সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নতুন করে নিম্নমুখী হয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া থেকে তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞাসহ নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এতে তেলের দর আকাশছোঁয়া হয়েছে। এর লাগাম টানতে যুক্তরাষ্ট্র আশা করেছিল সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত তেলের উৎপাদন বাড়াবে। কিন্তু সৌদি আরব ও আমিরাতের নেতারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করছেন বলে জানা যাচ্ছে।
বাইডেন বিকল্প পথ খুঁজছেন। একটি মার্কিন প্রতিনিধিদল ইতিমধ্যে ভেনেজুয়েলা সফর করেছে বলে জানা গেছে। ভেনেজুয়েলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। তখন থেকেই দেশটির ওপর তেল নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র সেই তেল নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, রাশিয়া প্রতিদিন বিশ্ববাজারে যে ২৫ লাখ ব্যারেল তেলের জোগান দিয়ে আসছিল, তা ভেনেজুয়েলা বা ইরান কেউ পূরণ করার ক্ষমতা রাখে না।
২০১৯ সালে সৌদি আরবের কেন্দ্রীয় তেল স্থাপনায় ইরান হামলা চালানোর পর সৌদির তেল উৎপাদন ৫০ শতাংশ পড়ে গিয়েছিল। ওই হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের পক্ষ নেয়নি এবং ইরানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি।
ইরান ও ভেনেজুয়েলার উৎপাদন বাড়ানোর জন্য তাদের তেলক্ষেত্র এবং জাতীয় তেল সংস্থাগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। এটি একটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। আপাতত তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংগঠন ওপেকের নেতৃত্ব দেওয়া দেশ সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অতিরিক্ত তেল উৎপাদনের ক্ষমতা রাখে। কেবল তাদেরই বাজার স্থিতিশীল করার ক্ষমতা রয়েছে। তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১৫০ ডলারের মধ্যে থাকবে, নাকি ১৫০ ডলার ছাড়িয়ে যাবে, তা তারাই ঠিক করতে পারবে।
সৌদি নেতৃত্বের সঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের সম্পর্ক কখনোই ভালো ছিল না। গত বছর, বাইডেন একটি মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে বলা হয়েছিল, সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে ভিন্নমতাবলম্বী সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যা করা হয়েছিল। যদিও বাইডেন মোহাম্মদ বিন সালমানের বিরুদ্ধে সরাসরি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেননি এবং সে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বাইডেনকে প্রচুর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। তবে তেল উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ মেনে নিতে সৌদি আরবের অনাগ্রহ নিছক বাইডেনের বিরুদ্ধে সৌদির ক্ষোভকে প্রতিফলিত করে না। বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার অনেক আগে থেকেই মার্কিন-সৌদি সম্পর্ক নিম্নগামী ছিল।
টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তিক্ত হতে শুরু করে। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে আক্রমণ চালালে সৌদি রাজপরিবার এর বিরোধিতা করেছিল। সে সুবাদে সম্পর্কটি আরও খারাপ হতে শুরু করে। বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সেই সম্পর্কের অবনতি আরও ত্বরান্বিত হয়েছিল। তাঁর প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্য থেকে এশিয়ার দিকে মনোযোগী হয়। ওবামার এ নীতিকে আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্যের মিত্ররা যুক্তরাষ্ট্রের ‘মধ্যপ্রাচ্য পরিত্যাগ’ বলে মনে করেছিল। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করার পর সৌদিরা বিশ্বাস করতে শুরু করে, যুক্তরাষ্ট্র তার দীর্ঘদিনের কৌশলগত মিত্র সৌদি আরবকে পরিত্যাগ করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির শূন্যস্থান পূরণে সৌদি আরব শুধু যে রাশিয়াকেই ভরসাস্থল মনে করছে, তা নয়। বিকল্প মিত্র হিসেবে সৌদি সরকার ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের কথাও ভাবছে এবং তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
ওবামার উত্তরসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্প মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে ভালো ব্যক্তিগত সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন বটে, কিন্তু ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গেও সৌদির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক হ্রাস পেতে থাকে। ২০১৯ সালে সৌদি আরবের কেন্দ্রীয় তেল স্থাপনায় ইরান হামলা চালানোর পর সৌদির তেল উৎপাদন ৫০ শতাংশ পড়ে গিয়েছিল। ওই হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের পক্ষ নেয়নি এবং ইরানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি।
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালে সৌদি আরব রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ককে গভীরতর করছিল। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের শেষের দিকে; অর্থাৎ ট্রাম্পের প্রেসিডেন্টের গদিতে বসার ঠিক আগে। ওই সময় ওপেক ও রাশিয়া তেল উৎপাদন কমানোর জন্য একটি চুক্তিতে পৌঁছেছিল। সৌদি আরব ও রাশিয়া তিন বছর ধরে ওপেক প্লাস চুক্তির মাধ্যমে উৎপাদন কোটা সমন্বয় করে আসছিল।
কিন্তু ২০২০ সালের মার্চে কোভিড-১৯ মহামারিতে তেলের বৈশ্বিক চাহিদা ভীষণ রকম কমে যাওয়ায় ওপেক প্লাস বড় উৎপাদন কমানোর দাবি করেছিল। কিন্তু রাশিয়া তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। এতে সৌদি আরব জোগান বাড়িয়ে দিয়ে তেলের বাজার প্লাবিত করে দেয়, যার ফলে শেষ পর্যন্ত রাশিয়া ওপেক প্লাস চুক্তিতে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। (বর্তমানে প্রতিদিন সৌদি আরব যে চার লাখ ব্যারেল উৎপাদন করছে, তা ওপেক প্লাস চুক্তির ধারাবাহিকতায় উৎপাদন বৃদ্ধিই অংশ)।
তেল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার সমন্বয়ের বাইরে সৌদি-রাশিয়া সম্পর্ক এখন আর্থিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থারও অন্তর্ভুক্ত। সৌদি আরবের দৃষ্টিতে রাশিয়া একটি সম্ভাব্য অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। একই সঙ্গে দেশটির ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করার ক্ষমতা আছে বলেও সৌদি মনে করে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির শূন্যস্থান পূরণে সৌদি আরব শুধু যে রাশিয়াকেই ভরসাস্থল মনে করছে, তা নয়। বিকল্প মিত্র হিসেবে সৌদি সরকার ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের কথাও ভাবছে এবং তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। বিশেষ করে তাদের কাছ থেকে অস্ত্র কেনা বাড়িয়ে সম্পর্ককে দৃঢ় করছে। সৌদি আরব স্থানীয়ভাবে অস্ত্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে চীন ও অন্যদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগও চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বাইডেন প্রশাসন সৌদি আরবের (এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত) কাছে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রিতে বাধা তৈরি করেছে। এ ছাড়া ইয়েমেনে ইরান–সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি আরব যে অভিযান চালাচ্ছে, তাতে গোয়েন্দা ও রসদ সহায়তা দিতে অস্বীকার করেছে ওয়াশিংটন।
এর কোনোটিই সৌদি আরবকে আমেরিকান অনুরোধ রাখার জন্য বিশেষভাবে উপযুক্ত করেনি। গত নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের সুবিধা নিশ্চিত করতে বাইডেন প্রশাসন সৌদি আরবকে তেল উৎপাদন বাড়িয়ে বিশ্ববাজারে দাম কমিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল। সৌদি সরকার তখন যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়েছিল, এবারও ঠিক একইভাবে তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে।
সৌদির আচরণে বোঝা যাচ্ছে, তারা শুধু তখনই তেলের দাম বাড়াবে, যখন তাদের নিজেদের প্রয়োজন হবে। তারা আমেরিকার পক্ষ নিয়ে রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি নেবে না। তারা তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকেও ঝুঁকিতে ফেলবে না।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
● বার্নার্ড হাইকেল প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক