়। এরপর রফিকুল ইসলামসহ তাঁদের কারও আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনা সম্পর্কে রফিকুল ইসলামের স্ত্রী হোসনে আরা বেগম বলেন, ‘দর্শনায় তখন আমার স্বামীর বড় ভাই আমিনুল ইসলামও থাকতেন।
তিনি দর্শনার কেরু কোম্পানির কর্মকর্তা (রসায়নবিদ) ছিলেন। তাঁর আগ্রহেই আমার স্বামী দর্শনা কলেজে যোগ দিয়েছিলেন।
‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি দর্শনায় ছিলাম না। তখন আমি গর্ভবতী ছিলাম। তাই তিনি আমাকে বরিশালে রেখে দর্শনায় ফিরে এসেছিলেন।
কিছুদিন পর থেকে নিজ বাসায় না থেকে, তাঁর ভাইয়ের বাসায় থাকতেন। ওই বাসায় দর্শনা কলেজের অধ্যক্ষ লতাফত হোসেন জোয়ার্দার ও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ফজলুর রহমানও আশ্রয় নিয়েছিলেন।
‘২৯ জুলাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন সালেহ আমার ভাশুরের বাসা থেকে তাঁদের নিয়ে যায়।
যাওয়ার সময় ক্যাপ্টেন সালেহ আমার ভাশুরকে বলে যায়, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁদের নিয়ে যাচ্ছি, কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দেওয়া হবে।
সেই কিছুক্ষণ কোনো দিন আর শেষ হয়নি। তাঁরা কেউ আর ফিরে আসেননি। পরে আমার ভাশুর অনেক জায়গায় আমার স্বামীসহ তাঁদের খোঁজ করেছেন, কোথাও খোঁজ পাননি।
আমার প্রথম সন্তান তাহসিনা ইসলামের তখন বয়স ছিল এক বছরের কিছু বেশি। দ্বিতীয় সন্তান তানভির ইসলামের জন্ম হয় আমার স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর। ছেলেকে দেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি।’ (সাক্ষাৎকার: ৯ মার্চ ২০১৫)।
রফিকুল ইসলামের জন্ম ১৯৩৬ সালে পটুয়াখালী জেলার সদর উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামে। স্থায়ী ঠিকানা বরিশাল শহরের বগুড়া রোডে।
বাবা গিয়াসউদ্দীন আহমেদ। মা গহেরুনেছা। ম্যাট্রিক পাসের পর ঢাকায় টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই তাঁর ছিল সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ। এ কারণে টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে পড়াশোনায় তাঁর মন বসেনি।
পরে বরিশাল ফিরে যান। দীর্ঘ সময় পর আবার ভর্তি হন বরিশাল বিএম কলেজে।
এখান থেকে ১৯৬৫ সালে বিএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৬৭ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পাস করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী থাকাকালে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তখন ইকবাল হল) ছাত্র সংসদের নির্বাচিত নাট্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন।
এমএ পাসের পর তিনি তাঁর বড় ভাইয়ের অনুরোধে দর্শনা কলেজে বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
রফিকুল ইসলাম কবিতা ও গল্প লিখতেন ‘রফিক ইসলাম’ নামে। ঢাকার অনেক পত্রপত্রিকাসহ কলকাতার নতুন সাহিত্য ও চতুরঙ্গ পত্রিকায়ও তাঁর কবিতা ছাপা হয়েছে।
একসময় সাংবাদিকতাও করেন রফিকুল ইসলাম। দৈনিক ইত্তেফাক-এর বরিশাল সংবাদদাতা ছিলেন। বরিশাল প্রেসক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি।
সাহিত্য ও সাংবাদিকতা ছাড়াও সমাজসেবামূলক কাজ, খেলাঘর, মুকুল ফৌজ, লেখক সংঘ, সাহিত্য পরিষদ, প্রান্তিক ইত্যাদি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গেও প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন।
প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (ষষ্ঠ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৭) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।