ইমরান খান তাঁর পূর্বতন আরও কয়েকজন নেতার মতোই প্রধানমন্ত্রিত্ব শুরু করেছিলেন এস্টাবলিশমেন্টের শতভাগ আশীর্বাদে।
ইমরান খান তাঁর পূর্বতন আরও কয়েকজন নেতার মতোই প্রধানমন্ত্রিত্ব শুরু করেছিলেন এস্টাবলিশমেন্টের শতভাগ আশীর্বাদে।

যে পাঁচ কারণে ইমরানের পিটিআই ব্যর্থ হলো

একটা সুখের স্বপ্ন কেন দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো? কেন তা হলো, সেটা দেখে নিই:  
এক. এস্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে না পারা
এস্টাবলিশমেন্টের (পাকিস্তানে সেনাবাহিনী এস্টাবলিশমেন্ট হিসেবে পরিচিত) সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার পথটিই ছিল ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক ই ইনসাফের (পিটিআই) জন্য সহজতম পথ। পিটিআইর জন্ম ও বিকাশের ইতিহাস যদি আমরা দেখি তাহলে দেখতে পাব, ২০১১ সালে দলটি পুনর্জন্ম ও পুনর্গঠিত হয়। এস্টাবলিশমেন্টের সহায়তায় পিটিআইর ক্ষমতা আহরণের পথ ছিল লালগালিচায় মোড়া। ইমরান খান তাঁর পূর্বতন আরও কয়েকজন নেতার মতোই প্রধানমন্ত্রিত্ব শুরু করেছিলেন এস্টাবলিশমেন্টের শতভাগ আশীর্বাদে। এরপর ঘটনার পর ঘটনা গেছে, ইস্যুর পর ইস্যু গেছে, নীতির পর নীতি গেছে, পিটিআই নেতৃত্ব এস্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে সব ক্ষেত্রেই সম্পর্ক রক্ষা করতে পেরেছিল। কিন্তু আইএসআইর মহাপরিচালক নিয়োগকে কেন্দ্র করে দলটি এস্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। পিটিআইর সবাই জানে, একমাত্র কাদের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে তারা ক্ষমতায় এসেছে এবং ২০২৩ সাল পর্যন্ত তাদের ক্ষমতায় রাখতে পারে। পিটিআই এখন সেই একমাত্র সম্পর্ককে উড়িয়ে দিয়েছে। সামনে পিটিআইর বিভিন্ন স্তরের নেতার সামনে অফুরন্ত সময় আসতে যাচ্ছে। এখন তাঁরা মূল্যায়ন করতে পারবেন কোন কোন খারাপ সিদ্ধান্তের কারণে এস্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ভেঙে গেল। আর এ ভাঙনের জন্য দায়ীই-বা কে?

মানুষের মধ্যে আশা, অন্তর্ভুক্তি বোধ জাগানোর বদলে পিটিআই বিষাক্ত ও বিদ্রোহের বীজ বুনেছে। ঔদ্ধত্য এমন একধরনের বৈশিষ্ট্য, যেটা কেউই পছন্দ করে না। কিন্তু সেটাই যদি কোনো রাজনৈতিক দলের চর্চার বিষয় হয়, তাহলে সমাজের সব অংশের ভেতরে তা ছড়িয়ে পড়ে। অতি আত্মবিশ্বাস ও ঔদ্ধত্য—এ দুটি বৈশিষ্ট্য যখন সরকার পরিচালনাকারী কোনো দলের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তার ফলাফল হয় ভয়াবহ। এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে জনমনে পিটিআইর ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

দুই. বিরোধীদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে অস্বীকৃতি

পিটিআইর যে বিভেদের নীতি, সেটা বিরোধী দলে থাকলেই ভালোভাবে কার্যকর হতে পারে। সরকারে থাকাকালে দলটির এই নীতি পরিবর্তন করার প্রয়োজন ছিল। বিরোধীদের সঙ্গে যদি ন্যূনতম কেজো সম্পর্ক তারা রক্ষা করে চলত, তাহলে রাজনৈতিক ময়দান ঠান্ডা থাকত।। একই সঙ্গে সরকার পরিচালনা করা তাদের জন্য সহজতর হতো। বিরোধী দলগুলোকে শান্ত রাখতে পারলে সরকার তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে আরও মনোযোগ দিতে পারত। পিটিআই সরকার পরিচালনা থেকে নিজেদের চোখ সরিয়ে নিয়ে ভুল লক্ষ্যের দিকে এগিয়েছে।

তিন. বুজদারকে নিয়ে যে ভুল

পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে উসমান বুজদারকে বেছে নেওয়াটা সবার জন্য কৌতূহলোদ্দীপক ছিল। কিন্তু খুব শিগগিরই স্পষ্ট হয়ে গেল, এ পদে থাকার মতো যোগ্য ব্যক্তি তিনি নন। ইমরান খানের গোঁয়ার্তুমি হলো, ভুলটা যে তিনি করেছেন, সেটা জেনেও তা সংশোধনের কোনো চেষ্টা তিনি করেননি। সময় যত গড়িয়েছে, সেই ভুল থেকে বহুমুখী সংকট সৃষ্টি হয়েছে। (ক) এস্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে পিটিআইর সম্পর্কের যে ফাটল, সেটার সূত্রপাত বুজদারের নিয়োগ। তিন বছরে যেটা আরও গভীর হয়েছে। (খ) পাঞ্জাবের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশে বুজদার সরকার পরিচালনা করেছেন তাঁর পূর্বসূরি শেহবাজ শরিফের থেকে অনেক খারাপভাবে। ফলে পিটিআইর সামর্থ্য নিয়ে জনগণের মধ্যে বড় প্রশ্ন তৈরি হয়। (গ) নিঃসন্দেহে দল পরিচালনার ক্ষেত্রে এটা নেতৃত্বের দুর্বলতা। ফলে পিটিআইর মধ্যে উপদল ও গ্রুপিং সৃষ্টি হয়। দুর্বল নেতৃত্ব কোনো সমস্যার সমাধান দিতে না পারায় শেষ পর্যন্ত দল থেকে একটা অংশ বেরিয়ে যায়। বুজদারকে নিয়ে পিটিআই যে ভুল করেছে, সেটা প্রথমেই এড়ানো যেত, যায়নি বলেই সেটা আজ পিটিআইর ব্যর্থতার প্রধান একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একেবারে শেষ মুহূর্তে বুজদারকে ফেলে দিলেন। কিন্তু এখন এত দেরি হয়ে গেছে যে এই সিদ্ধান্ত ভুলকে আরও বাড়িয়ে দিল।

চার. অযোগ্যদের দিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন

নির্বাচনের আগে পিটিআই যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জনগণকে যা দিয়েছে, দুইয়ের মধ্যে যে কতটা ব্যবধান, তা কারও পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব নয়। পিটিআই সরকারের মন্ত্রিসভা স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল, সে কারণেই প্রধানমন্ত্রীকে কিছুদিন পরপর মন্ত্রীদের দপ্তর বদল করতে হয়েছে। মন্ত্রিসভায় সানিয়া নিস্তার ও ফয়সল সুলতানের মতো অবশ্যই দু-একজন ব্যতিক্রম রয়েছেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। মন্ত্রিসভার কারণে পিটিআই সরকার যেভাবে ব্যর্থ হয়েছে তা হলো: (ক) কল্যাণ রাষ্ট্রের বাজে ধারণা ছাড়া মন্ত্রিসভার কোনো কেন্দ্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি নেই। (খ) অর্থ, জ্বালানি ও তথ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের বারবার বদল করা হয়েছে। ফলে এই মন্ত্রণালয়গুলো সব সময় একটা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গেছে। (গ) বিমান চলাচল, মানবাধিকারসহ কিছু মন্ত্রণালয়, বিভাগ বিপর্যয়কর পারফরম্যান্স করার পরও তাদের কোনো জবাবদিহির মধ্যে আনা হয়নি। (ঘ) সরকারের মুখপাত্র হিসেবে যাঁদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাঁরা সরকারের উপলব্ধি ব্যাখ্যার বদলে বিরোধীদের তুলাধুনা করতেই বেশি ব্যস্ত থেকেছেন।

পাঁচ. অতি আত্মবিশ্বাস ও ঔদ্ধত্য

পিটিআইর ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হচ্ছে, সবকিছুর ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব ও ন্যায়পরায়ণতার বোধ। এই ধারণা সবাইকে ঘৃণা করতে শেখায়। সংবাদ সম্মেলন আর বক্তব্য-বিবৃতিতে ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপাত্মক ভাষার ব্যবহার তারা করেছে। মানুষের মধ্যে আশা, অন্তর্ভুক্তি বোধ জাগানোর বদলে পিটিআই বিষাক্ত ও বিদ্রোহের বীজ বুনেছে। ঔদ্ধত্য এমন একধরনের বৈশিষ্ট্য, যেটা কেউই পছন্দ করে না। কিন্তু সেটাই যদি কোনো রাজনৈতিক দলের চর্চার বিষয় হয়, তাহলে সমাজের সব অংশের ভেতরে তা ছড়িয়ে পড়ে। অতি আত্মবিশ্বাস ও ঔদ্ধত্য—এ দুটি বৈশিষ্ট্য যখন সরকার পরিচালনাকারী কোনো দলের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তার ফলাফল হয় ভয়াবহ। এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে জনমনে পিটিআইর ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ফাহাদ হোসেন পাকিস্তানের সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার
দ্য ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত