যে গণহত্যার দ্বিতীয় নজির নেই

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

বিশ্বের ইতিহাসে অনেক গণহত্যা ঘটেছে। কখনো ভিন্নমত বা বিদ্রোহ দমন করতে শাসকেরা নিজ দেশের জনগণের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে; কখনো অধিক ক্ষমতাধর দেশ অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশের জনগণকে হত্যা করে ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ জাহির করতে চেয়েছে। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে কায়দায় বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ইতিহাসে তার নজির পাওয়া ভার।

 পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম ও শেষ নির্বাচনে (১৯৭০) এ দেশের মানুষ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ২৩ বছরের জুলুম ও শোষণের জবাব দেয়। জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি লাভ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি পায় ৮১টি। কিন্তু নির্বাচনের পর থেকেই পাকিস্তানি শাসক চক্র ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টালবাহানা করতে থাকে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এরপরই গোটা বাংলাদেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ছয় দফা পরিণত হয় এক দফা তথা স্বাধীনতার দাবিতে।

৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার’ আহ্বান জানালে সংগ্রাম নতুন মাত্রা পায়। শুরু হয় সর্বাত্মক অসহযোগ। পাকিস্তানি শাসক চক্র ভয় পেয়ে যায়। ৬ মার্চ স্থগিত ঘোষিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের তারিখ পুনর্নির্ধারণ করা হয় ২৫ মার্চ। ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন ক্ষমতা হস্তান্তরের কৌশল নিয়ে। কিন্তু সে আলোচনা শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হলো না পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক এলিট শ্রেণির একগুঁয়েমির কারণে।

 ইয়াহিয়া খান ও তাঁর পরামর্শক দল ক্ষমতা হস্তান্তরের চূড়ান্ত কর্মপরিকল্পনায় সম্মতি দিয়েও পিছু হটে। সামরিক অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়ে ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ রাতেই ঢাকা ত্যাগ করেন। পরদিন ভুট্টো করাচি ফিরে বলেছিলেন, ‘থ্যাঙ্ক গড, পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে।’ কিন্তু পাকিস্তান রক্ষা পায়নি। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান এবং কোটি কোটি মানুষের সর্বস্ব হারানোর বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। আর ১৬ ডিসেম্বর ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনাকে লজ্জাজনকভাবে আত্মসমর্পণ করতে হয় বাংলাদেশের মাটিতেই।

মার্চে আলোচনা চলাকালে এমনকি তার আগে থেকে পাকিস্তানি সামরিক চক্র গণহত্যার নীলনকশা আঁটতে শুরু করেছিল। গভর্নর আহসান ও আঞ্চলিক সেনা প্রশাসক ইয়াকুব আলী খানের বিদায়, নতুন গভর্নর হিসেবে ‘বুচার অব বালুচিস্তান’ হিসেবে পরিচিত টিক্কা খানের দায়িত্ব গ্রহণই প্রমাণ করে পাকিস্তানিরা সামরিক প্রস্তুতিও নিচ্ছিল। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু জনগণকে প্রস্তুত করার পাশাপাশি পাকিস্তানিদের উন্মাদনা বন্ধ করতে কূটনৈতিক প্রয়াসও নিয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তানিদের উন্মাদনা বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চেয়েছিলেন। একই সঙ্গে ভারতকে এই বার্তা দিয়েছিলেন যে তারা যেন পশ্চিম সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহার না করে। পশ্চিম সীমান্তে ভারত সেনা প্রত্যাহার না করলে পাকিস্তানও সেখান থেকে সেনা সরিয়ে পূর্বাংশে নিয়ে আসতে সাহস পাবে না।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার মাত্রা যে কী ভয়াবহ ছিল, তা বিদেশি সাংবাদিক ও কূটনীতিকদের বয়ানেও জানা গেছে। আর্চার কে ব্লাড তখন ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল। তিনি ২৮ মার্চ পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো বার্তায় লিখেছেন, পাকিস্তানি বাহিনী একটি ভূখণ্ডকে যে বিভীষিকাময় ও সন্ত্রস্ত জনপদে পরিণত করেছে, তার প্রত্যক্ষদর্শী আমরা। সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে অসংখ্য মানুষ গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে তিনি অভিহিত করেছিলেন বাছাই করা গণহত্যা বলে।

গণহত্যার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সাইমন ড্রিং। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সব বিদেশি সাংবাদিককে হোটেল শেরাটন থেকে তুলে নিয়ে করাচিগামী বিমানে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু সাইমন ড্রিং ও অ্যাসোসিয়েট প্রেসের মাইকেল লরেন্ট পালিয়ে থেকে যান। এরপর ২৭ মার্চ দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ প্রত্যাহার করা হলে তাঁরা শহরে বেরিয়ে পড়েন। সাইমন ড্রিং পরে টেলিগ্রাফে লিখেছেন: ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’। তাঁর এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরই বহির্বিশ্ব পাকিস্তানিদের বর্বরতার খবর জেনে যায়। এর আগে পাকিস্তানিরা গণহত্যার খবরকে আওয়ামী লীগ ও ভারতের অপপ্রচার বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।

সাইমন ড্রিং লিখেছেন, ‘আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও ভীতসন্ত্রস্ত নগরী। ঠান্ডা মাথায় পাকিস্তানি বাহিনী ২৪ ঘণ্টা ধরে গোলাবর্ষণ করেছে, ওই নগরীর সাত হাজার মানুষ নিহত, বিশাল বিস্তীর্ণ এলাকা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২৫ মার্চ রাতে ট্যাংক বহরের প্রথম লক্ষ্য ছিল ছাত্ররা। ঢাকা আক্রমণে তিন ব্যাটালিয়ন সেনা নামানো হয়, তাদের একটি ছিল সাজোয়াঁ, একটি গোলন্দাজ ও একটি পদাতিক। ...অগ্নিদগ্ধ কক্ষের ভেতরে লাশ, বারান্দায় আর মাঠে লাশ। সবচেয়ে বেশি লাশ দেখা গেল পাশের লেকে। চিত্রকলার এক ছাত্রের লাশ উপুড় হয়ে পড়ে ছিল তঁার ক্যানভাসের ওপর। অন্য একটি হলে ছাত্রদের হত্যা করে দ্রুত মাটিচাপা দিয়ে তার ওপর ট্যাংক দিয়ে মাটি সমান করে দেওয়া হয়েছিল।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ও শিক্ষকদের আবাসস্থলে ঢুকে সেনাবাহিনী পাইকারি হত্যা করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই অভিযানের নাম দিয়েছিল অপারেশন সার্চলাইট। আসলে এর মাধ্যমে তারা অন্ধকারই ডেকে নিয়ে এসেছিল।

সেদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আরও দুটি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায় এবং নির্বিচার হত্যা করে। এর একটি ছিল রাজারবাগে পুলিশ সদর দপ্তর ও পিলখানায় ইপিআর সদর দপ্তর। তবে সেখানে অবস্থানরত বাঙালি পুলিশ ও ইপিআর সদস্যরা পাকিস্তানিদের আক্রমণের খবর পেয়ে পালিয়ে যাননি। তাঁরা সাধ্যমতো প্রতিরোধ করেছেন।

বাংলাদেশ ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করছে। ২০১৭ সালে জাতীয় সংসদে এ নিয়ে আইন পাস হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের কাছেও ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। শুধু ২৫ মার্চ নয়, পাকিস্তানিরা গণহত্যা চালিয়েছে মুুক্তিযুদ্ধের নয় মাসই ধরেই। একাত্তরে গণহত্যায় জড়িত এ দেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমরা করেছি। কিন্তু পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারিনি।

তবে এই দাবি আমাদের জানিয়েই যেতে হবে।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com