যে সামাজিক সংকটের ফাঁদে আমরা

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে কয়েক তরুণ মিলে ধর্ষণ করল; তা কেবল সমাজের অবক্ষয়ের চিত্রই তুলে ধরে না, তরুণদের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার সংকটও তুলে ধরে। সংশ্লিষ্ট ঘটনায় জড়িত তরুণদের বখাটে আখ্যা দিয়ে পার পাওয়া যাবে না, কেননা শিক্ষিত অভিজাত পরিবারের সন্তানেরাও কি একই ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে না?

নারীর নিরাপত্তা নিয়ে যেকোনো আলোচনায় রাস্তাঘাটে একশ্রেণির পুরুষের অশালীন আচরণ, কটূক্তি, ইঙ্গিতপূর্ণ অভিব্যক্তির অভিযোগ শোনা যায়। প্রায়ই মেয়েদের প্রতি পুরুষের কুনজরের অভিযোগও ওঠে। এর সঙ্গে কুবাক্য এবং ভিড়ের সুযোগে কুস্পর্শের কথাও শোনা যায়। বিবাহিত নারীর স্বামীর হাতেও ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনা সব সময় চাপা থাকে না। মেয়েদের এসব অভিজ্ঞতা থেকে সামাজিক পরিবেশের বেশ কিছু অসংগতি, ত্রুটি ও ভ্রান্তির কথা মনে আসে। সেগুলো না সারিয়ে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটানো যাবে না।

সমাজ নারী-পুরুষ নিয়েই গঠিত। এর সৌন্দর্য রক্ষা পায় উভয়ের মধ্যে সাবলীল ভারসাম্যে, যা নারী-পুরুষের সঠিক আচরণে প্রকাশ পাবে। নির্দিষ্ট বয়সে যেহেতু মানুষমাত্রের কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া যৌনচেতনা, বোধ ও আগ্রহের বিকাশ ঘটতে থাকে, তাই বয়ঃসন্ধিকালে আকস্মিকভাবে ভারসাম্যহীন অসংগত আচরণে যেন কিশোর-কিশোরীরা ঝুঁকে না পড়ে, সে পরিবেশ সমাজকেই নিশ্চিত করতে হবে। এখানেই বড় ঘাটতি, ঔদাসীন্য ঘটছে বলে ধর্ষণসহ নারীর নানা ধরনের যৌন নির্যাতনের মতো বর্বরতা এভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। এ–ও বলা দরকার, জৈবিক সুবিধা এবং সামাজিক ব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে পুরুষই সমাজে প্রাধান্য পেয়ে অভ্যস্ত। তারই ফলে নারীরা এ সমাজে একতরফাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এতে যে সমাজের ভারসাম্য, সৌন্দর্য ও সুষ্ঠু বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে, তা যেন কেউ দেখেও দেখছেন না, বুঝেও বুঝতে চাইছেন না।

জরুরি বিষয় হলো প্রথমে এ সংকট স্বীকার করা। বলা দরকার, ধর্ষণ এই সংকটের আলামত। সংকট হলো সমাজ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য সংস্থা নিজের ঘাটতিকে আমলে নিচ্ছে না, গৎবাঁধা কথা ও ব্যবস্থার ফাঁদে আটকে আছে।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, শিশুকে নীতিবাক্য শুনিয়ে কাজ হবে না! তা আচরণের ও পালনের বাস্তবতা পরিবারে ও সমাজে আছে কি না, সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। শিশু শেখে মূলত দৃষ্টান্ত থেকে। স্কুলে শিক্ষার্থীকে রাস্তায় চলাচলের নিয়মকানুনের সবক দেওয়া হলো, এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বলে গাড়ির চলাচল ও কিছু ট্রাফিকবিধি সম্পর্কেও ধারণা দেওয়া হলো। কিন্তু রাস্তায় এসে বাস্তবে তারা কী দেখে? যা শিখেছে, তার প্রতিফলন কি দেখতে পায়? এর উত্তর সবারই জানা আছে।

যদি তাদের শেখান, ‘সদা সত্য কথা বলিবে’, তারা কি তা জীবনে প্রয়োগ করতে পারবে? স্কুলে ভর্তির সময়ই মা-বাবা সন্তানের বয়স এক বছর অন্তত কমিয়ে দেন। চাকুরে জাতির মজ্জাগত শিক্ষা থেকে এই ভবিষ্যৎ–মুখী ব্যবস্থা—সন্তান যেন একটি বছর বেশি চাকরি করতে পারে অথবা বিসিএস দেওয়ার একটা বাড়তি সুযোগ পায়! এই মনোভাবে সবার মধ্যে অবাক করা ঐক্য দেখেছি। রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ গল্পে হৈমন্তীর এত হেনস্তার মূল কারণ শুভাকাঙ্ক্ষীদের ‘সৎ পরামর্শ’ উপেক্ষা করে তার সত্যবাদিতা, যা তার নীতিনিষ্ঠ বাবা তাকে শিখিয়েছিলেন। সংসার এই ‘বোকামির’ উচিত শিক্ষা দিয়েছে বাবা-মেয়েকে। আমাদের সমাজ এখনো হৈমন্তীর যুগেই আছে।

মানুষের উন্নত ব্যক্তিত্ব গঠনের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়কে রবীন্দ্রনাথ খুব গুরুত্ব দিয়েছেন—আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ। আত্মবিশ্বাস তো আর হাওয়া থেকে তৈরি হয় না, তা আসে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে। ধর্ষণকারীর যে আত্মবিশ্বাস, তাতে আত্মমর্যাদার যোগ নেই, বরং তা জলাঞ্জলি দিতেও তারা কুণ্ঠিত নয়। তাই বুঝতে হবে, এটা আত্মবিশ্বাসের ছলনা অর্থাৎ সেই স্মার্টনেস, যা আদতে সর্বনাশা চোরাবালি। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এই এক সর্বনাশা স্মার্টনেসে আসক্ত হয়ে পড়ছে দেশে-বিদেশের কিশোর-তরুণেরা। সমাজও যেন এর মধ্যে বাহাদুরির মজা পেয়েছে। এমন আশকারা পেয়ে সমাজে আজ নদীখেকো, বালুখেকো, বনখেকো ইত্যাদি খেকো-বাহাদুরদের প্রতাপ-প্রতিপত্তি বেড়ে চলেছে। তাদের কেউ রুখতে পারেনি। ধর্ষণ হলো ভ্রান্ত পৌরুষের শীর্ষ বাহাদুরি। আমরা কি দেখব না সমাজে পুরুষতন্ত্রের সফলতা-সার্থকতার মুকুট কীভাবে নির্মিত হচ্ছে?

এক সর্বনাশা স্মার্টনেসে আসক্ত হয়ে পড়ছে দেশে-বিদেশের কিশোর-তরুণেরা। সমাজও যেন এর মধ্যে বাহাদুরির মজা পেয়েছে। এমন আশকারা পেয়ে সমাজে আজ নদীখেকো, বালুখেকো, বনখেকো ইত্যাদি খেকো-বাহাদুরদের প্রতাপ-প্রতিপত্তি বেড়ে চলেছে। তাদের কেউ রুখতে পারেনি। ধর্ষণ হলো ভ্রান্ত পৌরুষের শীর্ষ বাহাদুরি। আমরা কি দেখব না সমাজে পুরুষতন্ত্রের সফলতা-সার্থকতার মুকুট কীভাবে নির্মিত হচ্ছে?

হয়তো এখানে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কথাও বলতে হবে। পুঁজি মুনাফার ব্যাপারে বেপরোয়া, সমাজে ভোগ্যপণ্যের ছড়াছড়ি ঘটে, আবার মুক্তবাজারে অবাধ প্রতিযোগিতায় বিপণন পদ্ধতি ন্যূনতম মানবিক নীতি-আদর্শকে জলাঞ্জলি দেয়। তাতে নারী ব্যবহৃত হয় পণ্যেরই মতো। তার যৌনাবেদনকে পুঁজি করার ঝোঁক কেবল বাড়তেই থাকে। ফলে পুঁজিবাদী সমাজের এই ব্যাধি ও সংকটের কথাও মাথায় রাখতে হবে। এই সূত্রে বলতে হবে, এখনো সমাজতন্ত্র অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি।

যেকোনো কিছু গড়ে তোলা সময়সাপেক্ষ এবং কঠিন কাজ, কিন্তু ভালো কাজ ভন্ডুল করা সহজ। অথচ এখানে তো ভিন্ন কোনো পথও নেই যে দীর্ঘ বা কঠিন বলে শর্টকাট খুঁজব। কাজটা হলো ছেলে ও মেয়েদের সুষ্ঠু বিকাশ নিশ্চিত করা। এ কাজে সংস্কারবদ্ধ ধারণার অচলায়তন ভেঙে বেরিয়ে আসতে হবে। অথচ সমাজে ভুল ধারণা ও সংস্কার কেবল বাড়ছে, অথচ তার সঙ্গে রাজনীতি ও ক্ষমতা যুক্ত থাকায় কাজটা একটু কঠিন এবং দীর্ঘও হচ্ছে। জার্মান দার্শনিক স্পেংলার তো বলেছিলেন, পুরুষ আদতে শিকারি প্রাণী (বিস্ট অব প্রে)। তার এই প্রবৃত্তিকে বা নারীর পিছু নেওয়া থেকে নিবৃত্ত করতে প্রতিকার হিসেবে নারীকে আড়ালে রাখলে বা বন্দিজীবনের বিচ্ছিন্নতায় ঠেলে দিয়ে সমাধান মিলবে না।

আজকাল অধিকাংশ শিক্ষালয়ে সহপাঠ চালু থাকলেও ব্যবস্থাটা এমন যে তারা এক শ্রেণিতে একসঙ্গে পড়ে বটে, কিন্তু কার্যত সম্পূর্ণ পৃথকভাবেই শিক্ষাজীবন কাটে। সেই বয়স থেকে ছেলেদের মনে যে আকাঙ্ক্ষার জন্ম নেয়, তা ক্রমাগত অকার্যকর নিষ্ক্রিয় সম্পর্কের কারণে প্রায় অধিকাংশের মধ্যেই নারী সম্পর্কে ভুল, অসম্পূর্ণ, কাল্পনিক ধারণার জন্ম দেয় এবং একটা বিকৃত যৌন অতৃপ্তিতে তারা ভোগে। যৌনতা শব্দের অর্থ ও ব্যঞ্জনাগত ব্যাপকতা বোঝা দরকার। তা না বুঝে যদি কেবল যৌনক্রিয়ার কথাই ভাবা হয়, তাহলে ন্যায়তই অভিভাবক ও মেয়ে—সবার মনেই ছেলেদের সম্পর্কে ভয় ও বিতৃষ্ণা জন্মাবে।

আদতে আমরা বলছি শিশু বয়স থেকে ছেলেমেয়েদের একযোগে পঠনপাঠন এবং নানান সাংস্কৃতিক কাজকর্মের কথা, যা অপরিচয় ও পারস্পরিক অজ্ঞানতা কাটিয়ে স্বাভাবিক সহপাঠীর জীবন তৈরিতে সহায়ক হবে। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন খোলা মাঠে খেলাধুলার সুযোগ। এ হতে পারে শরীরগঠনের স্বাভাবিক ব্যবস্থা। আর তারা যদি একসঙ্গে একটি দেয়ালপত্রিকা তৈরি করে, আবৃত্তি চর্চা করে, বিতর্ক প্রতিযোগিতা করে, নাটক মঞ্চায়ন ইত্যাদি করে, তাহলে তাদের পরস্পরের মধ্যে যে পরিচয় ঘটবে, তার ভিত্তি হবে প্রত্যেকের নিজ নিজ গুণ। তারা দেখবে যে পড়াশোনার পাশাপাশি তারা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু, এমনকি অনেক কিছুই পারে। এতে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হবে—তারা কেউ খুদে লেখক, শিল্পী, আবৃত্তিকার ইত্যাদি। ফলে সেসব গুণের মাধ্যমে অর্জিত পরিচয়ের মর্যাদা রক্ষার দায় তাদের নিতে হয়। এভাবে তারা পরস্পরের বন্ধু হবে, গুণগ্রাহী হবে, হবে সুহৃদ।

কয়েক দশক আগেও খেলাঘর, কচিকাঁচার মেলার মতো শিশুসংগঠন এবং পাড়ার ক্লাবগুলো সক্রিয় থাকায় ছেলেমেয়েরা সৃজনশীল ও মানবিক কাজে যুক্ত হয়ে আনন্দময় শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছে। ধর্ষণের কথা এদের মধ্যে তো শোনা যায়নি! বাস্তবে আমরা তো দেখছি দু-চারজনই ধর্ষক, বাকি সব ছেলে শিক্ষার্থীরা ভুক্তভোগী মেয়েটির সমব্যথী এবং ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলনে আছে। এরাই সংখ্যাগুরু, এরাই ভরসা। কেবল বৃহত্তর সমাজ যেন ধর্ম-বর্ণ-শিশু-লিঙ্গনির্বিশেষে শিক্ষার্থীদের ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশমূলক কর্মময় যৌথ অভিযাত্রার পথে বাধা না হয়, সেটাই নিশ্চিত করতে হবে।

আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক