যে দেশে করোনায় কেউ মরেনি

করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবচেয়ে সফল বলা হচ্ছে ভিয়েতনামকে। ছবি: রয়টার্স
করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবচেয়ে সফল বলা হচ্ছে ভিয়েতনামকে। ছবি: রয়টার্স

কোভিড-১৯–এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিশ্ব প্রায় তছনছ। কিন্তু গুটিকয়েক দেশ ও অঞ্চল ভাইরাসটির কাছে খানিক অপরাজেয় হয়ে আছে। এর মধ্যে ভিয়েতনামের কথা সবার আগে বলতে হয়। 

ভাইরাসবিরোধী বিশ্বযুদ্ধে মৃত্যুর সংখ্যা এখন আড়াই লাখ প্রায়। অথচ প্রায় ১০ কোটি মানুষের দেশ ভিয়েতনামে এখনো কেউ এই ভাইরাসে মারা যায়নি। ২৭০ জন সেখানে সংক্রমিত হয়েছে। তার মধ্যে ২২০ জন ইতিমধ্যে সুস্থ হয়ে গেছে। এই লেখা তৈরির সময় সর্বশেষ ছয় দিনে দেশটিতে কেউ সংক্রমিত হয়নি।

ভাইরাসের উৎপত্তি যে দেশে, সেই চীনের সঙ্গে রয়েছে ভিয়েতনামের প্রায় ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটারের সীমান্ত। ভিয়েতনাম থেকে চীনে হাজার হাজার মানুষের আসা-যাওয়া। ২৫ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক দুই দেশের। তারপরও ভাইরাস কাবু করতে পারেনি ভিয়েতনামকে। কীভাবে ভাইরাস মোকাবিলায় ভিয়েতনাম অবিশ্বাস্য সফলতা দেখাল, সেটা সমগ্র বিশ্বের কাছেই এখন এক অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে উঠছে।

যুদ্ধের প্রথম অধ্যায়

কারও মৃত্যু না হলেও ভিয়েতনামে এ পর্যন্ত করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ নাগরিকের। কোয়ারেন্টিনে আছেন ৬০ থেকে ৭০ হাজার মানুষ। এসবই শুরু সেই জানুয়ারি থেকে। ওই মাসেই দেশটিতে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে।

ভিয়েতনামের স্বাস্থ্য খাত এখনো সরকারি প্রয়াসনির্ভর এবং মোটেই উন্নত দেশগুলোর মতো নয়। প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য সেখানে চিকিৎসকের সংখ্যা ৮। ৪৭টি কেন্দ্রীয় এবং প্রায় এক হাজার ছোট স্থানীয় পর্যায়ের হাসপাতাল রয়েছে সেখানে। আছে বেসরকারি হাসপাতালও। তবে স্বাস্থ্য খাতের শক্তি ও দক্ষতার চেয়ে করোনা মোকাবিলায় ভিয়েতনামের সফলতা মুখ্যত রাজনৈতিক দূরদর্শিতায়।

রোগ ধরা পর্যন্ত অপেক্ষা করেনি দেশটির নেতৃত্ব। তার আগেই সর্বোচ্চ প্রশাসনিক সতর্কতায় কাজে নেমে পড়েছিল। ফেব্রুয়ারিতেই সেখানে এটা সরকারের সবচেয়ে 'অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়' হয়ে যায়। শুরুতে যারাই সংক্রমিত হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের চলাফেরা-মেলামেশার ইতিহাস সংগ্রহ করা হতো। সংক্রমিত ব্যক্তিদের কাছে আসা মানুষদেরও পরীক্ষার আওতায় আনা হয় ব্যাপক হারে। কমিউনিটিজুড়ে শুরু হয় প্রচার ও সচেতনতার কাজ।

গত ১৭ মার্চ থেকে দেশটিতে জনসমাগমস্থলে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। মাস্কের দাম বাড়ানোকে বড় আকারে শাস্তির আওতায় আনা হয়। ভাইরাস সংক্রমণের তথ্য লুকানোকেও শাস্তিযোগ্য করা হয়। রাস্তায় রাস্তায় 'মাস্কের ফ্রি এটিএম বুথ' খোলা হয়।

মার্চ থেকেই ভিয়েতনামে আসা সব নাগরিককে বাধ্যতামূলক আইসোলেশনে নেওয়া হয়। বিদেশিদের আসায় সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। হোটেল ও সামরিক ছাউনিগুলোর অনেকটিকে অস্থায়ী হাসপাতাল ও আশ্রয়কেন্দ্র বানিয়ে ফেলা হয়। বিমানগুলো আসার খবর আগেই ঘোষণা করা হতো এবং সব যাত্রীকে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে রিপোর্ট করা বাধ্যতামূলক করা হয়। বিমানবন্দরেও বিনা খরচে ভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়।

যে এলাকায় সংক্রমণের খবর মিলত, সেখানে পুরো এলাকাকে কোয়ারেন্টিন করে টেস্ট শুরু হতো। কোয়ারেন্টিন করা জায়গার আশপাশেই খোলা হতো অস্থায়ী আশ্রয় ও চিকিৎসাকেন্দ্র। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে হ্যানয় থেকে ২৫ মাইল দূরে সন-লই নামের একটা গ্রামে যখন কয়েকজনের দেহে 'করোনা পজিটিভ' শনাক্ত হয়, তখন প্রায় ১০ হাজার মানুষের পুরো এলাকা ২০ দিনের জন্য লকডাউন করে টেস্ট শুরু হয়। ফার্মাসিগুলো থেকেও তথ্য নেওয়া শুরু হয়, কে কী ওষুধ কিনেছে। সেই ইতিহাস ধরেও দেশটিতে টেস্ট করা হয় অনেক। কাজগুলো কঠিন ছিল না। কেবল প্রশাসনকে বহুমুখীকরণ করা হয়েছিল। এভাবে ভিয়েতনামের প্রশাসন হাঁটছিল ভাইরাসটির আগে আগে। অন্য দেশগুলো এক মাস পর দেখা গেল ছুটছে সংক্রমণের পিছু পিছু।

মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ রোগী থাকার পরও এপ্রিলে এসে দেশটি করোনাসংকটকে 'জাতীয় মহামারি'তুল্য সমস্যা ঘোষণা করে। এতে পুরোনো প্রশাসনিক উদ্যোগগুলোই আরও জোরালো করা হয়। ফলে দেশটির অর্থনীতি গত কয়েক মাসে তেমন হোঁচট খায়নি।
ভিয়েতনাম প্রমাণ করেছে, স্বাস্থ্যব্যবস্থা খুব মানসম্মত না হয়েও করোনা মোকাবিলায় সফল হওয়া যায়।

ভিয়েতনামে করোনা কারও প্রাণ নিতে পারেনি।শুরু থেকেই সামাজিক দূরত্বকে কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে ভিয়েতনামের মানুষ। ছবি: রয়টার্স

যুদ্ধের দ্বিতীয় অধ্যায়

ভিয়েতনামের নীতিনির্ধারকেরা কেবল ভাইরাসকে থামিয়েই নিজেরা থামেননি; দেশটিতে সংক্রমণ কম থাকা সত্ত্বেও ভাইরাসযুদ্ধে সেখানকার সরকারের আরেকটি বড় উদ্যোগ ছিল 'টেস্ট কিট' নিয়ে গবেষণা এবং এটা তৈরিতে নামা। এ ক্ষেত্রে তারা এখন বিশ্বজুড়ে দৃষ্টান্ত। জানুয়ারিতেও তারা কোরিয়া থেকে কিট আমদানি করেছিল। এপ্রিলে এসে দেখা যাচ্ছে, কিটের গবেষণা ও উৎপাদন শেষে তারা সেটা প্রায় ২০টি দেশে রপ্তানি শুরু করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যে 'মেড ইন ভিয়েতনাম' কিটের স্বীকৃতি দিয়েছে। ইরান, ফিনল্যান্ড, ইউক্রেন প্রভৃতি দেশে যাচ্ছে এখন ভিয়েতনামের কিট। আমেরিকা বলছে, তারাও এটা নিতে ইচ্ছুক।

ডাক্তার ও নার্সদের মধ্যে করোনার সংক্রমণ কম রাখতে ভিয়েতনামের স্বাস্থ্য প্রশাসন হাসপাতালের রুমগুলো পরিষ্কার করাসহ অনেক কাজে রোবট ব্যবহার করেছে। এ ছাড়া চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত সবার খাবারদাবার প্রস্তুত রাখার জন্য বড় সংখ্যায় স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়। দীর্ঘ সময়ে কাজের উপযোগী পোশাক সরবরাহ করা হয় চিকিৎসকদের। প্রতি দফায় ডিউটির জন্য এক সেট পোশাক দেওয়া হতো। টয়লেটে যাওয়া কমাতে এই চিকিৎসাকর্মীদের বিশেষ ধরনের ডায়াপারও দেওয়া হয়।

খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ সচল রাখতে মাস্কের এটিএম বুথের মতোই চালেরও বুথ খোলা হয় ভিয়েতনামে। ভিয়েতনামের এই 'চাল-বুথ' করোনাকালে বিশ্বের বড় খবর ছিল। এসব কাজে খরচ সামাল দিতে দেশটির সরকার একটা তহবিল গঠনের ডাক দিলে তাতে সরকারি-বেসরকারি তরফ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ ডলার জমা পড়ে। এই তহবিল গঠনের মধ্য দিয়ে জাতীয়ভাবে করোনা মোকাবিলার কাজে সবার অংশগ্রহণের বোধ তৈরি করা হয়।
সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা এখনো তিন শর নিচে হলেও ভিয়েতনাম ১০ হাজার রোগীকে চিকিৎসা করার মতো ওষুধ ও সরঞ্জাম মজুত রাখার ঘোষণা দিয়েছে কিছুদিন আগেই, যা দেশটির নাগরিকদের মধ্যে আস্থার পরিবেশ বাড়িয়েছে।

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ প্রায় সব আন্তর্জাতিক সংস্থা করোনা মোকাবিলায় ভিয়েতনামের উদ্যোগের প্রশংসা করছে নিয়মিত। কিন্তু সেখানকার সরকার প্রতিদিন তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে চলেছে। তাদের আচরণে সন্তুষ্টির ছাপ নেই মোটেই। এ নিয়ে প্রবল কোনো শ্লাঘা শোনা যায় না রাজনীতিবিদদের তরফ থেকে।

কোনো মৃত্যু না থাকার পরও ভিয়েতনাম জাতীয় মহামারির ঘোষণা এখনই প্রত্যাহার করতে অনিচ্ছুক। যেহেতু বিশ্বজুড়ে সংক্রমণ এখনো উচ্চমাত্রায় অব্যাহত আছে, তাই হ্যানয় সরকার মনে করছে 'স্বাভাবিক অবস্থা'র ঘোষণা দিলে সংক্রমণের দ্বিতীয় তরঙ্গ দেখা দিতে পারে। ফলে, এপ্রিলজুড়েও দেশটিতে কোভিড-১৯–কেন্দ্রিক সব সতর্কতা বহাল ছিল। কেবল অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল খুলে দেওয়া হয়েছে গত বৃহস্পতিবার থেকে। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৩-এ সার্স ভাইরাসের সময়ও এশিয়ার এই অঞ্চলে ভিয়েতনামই প্রথম নিজেকে তার থেকে মুক্ত ঘোষণা করেছিল।

ভিয়েতনামের প্রশাসনকে দেখে মনে হয় আমেরিকার বিরুদ্ধে ৪৫ বছর আগের যুদ্ধের দিনগুলোর মতোই এখনো সতর্ক তারা। তাদের কাছে এটাও যেন নতুন এক যুদ্ধ। গত ৩০ এপ্রিল ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধে স্থানীয়দের মহাকাব্যিক বিজয়ের আরেকটি বার্ষিকী। কিন্তু সেদিনও পুরোনো বিজয়ে আবেগমথিত না হয়ে ভিয়েতনামের জনগণ ও প্রশাসন পুরো মনোযোগ দিয়ে রেখেছিল নতুন যুদ্ধের দিকে। সতর্কতার ধরন বলছে, ভিয়েতনামের রাজনীতিবিদেরা যেন আজও সবাই একেকটা গেরিলা ম্যানুয়েল। মানুষ বাঁচাতে সম্পদের চেয়েও কৌশল ও অঙ্গীকারকে গুরুত্ব দিচ্ছে তারা।

১৯৭৫-এর এপ্রিলে আমেরিকা যে ভিয়েতনাম থেকে পরাজিত হয়ে এসেছিল, সেই দেশটির অর্থনীতি এখনো আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার মতো রাজ্যের চেয়ে ছোট। সম্প্রতি হ্যানয় যখন ইউরোপের দেশগুলোকে মাস্ক ও মেডিকেল কিট উপহার হিসেবে পাঠাচ্ছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলোয় তা গভীর বিস্ময়ই তৈরি করে। কারণ, তাদের দেশে প্রতিনিয়তই মাস্ক ও কিটের স্বল্পতার খবর প্রকাশ পাচ্ছে।

কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ফল হিসেবে ভিয়েতনাম যে এশিয়ায় বিদেশি বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় পছন্দস্থল হয়ে উঠতে চলেছে, সেটাই ছিল ওই সব সংবাদমাধ্যমের অনুমান।
বাংলাদেশ অনেক সময়ই বিভিন্ন রপ্তানিদ্রব্যে ভিয়েতনামকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে। কিন্তু ভিয়েতনামের রাজনৈতিক-প্রশাসন থেকেও হয়তো অনেক কিছু শেখার ছিল আমাদের।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক