পুঁজিকেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্র এবং এর নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তিগুলোর ভেতরে এক দারুণ দ্বন্দ্ব এখন ক্রিয়াশীল। রাজনীতির এ দ্বন্দ্ব খুব স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে আটলান্টিকের দুই পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য উভয় দেশেই এক জোড়ের উত্থান ঘটছে, যা পুরো বিশ্বরাজনীতিকেই হয়তো বদলে দিতে পারে।
হোয়াইট হাউসের মসনদ বর্তমানে এক অদ্ভুত নিষ্ঠুর ব্যক্তির দখলে, যাঁর উপস্থিতি সারা বিশ্বেই কট্টরবাদকে উসকে দিচ্ছে। নীতি, নৈতিকতা তো দূর অস্ত, এমনকি সত্যের উপস্থাপনও এই এখনকার সময়ে আর তেমন প্রভাব ফেলছে না। যেকোনো বিব্রতকর সত্যের বিপরীতে মুচকি হেসে বলে দিলেই হলো, ‘তো কী হয়েছে?’ যেকোনো কিছুতেই নিজেকে ‘চ্যাম্পিয়ন’ হিসেবে দেখানোর যে প্রবণতা দেশে দেশে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, তার উৎস বলা যায় ওই হোয়াইট হাউসই। এর অর্থ এই নয় যে হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেকের আগে বিশ্বের কোথাও একনায়ক ছিল না। ছিল এবং আছে।
ট্রাম্প জমানা নিয়ে বিস্তর বাগাড়ম্বরের মূল কারণ আসলে যুক্তরাষ্ট্রের ওই সাদা বাড়ির গোটা বিশ্বে ছড়ি ঘোরানোর ক্ষমতার মধ্যে নিবদ্ধ। এই হোয়াইট হাউসই যখন একজন সর্বেসর্বার কর্তৃত্ব মেনে নেয়, তখন সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা যুক্তরাষ্ট্রের আবেদন কমবে, এটাই স্বাভাবিক। কমেছেও। আর এই আবেদন কমে যাওয়ার সূত্রেই রয়েছে কট্টরবাদের উত্থানের বিষয়টি।
মজার বিষয় হলো, বিশ্বরাজনীতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপস্থিতি শুধু কট্টরদেরই উদ্দীপ্ত করছে না, তিনি একই সঙ্গে তাঁর প্রতিপক্ষের শক্তি বৃদ্ধিতেও অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছেন। ওই যে ‘তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে’, সেই প্রাচীন ও অকাট্য বচনটিকে সত্য করেই বিশ্ব দেখছে একজন বার্নি স্যান্ডার্সের উত্থান, দেখছে একজন জেরেমি করবিনের উত্থান। আটলান্টিকের দুই পারে এই দুই নেতা বিদ্যমান ব্যবস্থাটিকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন, যা শঙ্কিত করে তুলছে পুঁজির মধুপায়ীদের। গত শতকের সত্তরের দশকের পর থেকে যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে বামপন্থা আরও ভালো করে বললে সমাজতন্ত্র পিছু হটছিল, সেই দুই দেশেই সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতার তালিকায় উঠে এসেছেন এমন দুই নেতা, যাঁরা নিজেদের সমাজতন্ত্রীই বলছেন।
শুধু স্যান্ডার্স বা করবিন কেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশেই সমাজতন্ত্রীদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। ফিনল্যান্ডে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে দেশটির সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি। না, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি দলটি। ফিনল্যান্ডের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল এখন এই দল। ফলে ২০০৩ সালের পর প্রথম কোনো সমাজতন্ত্রীকে নিজেদের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাচ্ছে এ কল্যাণরাষ্ট্রের নাগরিকেরা।
কাতালান স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন আন্দোলন ও রাজনৈতিক মেরুকরণের মধ্যেই ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত স্পেনের সাধারণ নির্বাচনে ১২৩টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে পেদ্রো সানচেজের সোশ্যালিস্ট পার্টি। এই দলও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ফিনল্যান্ডের মতো স্পেনেও সরকার গঠনের জন্য সমাজতন্ত্রীদের অন্য কোনো দলের সঙ্গে জোট বাঁধতে হবে। দুটি দেশেই সর্বশেষ নির্বাচনে কট্টর ডানপন্থীরাও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আসন পেয়েছে। অর্থাৎ বামপন্থা ও ডানপন্থার জনপ্রিয়তা একই সঙ্গে বাড়ছে। তবে বামপন্থার জনপ্রিয়তার গতি কিছুটা বেশি। ট্রাম্প ও তাঁর কট্টর নীতি থেকে অনুপ্রাণিত বিভিন্ন নেতার উত্থান এবং তাঁদের অধীনে কিছুকাল কাটানোর কারণেই এই গতিবৃদ্ধি। কট্টর নীতির স্বাদ জনগণ বুঝতে পেরেই এখন ফিরে তাকাচ্ছে শতাব্দীপ্রাচীন মতবাদের দিকে, যা সময়ের সঙ্গে নিজেকে নবায়ন করে স্যান্ডার্স ও করবিনের মতো নেতার মাধ্যমে প্রকাশ খুঁজে পাচ্ছে। শঙ্কা ভুলে সাধারণ জনগণ, বিশেষত তরুণেরা বামপন্থার বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাবছে, কথা বলছে।
১৯১২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম সমাজতন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে ইউজিন ডেবস মাত্র ৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। এক শতকের ব্যবধানে অবস্থা এখন এমন যে ২০১৬ সালের নির্বাচনে স্যান্ডার্সকে সমর্থন জানানো তরুণের সংখ্যা ছিল হিলারি ও ট্রাম্পকে সমর্থন জানানো তরুণের সংখ্যার যোগফলের বেশি। ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট অব আমেরিকার (ডিএসএ) সদস্যসংখ্যা ২০১৬ সালের নির্বাচনের সময়েও ছিল মাত্র ছয় হাজার। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় বসার পর এ সংখ্যা বাড়তে শুরু করে, যা গত বছরই ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
স্যান্ডার্স ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে যে ঢেউ তুলেছিলেন, তা মার্কিন কংগ্রেসে নিয়ে এসেছে আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ, রাশিদা তালিব, এলিজাবেথ ওয়ারেনের মতো নেতাদের, যাঁরা নিজেদের ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট বলে পরিচয় দেন। নতুন ধারার এই ডেমোক্র্যাট, যারা স্যান্ডার্সপন্থী হিসেবেই পরিচিত, তাঁরা এখন পুরো দলের অভিমুখটিই বদলে দিচ্ছেন। ডেমোক্রেটিক দলের কেন্দ্রীয় বিবাদ এখন বামপন্থীদের আটকে কী করে দলের এত দিনের প্রচলিত কাঠামোটি টিকিয়ে রাখা যায়।
যুক্তরাজ্যে একই রকম জনপ্রিয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন জেরেমি করবিন। ২০১৫ সালে লেবার পার্টির নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর অনেকেই লেবার পার্টির রাজনীতির শেষ দেখতে পেয়েছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে করবিনের নেতৃত্বকে শুরু থেকে প্রশ্নবিদ্ধ করছিলেন নয়া উদারবাদের ধারক লেবার নেতারা। এই নেতারাই এখন করবিনের সাফল্যে স্তম্ভিত। করবিন দলের নেতৃত্বে আসার পর লেবার পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাড়ে ৩ লাখ নতুন সদস্য। ২০১৭ সালের নির্বাচনে লেবার পার্টি ১৯৪৫ সালের পর সর্বোচ্চ ভোট পায়। সব মিলিয়ে আটলান্টিকের দুই পারেই দুই সমাজতন্ত্রীর উত্থান হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
কথা হলো, যদি সত্যিই স্যান্ডার্স ও করবিন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন, তাহলে তাঁদের দেশ দেখতে কেমন হবে, বৈশ্বিক রাজনীতিই–বা নতুন কী দেখবে। এর উত্তর পেতে হলে তাকাতে হবে এই দুই নেতার দিকেই। এ ক্ষেত্রে আমাদের এ দুটি বই সাহায্য করতে পারে। একটি ‘ইকোনমিকস ফর দ্য মেনি’, অন্যটি ‘হয়্যার উই গো ফ্রম হেয়ার: টু ইয়ার্স ইন দ্য রেজিস্ট্যান্স’। প্রথমটি জন ম্যাকডন্যাল সম্পাদিত, যাঁকে মনে করা হয় করবিনের ছায়া উপদেষ্টা। আর দ্বিতীয়টি লিখেছেন স্বয়ং বার্নি স্যান্ডার্স।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানাচ্ছে, ‘ইকোনমিকস ফর দ্য মেনি’ বইয়ে স্থান পাওয়া ১৬টি প্রবন্ধে কর থেকে বাণিজ্য, আর্থিক পুঁজি থেকে শুরু করে উৎপাদন খাত—প্রতিটি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এতে সুস্পষ্টভাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে উচ্চ মজুরি, উচ্চ উৎপাদনভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামোর কথা, যেখানে সরকারি ব্যাংক, বিনিয়োগ ও মালিকানাই মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। থাকবে সমবায় ধারণার সম্প্রসারণ ও করবিন কথিত ‘গ্রিন নিউ ডিল’, যেখানে উৎপাদন খাতের মূল বিবেচ্য বিষয় হিসেবে থাকবে কম কার্বন নিঃসরণের বিষয়টি। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ রাষ্ট্রীয় সেবার পরিসর সম্প্রসারণ করা হবে।
এই একই প্রতিশ্রুতির উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে স্যান্ডার্সের বইটিতেও। উভয়েই রাষ্ট্রীয় সেবার পরিসর বৃদ্ধিতে উচ্চ করের কথা বলছেন, যেমনটা নর্ডিক কল্যাণরাষ্ট্র কাঠামোয় দেখা যাচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে পুঁজির ভিত অনেক বেশি শক্তিশালী হওয়ায় স্যান্ডার্স তাঁর প্রতিশ্রুতি প্রকাশে কিছুটা রক্ষণশীল।
না বললেও চলে যে করবিন বা স্যান্ডার্স রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে এই বিষয়গুলোই সবার আগে বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন। বিশেষত উচ্চ করারোপ ও মজুরি বৃদ্ধিই সম্ভবত হবে তাঁদের প্রথম পদক্ষেপ। পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক পুঁজি ব্যবস্থার দিক বদলে, উৎপাদনমুখী ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন তাঁরা। শ্রমিক কল্যাণে উভয় নেতাই কল্যাণ তহবিলের নিয়ন্ত্রকদের নির্বাচনের দায়িত্ব শ্রমিকদের হাতে তুলে দিতে চান। ফলে এই চারটি পদক্ষেপেই বিপুল প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে তাঁদের। পুঁজিকাঠামো সর্বশক্তি দিয়ে এমন যেকোনো পদক্ষেপ ঠেকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। এ ক্ষেত্রে তারা বিনিয়োগ প্রত্যাহার, অন্য দেশে কার্যক্রম স্থানান্তর ইত্যাদির মাধ্যমে সর্বোচ্চ অসহযোগিতা করার চেষ্টা করবে। একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণভাবেও লড়াই চালিয়ে যাবে। এই লড়াইয়ে তাদের হাতিয়ার হবে করবিন ও স্যান্ডার্সের দলের প্রচলপন্থী নেতারা, যারা নয়া উদারবাদকে টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর, যারা ট্রাম্পের মতো নেতার বিরোধী, কিন্তু ব্যবস্থার নয়। এই নেতারা মানুষের দারিদ্র্যকে, অর্থনৈতিক বৈষম্যকে রাজনীতির হাতিয়ার বানালেও কখনোই এর কারণগুলোর অপসারণ চান না, যা কিনা আবার স্যান্ডার্সদের মতো নেতাদের মূল লক্ষ্য। ফলে অভ্যন্তরীণ বিবাদ তৈরি করাটা পুঁজির পক্ষে খুব সহজ হবে।
করবিন ও স্যান্ডার্স ক্ষমতায় এলে বিশ্ব পরিস্থিতি কেমন হবে, তার একটি ধারণা পাওয়া যাবে ইতিহাসের দিকে তাকালে। ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে পরপর দুই বছর আটলান্টিকের দুই পারে দুই সমধর্মী নেতার উত্থান ঘটেছিল। মার্গারেট থ্যাচার ও রোনাল্ড রিগ্যান। দুজনই ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধপরবর্তী উদার যুগের সমাপ্তি করে রক্ষণশীলতার উত্থান ঘটান। তাঁদের এই নীতি তাঁদের দেশে আবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। এর পরের দশকেই এই থ্যাচার ও রিগ্যানের প্রতিক্রিয়ায় যুগল হিসেবেই আবির্ভূত হন বিল ক্লিনটন ও টনি ব্লেয়ার। তাঁরা নিয়ে আসেন ফিরিয়ে আনেন নয়া উদারবাদী ধারণা। মুক্তবাজার অর্থনীতির পাশাপাশি সংকট নিরসনে কূটনৈতিক পথ; এই দুইয়ের সমন্বয়ে গড়ে তোলেন তাঁরা এই কাঠামো, যা এখন পর্যন্ত রাজ করছে সারা বিশ্বে। এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী বলে পরিচয় দেওয়া দুই নেতা করবিন ও স্যান্ডার্স একই সঙ্গে ক্ষমতায় এলে, নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে তা সারা বিশ্বেই ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।
বিশেষত মুক্তবাজার অর্থনীতির অন্যতম ভিত হিসেবে পরিচিত আর্থিক কাঠামোকে তাঁরা যেভাবে মোকাবিলা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তাতে পুরো বাজারকাঠামোতেই বড় ধরনের ওলট-পালট হতে পারে। এটা সত্য যে তাঁরা পুঁজির এত বছরে সঞ্চিত শক্তির বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। ফলে তাঁরা উৎপাদনমুখী শ্রমিকবান্ধব অর্থনীতি নির্মাণের কৌশল হিসেবে পুঁজির অস্ত্রকেই পুঁজির বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে চাইছেন। তাঁরা এটা বলছেন না যে পুঁজিকে তাঁরা নগদ বিদায় বলে দেবেন। বরং বলছেন, ছোট পুঁজিকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হবে এবং উচ্চবিত্ত ও করপোরেটদের ওপর উচ্চ কর বসানো হবে। ফলে আদতে তাঁরা একটি কল্যাণরাষ্ট্রের কাঠামোই আপাতত সামনে আনছেন।
কল্যাণরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত যে একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র—এ বিষয়েও তাঁরা সচেতন। ফলে স্যান্ডার্স ও করবিন উভয়েই ধীরগতিতে এগোনোর কথা বলছেন। উৎপাদন ও আর্থিক খাতে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি তাঁরা সহজে সামনে আনছেন না। প্রকাশ্যে সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রসঙ্গটিই আসছে শুধু। এই পন্থা সফল হলে, বিশ্বব্যাপী তা ছড়িয়ে পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, তাঁদের লড়াইয়ের যে মূল বিন্দু, সেই বৈষম্য সারা বিশ্বেই বিদ্যমান। খোদ বাংলাদেশেই বৈষম্য ক্রমাগত বাড়ছে বলে রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যানেই উঠে এসেছে।
স্যান্ডার্স ও করবিন ক্ষমতায় এলে বৈশ্বিক ক্ষমতার কেন্দ্রটিরও দিক বদল হতে পারে। কিছুদিন আগে একসময় এবং এখনো কাগজে-কলমে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত চীন ১২ ঘণ্টা কাজের প্রতি যে মৌন সমর্থন জানাল, তা বলে দেয়, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে এমন নেতাদের সত্যিকারের উত্থান হলে, পুঁজির আদর্শ দিক বদলাবে। আর চীনের হাতে এ মুহূর্তে রয়েছে বেল অ্যান্ড রোডের মতো বড় ও কৌশলী উদ্যোগ।
দ্য নেশন জানাচ্ছে, স্যান্ডার্স মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে ইসরায়েলকে দখলদার রাষ্ট্র হিসেবে দেখেন। তিনি সরাসরি বলেছেন, নেতানিয়াহুকে তিনি বর্ণবাদী নেতা মনে করেন। এবং পরোক্ষে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকটের সমাধান ১৯৬৭ সালের সমঝোতাতেই দেখছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। আর সৌদি আরবকে তিনি সুদৃষ্টিতে দেখেন না।
ফলে ইরান বিষয়ে মার্কিন নীতি স্যান্ডার্স এলে অপরিবর্তিত থাকবে বলে মনে হয় না। সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। একইভাবে আফ্রিকায় পশ্চিমা করপোরেটদের দৌরাত্ম্য নিয়েও স্যান্ডার্স ও করবিন সমালোচনামুখর। ফলে এসব অঞ্চলে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের নীতির নবায়ন হতে পারে। তবে এ বিষয়ে কিছুটা সংশয়ী অভিমত ব্যক্ত করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে, এই দুই নেতার উপস্থিতি কিছু পরিবর্তন আনলেও বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের যে নীতি, তার তেমন বদল না হওয়ারই আশঙ্কা রয়েছে।
এই সবকিছুর পরও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশে মিলেনিয়াল বামপন্থীদের উত্থান হলে, তা নিশ্চিতভাবেই গোটা বিশ্বকে প্রভাবিত করবে। বিশেষত বৈষম্য নিরসন করে সামাজিক ন্যায্যতা নিশ্চিতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোয় আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাবে। এটা সত্য যে করবিন ও স্যান্ডার্স যা করছেন এবং যা করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তা মূলগতভাবে সমাজতন্ত্র কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। তবে তাঁরা যে সামাজিক ন্যায়ের কথা বলছেন, তা নিয়ে কোনো বিতর্কের সুযোগ নেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে পুঁজির কেন্দ্রে ঘটা যেকোনো পরিবর্তন প্রান্তে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকট হতে দেখা গেছে। সে ক্ষেত্রে এই দুই দেশের ক্ষমতায় স্যান্ডার্স ও করবিনের মতো নেতা বসলে, বিশ্বব্যাপী বামপন্থী রাজনীতি শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পশ্চিমে এ দুই নেতার উত্থানে ইতিমধ্যেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বামপন্থীদের আন্দোলন ও রাজনৈতিক অর্জনেই এর প্রাথমিক স্বাক্ষর রয়েছে।
ফজলুল কবির: সাংবাদিক