চীনের তিয়ানজিন শহরে তালেবান নেতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদার ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। ২৮ জুলাইয়ের ছবি
চীনের তিয়ানজিন শহরে তালেবান নেতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদার ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। ২৮ জুলাইয়ের ছবি

মতামত

যে কারণে তালেবানকে প্রতিবেশীরা সমর্থন দিচ্ছে

আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে যাওয়ার পর দক্ষিণ এবং মধ্য এশিয়ায় একটি রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, এই শূন্যতা কে পূরণ করবে? আফগানিস্তানের গা লাগোয়া প্রতিবেশী পাকিস্তান, ইরান ও চীন—সবাই এই শূন্যতা পূরণে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ ঠিক করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে তৎপর হয়েছিল এবং যে ভূমিকা রেখেছিল, এই তিন দেশ সে ধরনের ভূমিকা রাখতে সমর্থ নয়। কিন্তু এদের প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ ভূখণ্ডের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে আফগানিস্তানে একটি স্থিতিশীল সরকার দেখতে চায়।

অন্যদিকে তালেবান সরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান, চীন ও ইরানকে তারা হাতে রাখতে চাইছে। দেখা যাচ্ছে এই তিন দেশও নিজেদের প্রয়োজনে তালেবান সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলতে চাইছে।

পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের ২ হাজার ৬৭০ কিলোমিটারের স্থলসীমান্ত রয়েছে। চার দশক ধরে এ সীমান্তে অস্থিরতা থাকায় পাকিস্তানকে অনেক মাশুল গুনতে হয়েছে। ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফগানদের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল, সেই যুদ্ধে ওয়াশিংটনের লাঞ্চিং প্যাড ছিল পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্রকে সেই সুবিধা দিতে গিয়ে পাকিস্তানকে তখন অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল। এরপর নাইন–ইলেভেন পরবর্তী ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’ পাকিস্তানের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। পাকিস্তানের ভেতরে, বিশেষ করে আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত এলাকায় বহু সশস্ত্র গ্রুপ গজিয়ে ওঠে।

তেহরিক-ই-তালেবান এবং বালুচ সশস্ত্র যোদ্ধারা পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালিয়ে ৮৩ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করে এবং বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সম্পদ নষ্ট করে। ইসলামাবাদ বরাবরই অভিযোগ করে থাকে, পাকিস্তানে যেসব হামলা হয়, তার বেশির ভাগই ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আফগানিস্তানের মাটিতে বসে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করে। একই সঙ্গে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তালেবানকে, বিশেষ করে হাক্কানি নেটওয়ার্ককে মদদ দেওয়ার অভিযোগ আছে।

এখন যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়া ও তালেবানের ক্ষমতা দখলকে পাকিস্তানের সামরিক মহল খুবই ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। তারা মনে করছে, যেহেতু তালেবান ক্ষমতায়, সেহেতু পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্ত এলাকা ভারতের যেকোনো হানা থেকে মুক্ত থাকবে।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জাতিসংঘে পাঠানো ভিডিও বার্তায় বিশ্বনেতাদের আফগান সরকারের পাশে দাঁড়াতে বলেছেন। তবে পাকিস্তানের গোয়েন্দারা জাতীয় নিরাপত্তা পর্ষদের বৈঠকে বলেছেন, তালেবান ভবিষ্যতে হয়তো তাদের কথা আর না–ও শুনতে পারেন। এ কারণে পাকিস্তান ১৯৯০ সালের আদলে হুট করে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেবে না। তারা অন্যদের নিয়ে একযোগে স্বীকৃতি দিক।

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা সরানোর পর ৯২ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে চীন। আফগানিস্তানের সঙ্গে লাগোয়া চীনের ওয়াখান করিডর নিয়ে বেইজিং যথেষ্ট চিন্তিত।

বেইজিংয়ের ভয়, আফগানিস্তানে নৈরাজ্য হলে তার তাপ চীনের জিনজিয়াং পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে এবং তাতে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্প ব্যাহত হতে পারে।

গত ২৮ জুলাই তালেবান নেতা মোল্লা গনি বারাদার ৯ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে তিয়ানজিনে বৈঠক করেছেন। সেখানে তালেবান নেতারা চীনকে আশ্বস্ত করেছেন, তাঁরা কাউকে আফগানিস্তানের মাটিতে বসে চীনবিরোধী তৎপরতা চালাতে দেবেন না। বৈঠকটি তালেবানের সামনে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। চীন ইতিমধ্যে আফগানিস্তানে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছে। আফগানিস্তানের খনি সম্পদের দিকেও চীনের নজর রয়েছে। আন্দাজ করা হয় আফগানিস্তানে ৩ লাখ কোটি ডলারের খনিজ সম্পদ রয়েছে।

এ সম্পদের দিকে আরও বহু দেশের নজর আছে। সেসব দেশ এ সম্পদ হস্তগত করতে স্থানীয় সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে ব্যবহার করতে পারে—এমন আশঙ্কাও চীনের রয়েছে। সে কারণে চীন আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চায়।

ইরানের সঙ্গে আফগানিস্তানের ৯২১ কিলোমিটারের সীমান্ত রয়েছে। ১৯৯০ সালে তেহরান তালেবানবিরোধী উত্তরাঞ্চলীয় জোটকে সহায়তা দিয়েছিল। সে সময় তারা তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান দখল করার পর নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে তালেবানকে মার্কিন স্বার্থে আঘাত করতে গোপনে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছিল।

এখন যুক্তরাষ্ট্র কাবুল ছাড়ায় ইরান খুশি। তালেবানের ক্ষমতা দখলকে তারা খুব যে আনন্দের সঙ্গে নিয়েছে, তা–ও নয়। তালেবান সরকারে কোনো শিয়া প্রতিনিধি না রাখায় তেহরান সমালোচনা করেছে। আফগানিস্তানে হাজারা শিয়া সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।

রাজনীতির বাইরে আর্থিকভাবেও ইরান আফগানিস্তান থেকে ফায়দা তুলতে চায়। ২০১৮ সালে আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার ছিল ইরান। সেই জায়গাটি ইরান ধরে রাখতে চায়।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

জহির শিরাজি পাকিস্তানের উর্দু পত্রিকা নওয়া-এ-পাকিস্তান-এর সম্পাদক