মতামত

যে কারণে সৌদি যুবরাজের বিরুদ্ধে যাবেন না বাইডেন

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান
ছবি: রয়টার্স

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ইস্তাম্বুলে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন—মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এমন রিপোর্ট দেওয়ার পরও প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন মোহাম্মদ বিন সালমানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে অস্বীকার করেছে। মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবের কার্যত শাসক, এমন বিবেচনায় বাইডেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটি বহু মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে। তবে বাইডেন সঠিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৈদেশিক সম্পর্কসংক্রান্ত পদক্ষেপ নিয়েছেন।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন সৌদির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়টি খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ককে পআবার সাজাতে চায় এবং সে ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সামনে কোনো ব্যক্তি ইস্যু বাধা হতে পারে না। খাসোগি হত্যা ইস্যুতে ব্লিঙ্কেনের এ বক্তব্যের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।

১৯৫০ সালে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট ডিট আইজেনহাওয়ার থেকে এ পর্যন্ত সব মার্কিন প্রেসিডেন্ট সৌদি ইস্যুতে যে নীতিতে হেঁটেছেন, বাইডেন তার ব্যতিক্রম নন। পূর্বসূরিদের মতো বাইডেনও উপলব্ধি করতে পারেন, শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের পদচারণকে মসৃণ রাখতে সৌদি আরবের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখা অনস্বীকার্য। এ ক্ষেত্রে ক্রাউন প্রিন্সকে আহত করে সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা কঠিন।

বাইডেন ভোটের আগে নির্বাচনী প্রচারের সময় সৌদি আরবের বিরুদ্ধে যেভাবে সমালোচনা করেছিলেন; তিনি মোহাম্মদ বিন সালমানের বিরুদ্ধে যে বাগাড়ম্বর অবস্থানে ছিলেন, সে অবস্থানের সঙ্গে তাঁর বর্তমান অবস্থানের বিস্তর ফারাক দেখে খোদ ডেমোক্রেটিক পার্টিরই অনেকে বিরক্ত হচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, বাইডেন খাসোগি হত্যার বিষয়ে যেভাবে মোহাম্মদ বিন সালমানকে ছাড় দিচ্ছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রকে অন্যায়ের সঙ্গে আপসকামী শক্তি হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে প্রদর্শন করছে। তাঁরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি যে মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে চলে, এর মাধ্যমে তার সঙ্গে আপস করে বাইডেন প্রশাসন দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে।

তবে বাইডেনের এ অবস্থানের ব্যাখ্যা খুবই সহজ। কারণ, আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ক্রেতাদের শীর্ষস্থানে থাকা দেশ সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বহুপক্ষীয় কৌশলগত স্বার্থের সম্পর্ক রয়েছে। সেই সম্পর্ক রক্ষা উভয়ের জন্য এতটাই অনস্বীকার্য যে ওয়াশিংটন কিংবা রিয়াদের গদিতে কে আছেন, সেটা কোনো বিষয়ই নয়।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এ দুটি দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের সঙ্গে বৈশ্বিক জ্বালানি ও অর্থের বাজারের স্থিতিশীলতা নির্ভর করে। পাশাপাশি বিশ্বের রিজার্ভ অর্থ হিসেবে মার্কিন ডলারের শ্রেষ্ঠত্বও এ দুই দেশের সুসম্পর্কের ওপর অনেকখানি নির্ভর করে। যেহেতু সৌদি আরবের সব তেলই মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়, সেহেতু এ সম্পর্কের অবনতিতে কোনো পক্ষেরই লাভ হবে না।

এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, বৈশ্বিক জিহাদি গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া, ইরানকে নিয়ন্ত্রণ করা, ইয়েমেনে যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে দেশটির পুনর্গঠন করা এবং ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক সহজ করার মতো কিছু বিষয়ে দুই দেশের অবস্থান অভিন্ন। এমনকি কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায়ও সৌদির সহযোগিতা অনস্বীকার্য। কারণ, এ বছর হজের সময় সারা বিশ্ব থেকে হাজিরা মক্কায় জড়ো হবেন। যদি স্বাস্থ্যবিধি ঠিকমতো না মানা হয়, তাহলে তাঁদের থেকে বিশ্বব্যাপী এ ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি থেকে যাবে।

এ কারণে দুই দেশের সম্পর্ক অনড় থাকবে এবং সৌদির রাজতন্ত্রও অটুট থাকবে। মোহাম্মদ বিন সালমানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কোনো নজিরবিহীন পদক্ষেপ নিলে তা দুই দেশের সম্পর্ককে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেবে। এর আগে ট্রাম্প সৌদি নেতাদের সঙ্গে খুবই ব্যক্তিগত পন্থায় সম্পর্ক রাখতেন, বিশেষ করে তাঁর জামাতা জ্যারেড কুশনারের মাধ্যমে মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতেন।

এটি দুই দেশের পররাষ্ট্রনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সৌদি নেতাদের সঙ্গে কূটনৈতিক প্রটোকল এড়িয়ে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত পর্যায়ের যোগাযোগ প্রাতিষ্ঠানিক কূটনীতিকে খর্ব করেছে। দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, গোয়েন্দা সংস্থা, সামরিক কর্মকর্তা, মন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের মধ্যে সংলাপ বিনিময় ও বৈঠকে মিলিত হওয়াই স্বাভাবিক কূটনীতি ছিল। ট্রাম্প সেগুলো বাদ দিয়ে নিজেই ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে সৌদি নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন। বাইডেন এখন সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাভাবিক নিয়মিত লেনদেনের কাজকে আবার চালু করতে চাইছেন। এ ক্ষেত্রে জামাল খাসোগি হত্যা ইস্যু তুলে মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে, তথা সৌদি সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নষ্ট করার কোনো ইচ্ছা তাঁর নেই।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

বার্নার্ড হাইকেল প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও লেখক