ছুটিছাটায় পর্যটকদের ভিড়ে এখন উপচে পড়ে সিলেট। রবীন্দ্রকথিত সেই ‘নির্বাসিতা’, ‘সুন্দরী শ্রীভূমি’ এখন আর নির্বাসিতা নয়। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখনো অক্ষুণ্ন। একসময় জাফলং, মাধবকুণ্ড আর চা-বাগানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার জন্যই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছুটে এসেছেন পর্যটকেরা। এখন দর্শনীয় স্থানের অভাব নেই। বিছনাকান্দি, রাতারগুল, লালাখাল, সাদা পাথর, টাঙ্গুয়ার হাওর, সিরাজ লেক, শিমুল বাগান—আরও কত কী। প্রকৃতির আপন খেয়ালেই গড়ে উঠেছে এসব জায়গা। এর জন্য কোনো ধরনের প্রকল্প-পরিকল্পনার দরকার পড়েনি। আসার আগে এসব জায়গার কথা জেনে নেন বলেই শহরে বিরতি নিয়ে কাঙ্ক্ষিত স্থান দেখার জন্য ছুটে যান পর্যটকেরা।
আগে থেকে যে জায়গাগুলোর কথা জানেন, সেখানেই যে যেতে চাইবেন পর্যটকেরা, তা তো স্বাভাবিক। কিন্তু কথা হলো, এসব পরিচিত স্থানের বাইরে সিলেটের ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রত্ন-পুরাকীর্তি, স্থাপত্য, ভূপ্রকৃতি এবং নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পর্যটকদের জানানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি না? এ ছাড়া পর্যটকেরা প্রতিদিন যেসব স্থানে যাচ্ছেন, সেখানেও তাদের যাতায়াত ও অবস্থান নিরাপদ ও স্বস্তিকর কি না, তা নিয়ে কি আজও যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে?
অন্যরা যেখানে পর্যটকদের নিয়ে বাড়াবাড়ি করে, সে ক্ষেত্রে বাঙালিদের অবস্থান বিপরীত মেরুতে। অনেক কিছু সহজেই পেয়ে যাই বলে তা কাজে না লাগিয়ে আমরা আরও ধ্বংস করি। অথচ উপযুক্ত পরিকল্পনার সাহায্যে দর্শনীয় স্থানকে ঐতিহ্য ও পরিবেশের অনুকূলে রেখে নানা রকম উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব।
পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য ফরাসিরা কত কিছু যে করে, তার বর্ণনা রয়েছে সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘একটি সত্যি ভ্রমণকাহিনি’ বইয়ে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র ‘হাউ ডাজ ওয়ান কুক বিনস’ বইয়েও রয়েছে এক বিড়ম্বিত পর্যটকের কথা। অন্যরা যেখানে পর্যটকদের নিয়ে বাড়াবাড়ি করে, সে ক্ষেত্রে বাঙালিদের অবস্থান বিপরীত মেরুতে। অনেক কিছু সহজেই পেয়ে যাই বলে তা কাজে না লাগিয়ে আমরা আরও ধ্বংস করি। অথচ উপযুক্ত পরিকল্পনার সাহায্যে দর্শনীয় স্থানকে ঐতিহ্য ও পরিবেশের অনুকূলে রেখে নানা রকম উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব। ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসংবলিত যেসব স্থান এখনো অচিহ্নিত, সেগুলোকে পরিচিত করে প্রচার চালালে পর্যটকদের যেমন আকৃষ্ট করা সম্ভব, তেমনই স্থানীয় ইতিহাসের প্রাথমিক কাজগুলোও এতে সম্পাদিত হয়ে যায়। পাশাপাশি দরকার এই অঞ্চলের লোকশিল্প ও লোকসাংস্কৃতিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করা।
যেসব পর্যটক জাফলং, লালাখাল, বিছনাকান্দি যান, তারা হয়তো সেসব জায়গার সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি বড়জোর জৈন্তা রাজবাড়ি ও সেখানকার ডলমেন ও মেগালিথিকগুচ্ছ দেখেই ফিরে আসেন। কিন্তু ভ্রমণে সহজেই যুক্ত হতে পারে বড়দেউল, মোকামবাড়ি, চাঙ্গিল ও খাসিয়াহাটির মেগালিথিকগুচ্ছ দেখার পরিকল্পনাও। যেহেতু এ অঞ্চলের বহু কিছু এখনো অনাবিষ্কৃত, তাই পর্যটকের অনুসন্ধানী চোখ হয়তো সমাজ-ইতিহাসের নতুন কোনো উপাদান আবিষ্কার করতে পারে। মেগালিথিক নিয়ে গবেষণা হয়েছে, এখনো হচ্ছে, কিন্তু প্রাচীন জৈন্তা রাজ্যের রাজধানী নর্থিয়াংপুঞ্জির রাজপ্রাসাদের এক পরিচারিকার বীরপুত্র উ ফালিঙ্কিকে কেন্দ্র করে ছাতারূপে ডলমেন বা মেগালিথিক পাথর বহনের যে কিংবদন্তি প্রচলিত, সেটি তো গ্রিক বীরদের কিংবদন্তিগুলোর চেয়ে কোনো কম নয়। এ ছাড়া চারিকাটার দুধরাজার বাড়ি ও ফালজুরের ইয়াং রাজার বাড়ির কথা না হয় আপাতত অনুল্লিখিতই থাকল।
সিলেট-তামাবিল সড়কে অবস্থিত দরবস্ত বাজার থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে বড়চতুল গ্রামে রয়েছে দুই শ বছরের বেশি প্রাচীন স্থাপত্যকীর্তি সোনাধনের বাড়ি। এই সেই সোনাধন লস্কর, যাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে রাজবাড়ির প্রেমকাহিনিধর্মী গীতিকা ‘সোনাধনের গীত’। শ্রীধর বানিয়ারচিত ও ঐতিহাসিক রাজমোহন নাথকর্তৃক সংগৃহীত একসময়কার বিপুল জনপ্রিয় এই গীতিকাটি গাইতে তিন রাত লাগত। মিথ্যা অভিযোগে প্রাণদণ্ডের আদেশপ্রাপ্ত কোনো এক লক্ষ্মীকে পালানোর সুযোগ দেওয়ায় সোনাধন লস্করের বাবা খাধন লস্করকে রাজা বিজয় সিংহ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন।
গীতের আখ্যান অনুযায়ী, ৯২০ জন মিস্ত্রির শ্রমে নির্মিত বাড়িটি এখনো বর্তমান। বাড়ির শতাধিক একর এখন বেহাত, কিন্তু প্রাসাদের কাঠামো আগাছাবেষ্টিত হলেও আজও অবিকৃত। প্রাসাদটি সংস্কার করে এখনো এই জায়গায় তৈরি হতে পারে একটি কালচারাল কমপ্লেক্স, যেখানে ‘সোনাধনের গীত’সহ অন্যান্য সিলেট গীতিকা, পালাগান, লোকনাট্য, লোকগান, খাসিয়া সংস্কৃতির অনুষ্ঠান পরিবেশনের পাশাপাশি ওই অঞ্চলের ঐতিহ্য ও লোক-সাংস্কৃতিক উপাদান সংগ্রহ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
পর্যটকেরা অন্যান্য স্থান দেখে ফেরার পথে শেষবিকেলে ঐতিহ্যবহ অনুষ্ঠান উপভোগ করে দেখে আসতে পারেন এ অঞ্চলের নিজস্ব কীর্তিগুলোকেও। এখানে আরও থাকতে পারে স্থানীয় ইতিহাসের নিজস্ব লাইব্রেরি এবং লোকশিল্পসহ এই অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জিনিস বিক্রয়ের ব্যবস্থাও।
সিলেট-তামাবিল সড়কে সারি নদীর সেতু পার হলেই দেখা যায় একটি প্রাচীন বিশ্রামাগার বা পান্থশালা, যেটিকে ‘রাজার ঘর’, বা ‘রাজাদের উপাসনালয়’ বলেও সম্বোধন করা হয়। জৈন্তার রাজা দ্বিতীয় রামসিংহ ১৭৯৮ সালে পুবদিকের ৪০০ মিটার উঁচু পাহাড়ে যখন ‘ঢুপি মঠ’ প্রতিষ্ঠা করেন, তখন একই সঙ্গে এই বিশ্রামাগারও তৈরি করেন। সেখানে শিবমূর্তি স্থাপন করে রামেশ্বর মন্দির, পাথরনির্মিত ষাঁড়, প্রবেশদ্বার, পুকুর, ইঁদারা এবং আরেকটি বিশ্রামাগারও প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে অনেক কিছু ধ্বংস হলেও এখনো জায়গাটি সংস্কার করলে পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে।
পর্যটকদের অন্যান্য আগ্রহের জায়গা হলো টাঙ্গুয়ার হাওর, সিরাজ লেক ও শিমুল বাগান। জায়গাগুলো দেখতে আসা পর্যটকদের মধ্যে কেউ কেউ আসা-যাওয়ার পথে দেখে যান হাসন রাজার বাড়িটিও।
কিন্তু এখনো নিকটস্থ সিলেটের প্রাচীন লাউর রাজ্যকে দর্শক-পর্যটকদের সামনে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কাজ শুরু করেছে, বেরিয়ে আসবে প্রাচীন ইতিহাসের অজানা তথ্য ও কাহিনি, ভবিষ্যতে জায়গাটি পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াবে বলে আমাদের ধারণা। এ ছাড়া যেসব হাওরকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে অসংখ্য কিচ্ছা, পালা, গীতিকা, লোকগান—সেই সব শোনানোর ও দেখানোর কোনো উদ্যোগ আজও নেওয়া হয়নি। রাধারমণ দত্ত, হাসন রাজা, কামাল উদ্দিন, শাহ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহর মতো সাধক-কবিরা তো হাওরের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেরই সন্তান, তাই তাঁদের গান ও লোক আঙ্গিকের পরিবেশনা থাকলে পর্যটকেরা যেমন ঋদ্ধ হবেন, তেমনই উপকৃত হবেন হাওরাঞ্চলে দরিদ্র শিল্পী-গায়কেরাও।
হাওরের পরিবেশ রক্ষার জন্য একাধিক সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে, নিঃসন্দেহে তা প্রশংসনীয়, এর সঙ্গে সাংস্কৃতিক উদ্যোগ ও তৎপরতা অব্যাহত থাকলে আমাদের স্থানীয় ও জাতীয় সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হবে।
মোস্তাক আহমাদ দীন লেখক, গবেষক এবং লিডিং ইউনিভার্সিটির শিক্ষক