আমাদের চট্টগ্রামে দিনমজুরির হার এখন সর্বনিম্ন, ৫০ টাকা। এটা আবার কুড়িগ্রামে তিন টাকা হয় কী করে?—সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনকে এমনটাই প্রশ্ন রেখেছিলেন জনৈক পাঠক। অবিশ্বাস্য খবরটি ছিল ’৯০-এর অক্টোবর-নভেম্বরের। জেলা হিসেবে কুড়িগ্রাম কতটা পিছিয়ে ছিল, এ ঘটনা ছিল তার প্রমাণ। কিন্তু এখন কি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে? জেলার চিলমারী উপজেলার চিলমারী ইউনিয়নের অবস্থা দেখে সেটা মনে হয় না। আকাশে স্যাটেলাইট গেল কিন্তু চিলমারীতে একটি হাইস্কুল হলো না।
ব্রহ্মপুত্রের পেটে চর হয়ে জেগে উঠেছে চিলমারী। শুধু শাখাহাতী, কড়াই বরিশাল, চরুয়াপাড়া, বিশারপাড়া মিলেই আয়তন প্রায় ১৮ বর্গকিলোমিটার। এ ছাড়া গাজীরপাড়, মনতোলাসহ অন্যান্য মিলে আয়তন ৪০ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ১৫ হাজার, ভোটার ৬ হাজার ১০৮ জন। মোট পরিবারের সংখ্যা ৩ হাজার। তার মধ্যে জেলে পরিবার ২০০টি। হাট ১টি, মসজিদ ৫টি, শ্মশান ২টি, আশ্রয়ণ প্রকল্প ৬টি, বেড়িবাঁধ ১টি।
বৈলমন্দিয়ারখাতা, শাখাহাতী, মনতোলা, ঢুষমারা, কড়াই বরিশাল, গাজীরপাড়ের মতো ১৩টি গ্রাম নিয়ে ইতিহাসের চিলমারী। ০+থেকে ১৫+শিশুর সংখ্যা ২ হাজার। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৫টি, এনজিওচালিত ২টি, ইবতেদায়ি বা প্রাথমিক মাদ্রাসা ২টি। প্রতিবছর পিইসি পরীক্ষার্থী থাকে গড়ে ২০০ জন। তাদের মধ্যে অষ্টম শ্রেণির বৈতরণিতে নামে গড়ে ৩০ জন। ফলে পুরো চর মিলে স্নাতক ২০ জন ও স্নাতকোত্তর ৭ জন। এঁদের মধ্যে কেবল ২ জন চাকরিজীবী। চরবাসীর পেশা কৃষি, দিনমজুরি ও মাছ ধরা।
দেশে মোট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২০ হাজার ৪৬৫টি। সম্প্রতি এমপিওভুক্ত হয়েছে আরও হাজার দেড়েক। কিন্তু ১৩টি গ্রাম নিয়ে একটি ইউনিয়নের ভাগে একটিও জোটেনি! সারা দেশে গড়ে ৯৬ ভাগ শিশু ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলেও এখানে সেই হার ১৫। ৭০ ভাগ শিশু যেখানে অষ্টম শ্রেণির বৈতরণি পার হয় সারা দেশে, এখানে তা ১০ ভাগ।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ৪ নম্বরটি হচ্ছে শিক্ষাবিষয়ক। সেখানে ৭টি সূচক অর্জনের টার্গেট ঠিক করা হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে, ‘২০৩০ সালের মধ্যে সব বালক-বালিকা যাতে বিনা মূল্যে, বৈষম্যহীন ও মানসম্মত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যন্ত সমাপ্ত করতে পারে এবং প্রাসঙ্গিক ও কার্যকর শিখনফল অর্জন করে, তা নিশ্চিত করা।’ কিন্তু চিলমারী ইউনিয়নে তো হাইস্কুলই নেই! এখানকার বাসিন্দারা কি বাংলাদেশের বাইরে? ইতিহাস তো বলে ১৬ অক্টোবর ১৯৭১ সালে চিলমারীর বাসিন্দারা বীরত্বপূর্ণ লড়াই দিয়েছিলেন পাকিস্তানি আর্মির সঙ্গে। ছালিপাড়া ও গাজীর চরে দুটো মাউন্টেন গান বসিয়েছিলেন কর্নেল তাহের। হয়েছিল বিখ্যাত চিলমারী রেইড। তারও আগে জেলেরা পাকিস্তানি আর্মির নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছেন। চরে আটকে দিয়েছিলেন মুক্তাঞ্চল রৌমারীগামী জাহাজ। এত রক্তদান কি তবে বৃথা গেল?
২.
এখানে এত বছরেও কেন একটি হাইস্কুল হয়নি, সেটাই বড় আশ্চর্যের ঘটনা। ’৬৭ সালে ব্রহ্মপুত্র ভাঙনের আগ পর্যন্ত সব ছিল। বিদ্যানুরাগী জমিদাতাও আছেন। সচিব-রাষ্ট্রদূতসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি আছেন, যাঁরা এই ইউনিয়নের সন্তান। সবাই কাইম এলাকায় বাড়ি গড়ে। কেউ নিজ ভিটায় একটা হাইস্কুল নির্মাণের প্রয়োজন বোধ করেননি। অথচ এখানে ২-৩টি হাইস্কুল হওয়ার কথা। ছাত্র ও জনসংখ্যা বিবেচনায় নিলে তা–ই হয়।
বিস্তৃত চরে একটি স্বনির্ভর উচ্চশিক্ষার আদর্শ প্রতিষ্ঠান অনায়াসে গড়ে উঠতে পারে। যা স্থানীয় উৎপাদন-সম্পর্কের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৃষি ও শিল্পকেন্দ্রিক হবে। একটি আবাসিক উচ্চবিদ্যালয় ও বিকেএসপির মতো প্রতিষ্ঠানই হতে পারে। এখানে শিশুরা প্রকৃতির সন্তান। তারা সাঁতার কাটা, নৌকা চালানো থেকে শুরু করে গাছ চেনা, কোন গাছের কোন অংশ কোন রোগে লাগে, তা জানে। অনায়াসে ফুটবল ও কাবাডির টিম গড়ে তোলা যায়। মাত্র একজন প্রশিক্ষক দরকার। এখানে এখনো মহিষের দুধ ৪০ টাকা ও গাভির দুধ ৩০ টাকা। মেহমান বাড়িতে এলে তাঁকে দুধপান করতে দেওয়া হয়। কত কিছুই হতে পারে। যেখানে এত বছরে একটা হাইস্কুলই হয়নি, এসব স্বপ্ন বলে ভ্রম হয়। গত বন্যায় একজন সাবেক সচিব জুতা খুলতে হবে বলে নিজ জন্মভিটায় নামেননি। নৌভ্রমণ করে চলে গেছেন। এই চরের মানুষ জাতীয় পার্টি-আওয়ামী লীগে বিভক্ত। যদিও একসময় কমিউনিস্ট পার্টিই একমাত্র সংগঠন ছিল। কিন্তু ভোটের সময়ও তারা নেতাদের মুখদর্শন করতে পারেনি। যিনিই সামর্থ্যবান হন, তিনিই ছেড়ে যান এই চরের জীবন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যেন তাদের জীবন যাপন করতে না হয়। কৃষক ভাই থাকেন এখানে আর চাকরিজীবী ভাই কাইমে। এমনকি যিনি চেয়ারম্যান হন, তিনিও থাকেন না।
একটি এনজিও সাইনবোর্ড লাগিয়েছে, বাল্যবিবাহমুক্ত ওয়ার্ড। অথচ পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর আর লেখাপড়ার সুযোগ না থাকায় বাল্যবিবাহ এখানে নিত্য ঘটনা। মূল ভূখণ্ড থেকে নৌকা পারাপারে ঘণ্টাখানেক লাগে। ফলে কে আসবে যাচাই করতে। শহরের সঙ্গে চরবাসীর জীবনের যোগ সপ্তাহে দুই দিনের দুই হাটবারে—রবি আর বুধবার। এনজিওর স্কুলপ্রতি নিয়োগ দেওয়া হয় একজন অষ্টম শ্রেণি পাস শিক্ষক। বেতন ৩-৪ হাজার। ফল তথৈবচ।
চিলমারীর বশির আহমেদ, জামিউল ইসলাম ও মাহমুদুল হাসান। তিনজনেরই বয়স ৪০-এর আশপাশে। তাঁরা এই ইউনিয়নের শাখাহাতী গ্রামে ২০০ কাঠা জমি সংগ্রহ করেছেন একটি স্কুলের স্বপ্নে। তাঁরা জানান, এটি একই সঙ্গে শিক্ষা ও শিল্পকেন্দ্র হবে। মায়েরা উৎপাদন করবেন, সন্তানেরা জ্ঞানচর্চা করবে। নদীতে সাঁতার প্রশিক্ষণ হবে। খাসজমিতে প্রাকৃতিক বন গড়ে তোলা যায়। শিক্ষার্থীরা কৃষকের কাছে, জেলেদের কাছে, প্রকৃতির কাছে শিখবে। কাজ ও শিক্ষা দুটোই হবে। কিন্তু আর্থিক সংকটে আটকা পড়েছেন তাঁরা। সরকারি–বেসরকারি সহযোগিতা পেলে তাঁরা স্বপ্নটিকে এগিয়ে নিতে পারতেন। মানুষ চাঁদে গেল অথচ চিলমারী ইউনিয়নে একটি হাইস্কুল হলো না, এই বৈপরীত্যের মীমাংসা ছাড়া কত দূর যাবে বাংলাদেশ?
নাহিদ হাসান রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি