শিক্ষার কিছু শাশ্বত লক্ষ্য আছে, আবার সমাজ পরিবর্তনের ধারায় যুগে যুগে শিক্ষার কিছু লক্ষ্যের সামান্য পরিবর্তনও হয়। আমেরিকান শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী বেঞ্জামিন স্যামুয়েল ব্লুম ১৯৫০ দশকের মাঝামাঝি দীর্ঘ গবেষণার পর শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য বিন্যস্ত করেছেন তিনটি প্রধান ক্ষেত্রে। সেগুলো হলো চিন্তন, ভাবাবেগ এবং মনোপেশিজ। প্রথম ক্ষেত্রটি কোনো বিষয় জানা, বোঝা, প্রয়োগ, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ (সৃষ্টি) এবং মূল্যায়ন করতে পারার। দ্বিতীয়টি কোনো বিষয়ের প্রতি আবেগ বা দরদ তৈরি হওয়াবিষয়ক; প্রথম ক্ষেত্রের বিষয়গুলো ভালোমতো জানা-বোঝা হলে সেগুলোর প্রতিও শিক্ষার্থীর দরদ আসে। আর এরূপ দরদ তৈরি হলে ‘জ্ঞানী’ ও ‘দরদি’ শিক্ষার্থী প্রয়োজনীয় কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয় এবং ‘মনোপেশিজ দক্ষতা’ অর্জন করে।
শিক্ষার্থী এসব দক্ষতা বা যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে ‘নিবেদিত কর্মী’ হয়ে ওঠে। তাই যোগ্যতা বা দক্ষতা বলতে কিছু করার সামর্থ্য বোঝায়। এসব সামর্থ্যের কিছু সরাসরি চিন্তাক্ষেত্রে পড়তে পারে; তবে এগুলো প্রধানত চিন্তন-পরবর্তী মনোপেশিজ ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সাধারণ শিক্ষা সচরাচর শিক্ষার্থীকে কোনো পেশায় যোগ্য করে তোলে না। তাই তাকে হয় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে হয় অথবা কোনো পেশার উপযোগী আনুষ্ঠানিক কারিগরি শিক্ষা বা উপানুষ্ঠানিক বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ নিয়ে যোগ্যতা অর্জন করে কর্মে নিয়োজিত হতে হয়।
পেশাভিত্তিক যোগ্যতার এই প্রচলিত ধারণার ভিত্তিতে এতকাল সারা বিশ্বে শিক্ষকতা, চিকিৎসা শাস্ত্র, নার্সিং, গাড়ি চালনা ইত্যাদি কারিগরি ও পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণের জন্য যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম তৈরি করা হতো। কর্মে যোগ্য হওয়ার জন্য দক্ষতা পুরোপুরি অর্জন করতে হয় বলে এসব প্রশিক্ষণ-কোর্সের শিখন হতে হয় ওস্তাদি পর্যায়ের; সাধারণ শিক্ষার মতো ৩৩-৪০ শতাংশ শেখা হলেই পাস করা যায় না। শিখন সম্পূর্ণ করতে যতবার অনুশীলন করা দরকার হোক, পেশায় পটুত্ব অর্জনের জন্য ততবারই তা করতে হয়। কিন্তু প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের পরবর্তী স্তরের শিক্ষার প্রস্তুতির পাশাপাশি যথাযোগ্য নৈতিক মানসম্পন্ন, মননশীল ও দেশপ্রেমিক করে গড়ে তোলার জন্য তাদের শিক্ষার সব উদ্দেশ্যই অর্জন করা প্রয়োজন; এতে শিক্ষা সার্বিক হয়। তাই এই স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য উদ্দেশ্যভিত্তিক শিক্ষাক্রম তৈরি করা হতো।
কিন্তু আমরা যদি শিক্ষার সব উদ্দেশ্যকেই একত্রে ‘যোগ্যতা’ নাম দিয়ে একটা ককটেল বানিয়ে ফেলি, তাহলে অবস্থাটা কেমন হয়? সে কথায় আসার আগে বিশ্বব্যাপী যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষা আন্দোলনের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে কিছু বলা দরকার।
১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দা এবং বেকারত্ব বৃদ্ধির ফলে ফ্রান্স, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (ওইসিডি) স্কুলসহ শিক্ষার সব স্তরে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষার ধারণা নিয়ে আলোচনা শুরু করে। ওইসিডির ১৯৯৫ সালের রিপোর্টে দক্ষতা এবং যোগ্যতাকে একই অর্থে ব্যবহার করা হয়। এই সংস্থা ১৯৯৭ সালে পিসা (প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট) উদ্ভাবন করে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাধান্য বিস্তার করে।
ফ্রান্সের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ জে. ডেলরস ১০ বছর (১৯৮৫-১৯৯৫) ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতির দায়িত্ব শেষ করে ইউনেসকোর কাছে তাঁর ‘লার্নিং: দ্য ট্রেজার উইদিন’ শীর্ষক শিক্ষা প্রতিবেদন জমা দেন (১৯৯৬)। ডেলরস শিক্ষার চারটি স্তম্ভ বর্ণনা করেছেন। এগুলো হচ্ছে: ১. জানতে শেখা, ২. করতে শেখা, ৩. হতে শেখা (লার্নিং টু বি) এবং ৪. একসঙ্গে বসবাস করতে শেখা। ‘করতে শেখা’র আওতায় তিনি দক্ষতার স্থলে যোগ্যতা (Competency) শব্দটি ব্যবহার করেন এবং দাবি করেন যে শিক্ষার চিন্তন ও ভাবাবেগের ক্ষেত্রকেও মনোপেশিজ ক্ষেত্রের সঙ্গে সমন্বয় করে সব স্তরের জন্যই সমন্বিত যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম তৈরি করা যায়।
ফ্রান্সে ১৯৯২ সালে এবং ফরাসি ভাষা-অধ্যুষিত বেলজিয়ামে ১৯৯৪ সালে স্কুলশিক্ষায় এই পদ্ধতির প্রচলন হয়। ওইসিডির সদস্যদেশগুলোতে ১৯৯৯ সালে এবং ওইসিডির আর্থিক সাহায্যপুষ্ট ফরাসি ভাষা-অধ্যুষিত আফ্রিকান দেশগুলোতে ২০০১ সালে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে।
ইদানীং যোগ্যতার সংজ্ঞা শুধু দক্ষতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন ‘যোগ্যতা’ বলতে স্পষ্টভাবে বর্ণিত, পরিমাপযোগ্য এবং স্থানান্তরযোগ্য সব উদ্দেশ্যকেই বোঝানো হয়। এভাবে জানা-বোঝার সঙ্গে প্রয়োগ-দক্ষতা, সমালোচনামূলক চিন্তন (বিশ্লেষণ), সমস্যা-সমাধান দক্ষতা, সৃজনশীল চিন্তন, যোগাযোগ দক্ষতা, সহযোগিতামূলক দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ দক্ষতা, মনোপেশিজ ক্ষেত্রের সব দক্ষতা এবং শিখনের ফলে দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন-সবই ‘যোগ্যতা’র অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শুধু তা–ই নয়, শিক্ষার উপর্যুক্ত সব উদ্দেশ্য অর্জন করার জন্য শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় সব শিক্ষার্থীর ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিক প্রয়োজন এবং চাহিদাকেও যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়। তা ছাড়া যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) বিধৃত অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার বিষয়টিও ধারণ করা হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ‘নো চাইল্ড লেফট বিহাইন্ড’ শীর্ষক শিক্ষা আইন ২০০১-এ অন্তর্ভুক্ত ছিল। শিখনকালীন অর্থপূর্ণ মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দান করে শিখন প্রক্রিয়া সফলতার সঙ্গে এগিয়ে নেওয়াও এখন ‘যোগ্যতা’র অন্তর্গত।
‘যোগ্যতা’র গতানুগতিক ধারণায় বিধৃত মাস্টারি লার্নিং বহাল রাখায় এবং এতে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিক বৈচিত্র্যপূর্ণ চাহিদা অন্তর্ভুক্ত করায় এখন বিস্তৃত অর্থের যোগ্যতা বলতে শিক্ষার তিনটি ক্ষেত্রে বর্ণিত সব উদ্দেশ্য ছাপিয়ে এই দুটো উপাদান অতিরিক্ত যুক্ত হয়েছে। তাই যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষা ইউরোপের কেন্দ্র থেকে এখন বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। এশীয় শিক্ষায় এর নাম দেওয়া হচ্ছে টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি কম্পিটেন্সিস, আর আমেরিকায় স্লোগানের মতো বলা হচ্ছে কম্পিটেন্সি ওয়ার্কস।
সুতরাং এখন বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় স্তরের শিক্ষাক্রমকেই যোগ্যতাভিত্তিক করতে হবে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক ১৯৯১ সালে প্রকাশিত ‘আবশ্যকীয় শিখনক্রম’ শীর্ষক প্রাথমিক শিক্ষাক্রম যোগ্যতাভিত্তিক আদলে প্রস্তুত করা হয়েছিল এবং ১৯৯২ সাল থেকেই এটি প্রাথমিক স্তরে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাস্তবে ‘যোগ্যতা’ শব্দটি কম গুরুত্বের সঙ্গে ব্যবহৃত হলেও প্রচলিত মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমে প্রাথমিকের চেয়ে বেশি যোগ্যতা-উপাদান বিদ্যমান (শিক্ষাস্তরে যত ওপরে যাওয়া যাবে, যোগ্যতা-উপাদান অবধারিতভাবে তত বাড়তে থাকবে)।
এখন মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম-কাঠামোকেও যোগ্যতাভিত্তিক আদলে সাজাতে হবে। প্রাক্-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের জাতীয় শিক্ষাক্রম একই ধারায় নিয়ে আসতে হলে প্রচলিত প্রাথমিক শিক্ষাক্রম কাঠামোতে অনেকটা অনাবশ্যকভাবে ব্যবহৃত ‘প্রান্তিক যোগ্যতা’ (টার্মিনাল কম্পিটেন্সি) ও ‘অর্জন উপযোগী যোগ্যতা’ শব্দগুচ্ছের ব্যবহার বাদ দিয়ে যুক্তিসংগত শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করতে হবে। উল্লেখ্য যে প্রান্তিক যোগ্যতা শব্দগুচ্ছের উৎস বাংলাদেশ, এটি অন্য দেশে ব্যবহৃত হয় না। কারণ, সব যোগ্যতাই এক অর্থে টার্মিনাল। টার্ম একটি পাঠ থেকে শুরু করে শিক্ষার কোনো নির্দিষ্ট স্তর, এমনকি পূর্ণ শিক্ষাকালও হতে পারে। একটি পাঠের জন্য নির্ধারিত যোগ্যতা যেমন পাঠ শেষে অর্জিত হয়, তেমনি একটি স্তরের জন্য পরিকল্পিত যোগ্যতাও ওই স্তরের শিক্ষা শেষেই অর্জিত হয়। শিক্ষাক্রমে নির্ধারিত সব যোগ্যতাই অর্জন উপযোগী; যা অর্জন করা যাবে না, তা শিক্ষাক্রমে স্থানই পেতে পারে না। সুতরাং যৌক্তিকভাবে ‘প্রান্তিক যোগ্যতা’র পরিবর্তে ‘স্তরভিত্তিক যোগ্যতা’ এবং প্রতি শ্রেণিতে অর্জনযোগ্য যোগ্যতাকে ‘শ্রেণিভিত্তিক যোগ্যতা’ শব্দগুচ্ছ দিয়ে প্রকাশ করা যায়।
যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষার ধারণা ও বাস্তবায়ন সারা বিশ্বেই একটি চ্যালেঞ্জ। ধারণাগত চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে সব যোগ্যতাকে ‘পরিমাপযোগ্য’ হিসেবে বর্ণনা করা। শিক্ষার্থীর মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি এখনো দীর্ঘ সময়ব্যাপী পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয় এবং এর মান পর্যবেক্ষকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ওপর নির্ভরশীল। দৃষ্টিভঙ্গি বা মূল্যবোধ নৈর্ব্যক্তিকভাবে পরিমাপ করার জন্য টেস্ট তৈরি করতে না পারা পর্যন্ত এই চ্যালেঞ্জ থেকে যাবে। বাস্তবায়ন ক্ষেত্রের প্রধান সমস্যা মাস্টারি লার্নিং অর্জন করা। যদিও বলা হয় যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষা সময়ভিত্তিক না হয়ে শিখনভিত্তিক হবে, বাস্তবে স্কুলশিক্ষা বার্ষিক সময়ের নিগড়ে বাঁধাই থাকবে; ওই নির্দিষ্ট সময়ে মাস্টারি অর্জন মোটেই সহজ হবে না। আর সব শিক্ষার্থীর নানা রকম চাহিদা পূরণ করে সবাইকে কাছাকাছি মানে উন্নীত করা এবং যার যেদিকে ঝোঁক সেদিকে দক্ষতা অর্জন করাতে হলে যে নানা রকম শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া (মাল্টিপল লার্নিং পাথওয়েজ) অবলম্বন করতে হবে, তার জন্য দরকার হবে সে রকম যোগ্য শিক্ষক ও শিক্ষা পরিবেশ।
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা: শিক্ষা গবেষক এবং বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের সদস্য
asmolla@ymail.com