যে তিন উৎসবে চলছে যেমন খুশি তেমন নির্বাচন

ভোলা সদর উপজেলার পূর্ব ইলিশা ইউনিয়নে নির্বাচনের চিত্র
 ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন আলোচনার বিষয় হচ্ছে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সার্চ কমিটি। নির্বাচন কীভাবে হবে, কারা নির্বাচন করবেন, ভোটাররা আদৌ ভোট দিতে পারবেন কি না, এসব প্রশ্নকে পেছনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এসব নিয়েও আলোচনা নেই যে গত নির্বাচনের সময়ের মতো এবারও গায়েবি মামলায় সারা দেশের নিরীহ মানুষ হেনস্তার শিকার হবেন কি না, সরকারের বিরোধী প্রার্থীরা ভোটারদের কাছে না গিয়ে আদালতের বারান্দায় কাটাবেন কি না।

কিছু রাজনীতিবিদের কথা শুনে মনে হচ্ছে নির্বাচনের আগের রাতে ভোট হবে, নাকি দিনের আলোয় ভোট–নাটক মঞ্চস্থ হবে—তা এখন ধর্তব্যের বিষয় নয়। সার্চ কমিটিতে কে থাকবেন আর কে থাকবেন না, এ নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলো ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কে কার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নাম নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে যেতে পারেন, এ যেন তারই প্রতিযোগিতা।

এ ধরনের সার্চ কমিটি দিয়ে তৈরি করা কমিশনের কারা সদস্য হবেন, অতীতে কারা হয়েছেন—সেটা কারও না জানার কিছুই নেই। যোগ্যতা একটাই, ক্ষমতাসীন দলের অনুগত থাকা। এ কথা সহজ ভাষায় বলেছেন ড. আকবর আলি খান, ‘নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সার্চ কমিটি করে কোনো লাভ হবে না। সরকারের পছন্দের তালিকাভুক্ত লোক দিয়েই নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে’ (ডেইলি স্টার–বাংলা, জানুয়ারি ১, ২০২২)। নির্বাচন কমিশন নিয়ে আকবর আলি খানের অভিজ্ঞতা আছে। স্মরণ করা দরকার যে ২০০৬ সালে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদস্য ছিলেন এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এবং সরকারপ্রধান ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের আচরণে ভিন্নমত প্রকাশ করে পদত্যাগ করেছিলেন।

ক্ষমতাসীন ১৪–দলীয় মহাজোটের শরিক সংগঠনের দুই নেতা দিলীপ বড়ুয়া এবং রাশেদ খান মেননও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে গিয়ে প্রায় একই কথা বলেছেন। দিলীপ বড়ুয়া বলেছেন, ‘আইন ছাড়া গঠিত নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়’ (দেশ রূপান্তর, জানুয়ারি ৪, ২০২২)। রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ‘আমরা একটি কার্যক্ষম নির্বাচন কমিশন চাই’। নির্বাচন নিয়ে সাবেক এই দুই মন্ত্রীর অভিজ্ঞতা অনেকের চেয়ে বেশি। ‘সরকারের আজ্ঞাবহ’ কমিশনের আয়োজিত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ‘নির্বাচনে’ বিজয়ী হয়েই তাঁরা সাংসদ হন। তবে কথা হচ্ছে যে রাষ্ট্রপতিকে যে নামই দিন না কেন, একটি দলের প্রধানের সম্মতি ছাড়া রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতা নেই কাউকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেওয়ার।

রাজনীতিবিদের কথা শুনে মনে হচ্ছে নির্বাচনের আগের রাতে ভোট হবে, নাকি দিনের আলোয় ভোট–নাটক মঞ্চস্থ হবে—তা এখন ধর্তব্যের বিষয় নয়। সার্চ কমিটিতে কে থাকবেন আর কে থাকবেন না, এ নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলো ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কে কার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নাম নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে যেতে পারেন, এ যেন তারই প্রতিযোগিতা।

সেই কমিশনের কাজ কী হবে সেটাও আমাদের জানা আছে। ভোটাররা ভোট দিতে পারুক অথবা না পারুক তাঁরা বলবেন, ‘উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে’। দেশে এখন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) দফায় দফায় ভোট হচ্ছে, ভোটের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কিংবা কমিশনের সচিব সোৎসাহে এই ভাঙা রেকর্ড বাজান। গত বুধবার ইউপি নির্বাচনের পঞ্চম ধাপে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ১০ জনের প্রাণহানির পরও একই কথাই শোনা গেছে। অথচ এ প্রাণহানির জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকদেরই দায়ী করা হচ্ছে।

এক সংবাদ সম্মেলনে ইসি সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার বলেছেন, এই যে সহিংসতা এবং প্রাণহানি—প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকেরা এর দায় নেবেন। উল্লেখ করার বিষয় হচ্ছে তাঁর পরের কথাটা, ‘আমরা বলছি না, দায় নির্বাচন কমিশনের না’ (প্রথম আলো, অনলাইন, ৫ জানুয়ারি ২০২২)। প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচন কমিশন এ দায়ের জন্য কী করবে? পাঁচ দফায় নির্বাচনে মারা গেছেন ৮৬ জন। তাঁদের এ মৃত্যুর আংশিক দায় যদি নির্বাচন কমিশনের হয়, তবে তার নিশ্চয় একটা ফল আছে, সেটা কী? কথা হচ্ছে কমিশন আগের চার দফায় যা ঘটেছে, তা দেখেও এবার তা ঠেকাতে পারল না কেন? ঠেকানোর জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল?

তবে এটা মানতে হবে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উৎসব হচ্ছে বটে। একটা নয়, তিনটি উৎসব। প্রথমটা হচ্ছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার উৎসব। এযাবৎ ৩৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। হিসাব অনুযায়ী, ১০ শতাংশের মতো। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ছিল ২০৭। বিনা ভোটে ‘বিজয়ী’ হওয়ার এ সংস্কৃতি বা মহামারি কবে শুরু হয়েছে তা আমাদের জানা, ২০১৪ সাল তো অনেক দূরের বিষয় নয়। এ সংস্কৃতি কেবল জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনে উপস্থিত তা নয়, দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এখন এই ধারাই চলছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য যে ধরনের পরিবেশ থাকা দরকার, তা এখন অপসৃত। ফলে যঁারা প্রকৃতপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান, হয় তাঁরা ভীত নতুবা ভাগ–বাঁটোয়ারায় শামিল হওয়াকেই শ্রেয় বলে মানছেন।

দ্বিতীয় উৎসব এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিষয়েই। ইউপি নির্বাচনের প্রচারণায় দেখা যাচ্ছে যে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রকাশ্যেই ভয়ভীতি প্রদর্শন করছেন, কিন্তু নির্বাচন কমিশনের এ নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, বড়জোর রিটার্নিং কর্মকর্তা প্রার্থীকে ‘সতর্ক’ করে চিঠি দিয়েছেন (প্রথম আলো, ডিসেম্বর ৯, ২০২১)। এসব হুমকির মাত্রা বেশ উদ্বেগজনক—‘ক্রসফায়ারে দেওয়ার’ মতো হুমকি তো একাধিক ক্ষেত্রেই ঘটেছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে দেশে এবং দেশের বাইরে উপর্যুপরিভাবে বলা হয় যে, ‘ক্রসফায়ারে দেওয়া হয় না’, ‘ক্রসফায়ার ঘটে’। আর ক্ষমতাসীন দলের মাঠপর্যায়ের নেতারা প্রকাশ্যেই বলেন, ক্রসফায়ারে দেওয়া হবে। অনেক প্রার্থীর সরাসরি নির্দেশ, ‘যাঁরা অন্য মার্কায় ভোট দেবেন, তাঁরা দয়া করে বাড়িতে থাকবেন। নৌকা মার্কায় যাঁরা ভোট দিতে চান, তাঁরা এসে ভোট দেবেন।’

বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ‘যেমন খুশি সাজো’র মতো ‘যেমন খুশি বলো, যেমন খুশি করো’র এ উৎসব নিয়ে কমিশন শুধু নীরবই নয়, এর জন্য সনদ বিতরণে ব্যস্ত। যাঁরা ভয় দেখাচ্ছেন, যঁাদের ভয় দেখানো হচ্ছে তাঁরা প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন দলেরই সদস্য। কার্যত বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনে প্রার্থীদের হুংকার থেকে বোঝা যায় বিরোধী দল থাকলে কী হতে পারত। তাঁদের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের করার কিছু নেই, অথচ সেই কমিশন গঠনের ‘সার্চ’ কমিটি নিয়ে বিরোধী দলের উৎসাহের ঘাটতি নেই।

তৃতীয় উৎসব হচ্ছে বিরোধী দলহীন নির্বাচনের উৎসবের মহড়া। বাংলাদেশে বিরোধী দলহীন–ভোটারবিহীন নির্বাচন একার্থে কোনো নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু মহড়াটি অন্য কিছুর কি না, সেটা ভাবা দরকার। এ নির্বাচনে একই দলের একাধিক প্রার্থীর ব্যবস্থা করে, তাঁদের সংঘাত-সংঘর্ষ-হানাহানির বিষয়ে নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনের নির্লিপ্ততা ভবিষ্যতে জাতীয় পর্যায়ে এ ধরনের নির্বাচনকেই ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন ‘উৎসব’ বলে দাবি করার মহড়া কি না, সেই প্রশ্ন মনে জাগে। এ রকম আশঙ্কার কারণ আছে। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে সেই নির্বাচনের কৌশলাদির মহড়া হয়েছিল দুটি পৌরসভা নির্বাচনে। খুলনা ও গাজীপুরের নির্বাচন আপাতদৃষ্টে শান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক হলেও সেগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু ছিল না (কামাল আহমেদ, ‘নির্বাচনী ব্যবস্থায় উদ্বেগজনক সংযোজন’, প্রথম আলো, জুলাই ২, ২০১৮)।

এখন পর্যন্ত রাজনীতিতে যে অবস্থা দৃশ্যমান তাতে মনে করাই স্বাভাবিক যে নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য না হলে প্রধান বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশ না–ও নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে ২০১৪ সালের পুনরাবৃত্তি রোধে এ পথই বেছে নেওয়া হচ্ছে কি না, সেটাই ভেবে দেখা দরকার।

গত কয়েক বছরে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তাতে ক্ষমতাসীন দল এবং নির্বাচন কমিশনের স্খলন হয়েছে। তারপরও যা ঘটছে তাতে আগামী দিনের নির্বাচন নিয়ে আরও আশঙ্কার সৃষ্টি হচ্ছে।

  • আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট