মতামত

রকিব–হুদা পারেননি, কাজী সাহেব পারবেন তো!

নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়াল
ছবি: প্রথম আলো

গত শনিবার সন্ধ্যায় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘একটি দায়িত্ব আরোপিত হয়েছে। এ দায়িত্ব আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার চেষ্টা করব। কমিশনের অপর সদস্যদের দায়িত্ব গ্রহণের পর তাঁদের নিয়ে বসে কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করব।’ তাঁর মতে, ‘আওয়ামী লীগকে নিয়ে তো কোনো সমস্যা নাই। ওরা তো নির্বাচন করবেই। যাঁরা বলছেন নির্বাচন করবেন না, সেসব দলের নেতাদের প্রতি আমাদের অবশ্যই একটা আবেদন থাকবে যে আপনারা আসেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন।’

হাবিবুল আউয়াল সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘রাজনৈতিক দল মানেই তো তারা নির্বাচন করবে। সেটা বিএনপি হোক, যা-ই বলি না কেন। অন্তত তাদের তো দাওয়াত করতেই হবে, আমন্ত্রণ জানাতে হবে।’প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পাওয়া কাজী হাবিবুল আউয়াল সর্বশেষ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। এর আগে তিনি আইন ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন।

কমিশনার পদে নিয়োগ পেয়েছেন যথাক্রমে সাবেক জেলা ও দায়রা জজ বেগম রাশিদা সুলতানা, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খান, সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব আনিছুর রহমান ও মোহাম্মদ আলমগীর। এ কমিশনে কেবল সাবেক সরকারি কর্মকর্তাদের আধিক্য নেই, সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিবদেরও আধিক্য আছে।
হাবিবুল আউয়াল ও তাঁর সহকর্মীরা নিয়োগ পেয়েছেন মাত্র। তাঁর বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি দুটি আশাবাদের কথা বলেছেন। প্রথমত, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন। দ্বিতীয়ত, সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করা। আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেক রকম। সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদাও দাবি করেছেন, তাঁরা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছেন। আফসোস, দেশবাসী কোনো পর্যায়ে ওই কমিশনের কাজে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার প্রমাণ পায়নি। কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের বিষয়ে এখনই মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। তবে সিইসি পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর এবং গত আগস্ট মাসে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি নির্বাচন নিয়ে যেসব কথা বলেছেন, মন্তব্য করেছেন, সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে।

প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হওয়া বাঞ্ছনীয়। সংসদে পাতানো নয়, শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা বাঞ্ছনীয়। এতে দ্বান্দ্বিকতার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের সুশাসনচর্চা হয়, নিরবচ্ছিন্ন চর্চার মাধ্যমে আদর্শ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, গণতন্ত্র সুসংহত হয়। রাজনীতিবিদেরা আরও প্রাজ্ঞ, বিচক্ষণ ও দায়িত্বশীল হয়ে জনগণের প্রকৃত আস্থা ও শ্রদ্ধাভাজন শাসক হতে পারেন। তৃতীয় শক্তির উদ্ভবের সম্ভাবনা তিরোহিত হয়। (প্রথম আলো, ২৯ আগস্ট ২০২১)

নির্বাচন কমিশন সবে গঠিত হয়েছে। পদাধিকারীরা রোববার শপথ নিয়েছেন। তাই নেতিবাচক দৃষ্টিতে এখনই কমিশনকে দেখতে চাই না। তাঁদের সাফল্য কামনা করি। আগের প্রতিটি কমিশনের দায়িত্ব গ্রহণকালে যেমন করে এসেছি। তাঁদের বেশির ভাগই হতাশ করেছেন। হাবিবুল কমিশন তার পুনরাবৃত্তি করবে না, এ প্রত্যাশা রাখা কি অন্যায় হবে?

নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার আগেই সরকারি ও বিরোধী দলের পক্ষে থেকে পরস্পরবিরোধী প্রতিক্রিয়া এসেছে। আওয়ামী লীগ নতুন কমিশনকে অভিনন্দন জানিয়েছে। বিএনপি বলেছে, আগ্রহ নেই। সব রাজনৈতিক দলই নির্বাচন করে ক্ষমতায় যেতে চায়। আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনই হলো ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র উপায়। আর নির্বাচন কমিশন ছাড়া নির্বাচনও করা যায় না। তা সত্ত্বেও নতুন নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে বিএনপির আগ্রহ না থাকার কারণটি খুঁজে বের করতে হবে। বিএনপি রাষ্ট্রপতি আহূত সংলাপে যায়নি। সার্চ কমিটি যে নাম পাঠাতে বলেছিল, তাতেও সাড়া দেননি তাঁরা।

এই প্রেক্ষাপটে বিএনপিকে নির্বাচনে আসার মৌখিক আহ্বানই যথেষ্ট কি না, কমিশনকে ভাবতে হবে। আজ যদি বিএনপি ক্ষমতায় ও আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকত, তাদের প্রতিক্রিয়া নিশ্চয়ই এখনকার বিবৃতি থেকে ভিন্ন হতো। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলেছেন। সে ক্ষেত্রে ২০১৪ সালের কিংবা ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির মতো নির্বাচন করলে হবে না। সাবেক দুই সিইসি কে এম নূরুল হুদা ও রকিবউদ্দিন আহমদ যেমনটি বলেছিলেন, ‘নির্বাচনে কোনো দল না এলে আমাদের কী করার আছে?’ অবশ্যই করার আছে। নির্বাচন বা বাছাইপ্রক্রিয়া সবার অংশগ্রহণে না হলে সেটি একতরফা হবে। ২০১৪ সালে যেমন ১৫৪টি আসনে হয়েছিল। সদ্য সমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অনেক স্থানে মন্ত্রী, সাংসদের ইচ্ছায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা জিতে গেছেন বা জেতানো হয়েছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতানো কোনো নির্বাচন প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারে না। এটা মনোনয়ন প্রক্রিয়ার অংশ।

সে ক্ষেত্রে কমিশনের প্রথম চ্যালেঞ্জ হবে নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। রকিব কমিশন সব দলকে নির্বাচনে আনতে পারেনি, হুদা কমিশন সব দলকে নির্বাচনে আনলেও ভোটের অধিকার রক্ষা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের নিয়ামক শক্তি রাজনৈতিক দল বা প্রার্থী নন। নিয়ামক শক্তি হলো জনগণ। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই জনগণকেই সবচেয়ে বেশি অগ্রাহ্য করে আসছে। তাঁরা ধরে নেন, জনপ্রিয়তা চিরদিনের জন্য গ্যারান্টেড। কিন্তু কী কারণ, কত দ্রুত যে জনপ্রিয়তা ওঠানামা করে, সেটি ভাবেন না।

বিভিন্ন দলের ঘোষিত ইশতেহার ও নীতি-পরিকল্পনায় কতটা পার্থক্য আছে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কথা কে বেশি বলল আর কে কম বলল, তার চেয়েও মানুষ সুশাসন দেখতে চায়, নির্বিঘ্নে ভোট দিতে চায়। নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা কতটা রক্ষা করেছে, নির্বাচনের আগে ও পরের কথায়, ভাষাভঙ্গিতে কতটা ফারাক আছে, সেসব তাঁরা মনে রাখেন। এ কারণেই আমরা দেখি যে জনগণ ১৯৯১ সালে বিএনপিকে জয়ী করেছে, সেই জনগণই ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছে। কথাটি ঘুরিয়েও বলা যায়, ২০০১ সালে যে জনগণ বিএনপিকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছে, সেই জনগণ ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগকেও জয়ী করেছিল। বিজয়ীরা প্রতিবার উল্লাস করেছেন। আর পরাজিতরা ষড়যন্ত্র খুঁজেছেন।

কেন ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে পরাজিত হয়, সেটি খতিয়ে দেখলে বিরোধীদের অযথা গালাগাল না করে ভুলত্রুটি স্বীকার করলে, দলের ভেতরের দানবদের কঠোর হাতে নিবৃত্ত করলে নির্বাচন নিয়ে জবরদস্তির প্রয়োজন হতো না। নির্বাচন কমিশনকেও নির্বাচনের পর আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতো না।

আমরা মনে করি, নতুন নির্বাচন কমিশনের সামনে তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। এক. বিরোধী দল যেসব কারণে বর্তমান অবস্থায় নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে না, সেসব কারণ দূর করা। দ্বিতীয়ত ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কোনো হস্তক্ষেপ করবে না, এ নিশ্চয়তা আদায় করা। নির্বাচনী প্রচার নিয়ে সব সময় যে গোলযোগ ও সংঘাত হয়, সেটি দূর করতে একই মঞ্চে সব প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাতে সংঘাত হবে না। শান্তি রক্ষায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও বেগ পেতে হবে না। তৃতীয়ত কেবল নির্বাচনের কাজে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা নন, পুরো প্রশাসনকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে এবং তা তিন মাসের জন্য নয়, এখন থেকে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত। এ দুরূহ কাজগুলো নির্বাচন কমিশন করতে পারবে কি না, তার ওপরই নির্ভর করছে ২০২৩ সালের নির্বাচনের ভবিষ্যৎ।

নির্বাচন কমিশন সবে গঠিত হয়েছে। পদাধিকারীরা রোববার শপথ নিয়েছেন। তাই নেতিবাচক দৃষ্টিতে এখনই কমিশনকে দেখতে চাই না। তাঁদের সাফল্য কামনা করি। আগের প্রতিটি কমিশনের দায়িত্ব গ্রহণকালে যেমন করে এসেছি। তাঁদের বেশির ভাগই হতাশ করেছেন। হাবিবুল কমিশন তার পুনরাবৃত্তি করবে না, এ প্রত্যাশা রাখা কি অন্যায় হবে?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com